রুফায়দাহ পন্নী:
প্রশ্ন: নারী সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় দল তীব্র সমালোচনা করছেন এবং কমিশন বাতিলের দাবি তুলছেন। এই বিষয়ে হেযবুত তওহীদের অবস্থান কী?
উত্তর: শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্বে গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি সংস্কার প্রস্তাবনা প্রতিবেদন জমা দেন যার নাম ছিল “নারীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণে আইনি সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশমালা”। কমিশনের কিছু প্রস্তাব নিয়ে, বিশেষ করে পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় বিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং কিছু রাজনৈতিক দল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাবনাগুলোকে ধর্মবিরোধী ও সংবিধানবিরোধী আখ্যা দিয়ে কমিশন বাতিলের দাবি জানায়। অপরদিকে নারী অধিকারকর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা এই সংস্কারগুলোকে নারীর সমতা ও স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণমাধ্যমে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।
পারিবারিক আইন:
বিয়ে, তালাক ও সন্তানের ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই কমিশন মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান পারিবারিক আইন সংস্কারের পরিবর্তে সব ধর্মের নারীদের জন্য একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ একটি সাধারণ সামাজিক অধিকার যেন ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নারীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হয়- এই লক্ষ্যেই কমিশন অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই প্রস্তাবকে ইসলামি শরিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে ধর্মীয় সংগঠনগুলো তীব্র আপত্তি জানিয়েছে এবং কমিশন বাতিলের দাবি তুলেছে। একইভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারাও তাদের ধর্মীয় আইন সংশোধনের এখতিয়ার এই কমিশনের নেই বলে স্পষ্টভাবে আপত্তি জানিয়েছেন।
উত্তরাধিকার আইন:
কমিশন নারীদের পিতার সম্পত্তিতে ৫০ শতাংশ অধিকার এবং ধর্মীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাব করেছে। এই বিষয়েও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো তীব্র আপত্তি জানিয়েছে, কারণ তারা বিদ্যমান ধর্মীয় বিধান অনুসারে উত্তরাধিকার পদ্ধতি বজায় রাখতে চান যেখানে মুসলিম নারী পুত্র সন্তানের অর্ধেক সম্পত্তি পেয়ে থাকে।
যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি:
কমিশন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ)-এর সনদ ১৮৯ ও ১৯০ অনুসারে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তবে এই প্রস্তাব ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে এবং এর বাতিলের দাবি ওঠে। হেফাজতে ইসলাম ২০২৫ সালের মে মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামীও যৌনকর্মীদের শ্রমিক মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাবকে কঠোর সমালোচনা করেছে। তারা কমিশনের প্রতিবেদন বাতিলের দাবি জানিয়েছে এবং আদালতে রিট আবেদন করেছে।
অন্যদিকে নারী অধিকারকর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা এই প্রস্তাবনাকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন। তারা বলেন, যৌনকর্মীদের শ্রমিক মর্যাদা না দেওয়া হলে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত থাকবেন। এই মর্যাদা তাদের স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, যা মানবাধিকার রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেছেন, “আমাদের অনেক সুপারিশ নিয়ে অনেক বাধা আসবে, কিন্তু আমরা সেই বাধা মোকাবিলায় প্রস্তুত।”
হেযবুত তওহীদের অবস্থান:
আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে- ইসলামে নারী নীতি অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং ভারসাম্যপূর্ণ। এখানে কোনো ধোঁয়াশা নেই, কোনো পক্ষপাত নেই, কোনো জুলুম নেই। আল্লাহর আইনই ইনসাফপূর্ণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ। আমাদের মতে, এই কমিশনের সদস্যরা পাশ্চাত্য দর্শনে প্রভাবিত। তারা সমাজে ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর আচরণ দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ধর্ম সম্পর্কে, বিশেষত ইসলামের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে না জেনে তারা ধারণা করছেন- ইসলাম রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে নারীদের উপর নির্যাতন বাড়বে, তাদের অধিকার খর্ব হবে।
আমরা তাদের এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল মনে করি। হেযবুত তওহীদের স্পষ্ট বক্তব্য- আল্লাহ ও রসুলের যে প্রকৃত ইসলাম তা আজ হারিয়ে গেছে। সেই প্রকৃত ইসলাম যদি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে কোনো নারী নীতি সংস্কারের প্রয়োজনই থাকবে না।
যৌনকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা দিলেই তাদের অধিকার সংরক্ষিত হবে এটা একটি চরম ভুল ধারণা। কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই তাদের কল্যাণ চায়, তাহলে তাদের দেহ ব্যবসার মতো একটি মর্যাদাহানিকর ও শোষণমূলক পেশা থেকে ফিরিয়ে এনে তাদেরকে সুস্থ, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে হবে। আমরা দেখি যে মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্র ও বেসরকারি খাতে অসংখ্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তাদের চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন, কাউন্সেলিং, মানসিক স্বাস্থ্য পুনর্বাসন কার্যক্রম, আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ, পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আর্থিক প্রণোদনা প্রদান প্রভৃতি। শুধু চিকিৎসা নয়, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে দিতেও ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হয়। যৌনকর্মীরা মাদকাসক্তদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম এবং তারা সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবমাননাকর পরিস্থিতিতে জীবন কাটায়। তবুও, তাদের জন্য পুনর্বাসন বা বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
এই প্রেক্ষাপটে এই কদর্য পেশাকে বৈধতা দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেয়ে প্রয়োজন হলো তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানসিক সুস্থতা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে একটি সম্মানজনক জীবনে ফিরিয়ে আনা। এমন একটি অসুস্থ জীবনযাপনকে “শ্রম” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা কোনোভাবেই মানবিক, নৈতিক বা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আমরা মনে করি যারা একে বৈধতা দিতে চায় তারা আসলে তাদের দুর্দশামোচনের সামাজিক দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে।
সংক্ষেপে বললে, ইসলাম কখনো নারীদের সঙ্গে বৈষম্য করে না। নারীদের মুক্তির জন্য প্রস্তাবিত নারী নীতির বিরোধিতাকারী আলেম ওলামাগণ গতানুগতিক পথে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করছেন। আমরা বলব, এ পথে না গিয়ে, সত্যিকার অর্থে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদের পথে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। একজন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করলেই নারীদের প্রকৃত মুক্তি আসবে।