হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

গাজার গণহত্যা ও আরব নেতাদের লজ্জাহীন নীরবতা

হাসান মাহ্দী:
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে করুণ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে গাজাবাসী। গাজায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ধ্বংসযজ্ঞ ইতিহাসের ঘৃণ্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। প্রায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে গাজায়। এখন প্রতি ১৫ মিনিটে গড়ে একটি করে শিশু মারা যাচ্ছে ইসরায়েলের হামলায়। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অগণিত পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জন, বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান কিংবা প্রতিবেশী। ধ্বংস হয়েছে গাজার প্রায় প্রতিটি বসতবাড়ি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ, বাদ যায়নি কিছুই। এইসব ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে অজস্র শিশুর প্রাণ। ইসরায়েলের বর্বর হামলায় গাজা এখন বসবাসের অনুপযোগী এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজার এই ধ্বংসস্তূপ সরাতে লাগবে কমপক্ষে ২১ বছর এবং খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি ডলার। যারা বেঁচে থাকার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে তাবুর মধ্যে আছেন সেখানেও হামলা চালানো হচ্ছে। অনেকে এখন খোলা আকাশের নিচে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘের ত্রাণের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও অনেকে খাবার পাচ্ছে না। আর সেই হতভাগা মানুষগুলোর ওপরেও হামলা করছে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী। এমন বর্বরতা, এমন নিষ্ঠুরতা ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ গণহত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদরাও ইসরায়েলের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে মুখ খুলছে। বিশ্বের নামকরা সব আন্তর্জাতিক সংস্থা স্পষ্ট ভাষায় বলছে- ইসরায়েলের এই আক্রমণ একটি “গণহত্যা”। ইসরায়েল মানবতা, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকাশ্যে লঙ্ঘন করছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- এই বিভীষিকাময় দৃশ্যের মধ্যেও আরব নেতাদের দৃশ্যমান কর্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বিশ্বজুড়ে যখন গাজার জন্য সমবেদনার ঢল, তখন আরব বিশ্বের নেতারা কেমন যেন নির্বিকার। তাদের চেহারায় নেই কোনো উদ্বেগ। নেই গাজার জন্য কোনো প্রতিবাদ, কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। তাদের এমন আচরণ দেখে মনে হয় -তারা যেন ইসরায়েলের এই গণহত্যাকে নীরবে সমর্থন দিচ্ছেন।

আমরা জানি, আরব রাষ্ট্রগুলো তেল সম্পদে ভরপুর। তাদের হাতে বিপুল অর্থ আছে। তাদের যদি সদিচ্ছা থাকত, তারা চাইলেই গাজাকে সহায়তা করতে পারত, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারত কিন্তু তারা তা করছে না। তারা ব্যস্ত লন্ডন, প্যারিস, লাসভেগাসে আমোদ-প্রমোদে। একদিকে মুসলমান ভাই-বোনদের ধ্বংস হচ্ছে ঘর-বাড়ি, মরছে শিশু ও নারী, অন্যদিকে আরব শাসকরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহযোগিতা নিচ্ছেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে। সে অস্ত্র শিয়া-সুন্নি একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রায় ১৪২ বিলিয়ন (১৪ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের অস্ত্র চুক্তি হয়েছে। আগামী মাসগুলোতে তা বেড়ে ১ ট্রিলিয়ন (এক হাজার বিলিয়ন) ডলারে উন্নীত হবার কথাও বলা হচ্ছে। যারা ইসরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে, যাদের তৈরি বোমায় শিশুরা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তাদের সাথেই আরব নেতাদের দহরম-মহরম নিজেদের বাদশাহী ধরে রাখার স্বার্থে। গাজার ধ্বংসলীলা, রক্তাক্ত শিশুর কান্না, লাশের সারি -তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তারা শুধু নিজেদের ক্ষমতা, বিলাসিতা আর রাজসিক জীবনযাপন নিয়েই ব্যস্ত। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে- গাজা ইস্যুতে আরব নেতারা কেন নীরব ভূমিকায়?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় প্রাগ-ইসলামিক যুগে। ইতিহাস বলে, সেই সময় আরবরা গোত্রে গোত্রে বিভক্ত ছিল। হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর রক্তপাত ছিল তাদের সংস্কৃতি। হিংসা-প্রতিশোধ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। সেই বিভক্ত আরবদের একত্রিত করেছিলেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাদের এক জাতিতে পরিণত করে বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। রোম ও পারস্যের মতো শক্তিশালী সভ্যতাকে হারিয়ে ইসলামের বিজয় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বজুড়ে, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশাল এক যোদ্ধা জাতি। কিন্তু সেই আদর্শ, সেই নির্দেশ এখন আর কোথাও নেই। আজকের আরব নেতারা ভুলে গেছেন তাদের ইতিহাস, ভুলে গেছেন উম্মতে মোহাম্মদী চরিত্র, ভুলে বসেছেন সীসা ঢালা প্রাচীর ন্যায়ের ঐক্য। তারা ভুলে গেছেন আল্লাহর নির্দেশ -“যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো।” তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় এখন চরম ভোগবাদিতার পথে হাঁটছেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আদর্শকে জলাঞ্জলি মেতে আছেন ভোগবিলাস আর ক্ষমতার লালসায়। কারণ তারা জানেন যদি পশ্চিমাদের বিরাগভাজন হন, তাহলে তাদের ক্ষমতা থাকবে না। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে পশ্চিমারা তাদের বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। তাছাড়া, তাদের বিশাল খনিজ সম্পদ আর তেল বাণিজ্য তাদের বিলাসিতার জোগান দেয়, তা রক্ষা করতেই তারা চুপ।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন -আজকের আরব বিশ্ব মূলত তাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। মিসর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইরাক, সৌদি আরব- এদের অধিকাংশই এখন একেকটি ক্ষমতা-কেন্দ্রিক রাষ্ট্র। তারা জনগণের চিন্তা নয়, নিজেদের সিংহাসন রক্ষায়ই তাদের মন নিবিষ্ট। একজন ফিলিস্তিনি মানবাধিকার কর্মী বলেছেন -“আরবদের হাতে অঢেল তেল, অগণিত অর্থ। তবু তারা কিছুই করছে না। তারা লন্ডন, প্যারিসে রাত কাটায় বিলাসিতায়। যে অর্থে তারা একরাত আনন্দ করে, সে অর্থ দিয়েই হাজারো ফিলিস্তিনিকে পুনর্বাসন করা সম্ভব ছিল।” তার মতে, “এখন আর আরবদের কাছ থেকে সহায়তা আশা করাও বোকামি।” এই কথা নিছক হতাশার প্রকাশ নয়, বরং আরব নেতৃত্বের ব্যর্থতা, স্বার্থপরতা এবং নৈতিক পতনের দলিল।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...