হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য কিন্তু… ঐক্যবদ্ধ করবে কে?

আদিবা ইসলাম:
১৮০০ সালের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানের মতো এত শক্তিশালী ও বিস্তৃত ছিল না। তখন দেশটি মাত্র ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত ছিল, যা মূলত পূর্ব উপকূলে সীমাবদ্ধ ছিল। আজকের কানাডার অংশ ‘ব্রিটিশ কলম্বিয়া’র সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না; এটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ১৭৭৬ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে পরিচালিত হতো এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এর তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল না। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটির জাতীয় নেতারা একত্রিত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেন। ধাপে ধাপে বিভিন্ন অঞ্চল যুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮৭৭ সালের মধ্যে অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮টি। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে আলাস্কা (যা ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল) এবং হাওয়াই যুক্ত হয়ে মোট অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০টি। এই ৫০টি অঙ্গরাজ্য একত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করে তোলে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, জাতীয় সম্পদ এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র একসময় বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি, সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্মিলিত শক্তি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা মিত্রপক্ষ, বিশেষ করে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এর ফলে জার্মানি পরাজিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমঞ্চে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এই সাফল্যের পেছনে ছিল তাদের সুসংগঠিত ঐক্য, পরিকল্পনা ও জাতীয় ঐক্যের শক্তি।

ব্রিটেন একসময় বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করত। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও আয়ারল্যান্ড একত্রে গঠিত হয়েছিল ‘যুক্তরাজ্য’ বা ইউনাইটেড কিংডম (United Kingdom)। এই ঐক্যই তাদের ক্ষমতার মূল ছিল। একসময় এই শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। একইভাবে, বিশ্বের অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের নামেই ঐক্যের ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, United States of America (USA)- এখানে ‘United’ অর্থাৎ ‘ঐক্যবদ্ধ’। একইভাবে Union of Soviet Socialist Republics (USSR)-এ ‘Union’ শব্দটিও ঐক্যের প্রতীক। তেমনি United Kingdom (টক) নামেও ‘United’ শব্দটি রয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই তিনটি রাষ্ট্রের নামেই ‘টহরঃবফ’ বা সমার্থক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা বোঝায়- একাধিক অঞ্চল বা রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করেছে।

সুতরাং এটা প্রমাণিত সত্য যে, যারা ঐক্যবদ্ধ হবে তারাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এটি একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। ঐক্য সবসময় অনৈক্যের উপর বিজয়ী। এই সত্যটিই আল্লাহ তাঁর কিতাবে বলে দিয়েছেন এবং মো’মেনদের বলেছেন, “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হইও না (সুরা ইমরান ১০৩)।” ঐক্যের শক্তির সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলাম। ইসলামের আগমনের পূর্বে আরবরা নানা গোত্রে বিভক্ত ছিল এবং হানাহানিতে লিপ্ত ছিল। রসুলাল্লাহ (সা.) তাদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি উম্মাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই ঐক্যই আরবদের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। কোর’আনে ঐক্যকে ‘সীসাগলা প্রাচীরের মতো’ দৃঢ় বলে উল্লেখ করা হয়েছে (সুরা সফ ৪) এবং যারা ঐক্য নষ্ট করে, তাদের নিন্দা করা হয়েছে।

সুতরাং ইতিহাস, ধর্ম ও বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, ঐক্যই হচ্ছে প্রকৃত শক্তি। অনৈক্য সর্বদা দুর্বলতা ও পতনের কারণ। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে ঐক্যের মাধ্যমে একটি জাতি বিজয় অর্জন করেছে।

ঐক্যের এই চেতনাই আমরা দেখতে পাই আরবের জাহেলিয়াত যুগের সমাজে, যেখানে রসুলাল্লাহ (সা.) বিভক্ত ও সংঘাতপূর্ণ গোত্রসমূহকে একত্র করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তোলেন। এই ঐক্যই ইসলামের অগ্রগতির মূল শক্তি ছিল। এজন্যই আল্লাহ তা’আলা মো’মেনদের জন্য দৈনিক পাঁচবার একজন ইমামের নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে মসজিদে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রেখেছেন। এটি জাতির ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল থাকার একটি প্রশিক্ষণ। সপ্তাহে একদিন জুমার নামাজের ব্যবস্থা রেখেছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতির সবাই একত্রিত হবে। বছরে একবার হজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা কাবা ঘরে জমায়েত হবে। যেখানে ভাষা, জাতি, অঞ্চলভেদে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আল্লাহ এই প্রক্রিয়াগুলো রেখেছেন। এর পাশাপাশি কিছু প্রতীকীও রাখা হয়েছে যেগুলো মুসলমানদের জাতীয় ঐক্য বুঝায়। যেমন: কাবা ঘর। এটি মুসলমানদের জন্য ঐক্যের প্রতীক। আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ করো, আমি কাবা ঘরকে মানুষের জন্য পুনঃপুন আগমনের স্থান ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল করেছিলাম।” (সুরা বাকারা ২১৫)।

আজ প্রায় দুইশো কোটি মুসলমান, পঞ্চান্নটিরও বেশি রাষ্ট্র এবং বিশাল প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও দুর্বল। মুসলিম সম্প্রদায় আজ প্রায় আট কোটি উদ্বাস্তু নিয়ে যুদ্ধ ও দাঙ্গার শিকার। ফিলিস্তিনে চলছে ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যা। এসবের মূল কারণ তাদের অনৈক্য। ঐক্যের অভাবে মুসলমানরা আজ পরাধীনতা ও শোষণের শিকার। এখন মুসলমানদের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল- এই বিশাল জাতিকে ঐক্যের ছায়ায় কে নিয়ে আসবে? কে হবে ঐক্যের নেতা? এটাই আজ সময়ের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। [যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭৮৩৫৯৮২২২]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...