মোখলেছুর রহমান সুমন:
বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদের উপর অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দুনিয়ার সব মানুষের জন্য মানবাধিকারের আইন প্রযোজ্য, কিন্তু মুসলমানের জন্য নয়। যদি তাই না হতো, তাহলে ঈদের মতো একটা উৎসবের দিনেও গাজায় নিরীহ বেসামরিক মানুষকে প্রাণ দিতে হতো না, ইসরায়েলকে এই অন্যায়ের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে জবাব দিতে হতো। যদি মুসলমানের মানবাধিকার বলতে আসলেই কিছু থাকতো তাহলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একার ভেটোতে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাতিল হয়ে যেত না, বরং বাকি সব দেশ মিলে যুক্তরাষ্ট্রের টুটি চেপে ধরতো। গাজা উপত্যকায় আজকে যা ঘটছে, তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর ঘটলে দুনিয়ায় ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতো, যুদ্ধও লেগে যেতে পারতো। কিন্তু ওই যে বললাম, সবার জন্য মানবতা ও মানবাধিকার প্রযোজ্য, ব্যতিক্রম শুধু মুসলমান।
আজকে সারা বিশ্বে মুসলিমদের ভাগ্যবদলের জন্য কাজ করে যাচ্ছে হাজারো সংগঠন। কোনোটা রাজনৈতিক, কোনোটা অরাজনৈতিক। কোনোটা নিরস্ত্র, কোনোটা আবার সশস্ত্র। কিন্তু ফল কই? ২০০০ সালের মুসলিমবিশ্ব, আর আজকে ২০২৫ সালের মুসলিমবিশ্ব, পার্থক্য কই? এই ২৫ বছরে চেষ্টা তো কম হয় নি। তাহলে আল্লাহর সাহায্য কই?
এই যে বললাম, আল্লাহর সাহায্য কোথায়, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। এককালে মুসলিমরা বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্বের জায়গায় ছিল। সেখান থেকে নিজেদের কৃতকর্মের দরুন ধীরে ধীরে তাদের পতন ঘটে। সর্বশেষ বৃটিশ, ফরাসি, পর্তুগীজ তথা ইউরোপীয়দের কলোনিতে পরিণত হয় মুসলিম ভেল্ট। এরপর মুসলিমরা আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি।
এই মেরুদণ্ড ভাঙ্গা মুসলিম জাতি আর কখনো আর সোজা হতেও পারবে না, যদি না তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য পায়। যতক্ষণ না আল্লাহ নিজে করুণা করে তাদেরকে জুলুমের থেকে মুক্ত করেন, ততদিন তাদের মুক্তি নেই। কিন্তু আল্লাহ কেন তাদেরকে সাহায্য করবেন? এখানে আল্লাহর দায় কোথায়? আমরা মুসলিমরা কী এমন পূন্যের কাজ করেছি যার প্রতিদানে তিনি নিজের হাতে আমাদেরকে উদ্ধার করবেন?
হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বহুবার মুমিনদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তিনি একথাও বলেছেন, মুমিনদের হাতে সারা দুনিয়ার নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, খেলাফত তুলে দিবেন। কাফিরদের বিরুদ্ধে মুমিনরা মোকাবেলা করলে তিনি মুমিনদেরকে বিজয়ী করবেন। তিনি নিজেকে মুমিনদের ওয়ালী বা অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। একজন অভিভাবক হিসেবে মুমিনদেরকে রক্ষা করা, তাদেরকে উদ্ধার করা, তাদেরকে সমৃদ্ধ করা, অবশ্যই আল্লাহর দায়িত্ব। কিন্তু যে মুমিনদের উদ্দেশে আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের ওয়ালী, আমি তোমাদেরকে বিজয়ী করবো, তোমাদেরকে দুনিয়ায় খেলাফত দিব, আখেরাতে জান্নাত দেব, আমরা কি সেই মুমিন?
আপনি পবিত্র কোরআনের অনুবাদ যদি ভাসাভাসাও পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি দেখবেন, সেখানে আল্লাহ তাআলা একদিকে রোজা, নামাজ, হজ্ব, যাকাতসহ সকল আমলের নির্দেশ দিয়েছেন মুমিনদের উদ্দেশে। অন্যদিকে দুনিয়াতে বিজয় আর খেলাফতের প্রতিশ্রুতি এবং পরকালে মুক্তির নিশ্চয়তাও তিনি দিয়েছেন ওই মুমিনদেরকেই। সেই মুমিন কারা? এটাই সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন।
আজকে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছি, দুনিয়ার ২০০ কোটি মুসলমান ভাবছেন, তারা জন্মগতভাবেই মুমিন-মুসলিম। বাবার নাম আব্দুল্লাহ, আমার নাম সাইফুল্লাহ। সুতরাং আমি মুমিন বা মুসলিম। আসলেই কি বিষয়টি এমন?
পবিত্র কোরআনে সুরা হুজরাতের ১৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই মুমিনদের পরিচয় বা সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুমিন তো তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর কোনো সন্দেহ পোষণ করেন না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম (জিহাদ) করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।”
এখানে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান বলতে বুঝায়- কলেমার ঘোষণা,“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)”, যার অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা হুকুমদাতা নাই, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক। “আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না”- এটা ঈমানের প্রথম ঘোষণা। সেই ঈমানের কথাই আল্লাহ তাআলা মুমিনের সংজ্ঞায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তারপর বলেছেন, মুমিনরা আল্লাহর এই হুকুমকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম (জিহাদ) করবে। দুনিয়ার সমস্ত হুকুমতকে অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহর হুকুমের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা এবং এই হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা- এই দু’টি গুণ যারা অর্জন করলো, আল্লাহর সংজ্ঞা মোতাবেক তারা মুমিন। এমন ব্যক্তিরা নিজেদেরকে মুমিন বললে বা দাবি করলে আল্লাহর ভাষায় তারা সাদেক (সত্যবাদী)। আর যারা এই দুটি গুণ অর্জন ছাড়াই নিজেদেরকে মুমিন দাবি করে নিঃসন্দেহে তারা ফাসেক (মিথ্যাবাদী)। আজকে আমরা ২০০ কোটি মুসলমান যারা নিজেদেরকে মুমিন-মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয়, আমাদের অবস্থা সেটাই হয়েছে।
যে মুমিনের সংজ্ঞা আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন, রাসুল (স.) নিজে ছিলেন সেই মুমিন। তাঁকে যারা অনুসরণ করেছেন, অর্থাৎ তাঁর সাহাবীরাও ছিলেন মুমিন। তাঁরা রাসুলুল্লাহকে (স.) নিজেদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর নেতৃত্ব পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। দুনিয়াময় আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা ঘর ছেড়েছেন, ভিটেমাটি ছেড়েছেন, দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়েছেন। স্ত্রী-পরিবার, ক্ষেত-খামার, সহায়-সম্বল সবকিছু উৎসর্গ করে তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন সত্যিকার মুমিন।
তাঁরা শত্রুর আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন, দেশান্তরিত হয়েছেন। পেটে পাথর বেঁধেছেন, বছরের পর বছর অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন পার করেছেন। তথাপি তাঁরা ইসলামের শত্রুদের কাছে মাথা নত করেন নি। অতঃপর যখন শত্রুকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য অর্জন করেছেন, তখন তাঁরা জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছেন। এক রণাঙ্গন থেকে আরেক রণাঙ্গনে ছুটে গিয়েছেন। পিতার সামনে পুত্র শহীদ হয়েছেন, পুত্রের সামনে পিতা শহীদ হয়েছেন। তাঁরা অশ্রুবিসর্জন না করে আল্লাহ পাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছেন। শহীদ স্বামীর লাশের পাশে স্ত্রী আহাজারি না করে বরং শহীদের স্ত্রী হতে পেরে গর্বিত হয়েছেন। এই ছিল মুমিনদের চরিত্র। আর এমন মুমিনদের সাথেই আল্লাহ পাকের ওয়াদা। সেই ওয়াদা মোতাবেক তিনি তাদেরকে দুনিয়াতে বিজয়ী করেছিলেন। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে টিকতে পারে নি।
ঠিক আজকে আমরাও যদি অনুরূপ মুমিন হতে পারি, যদি একজন নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, ওই নেতার নেতৃত্বে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে পারি, তাহলে আমাদের জন্যও বিজয় অবধারিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য অবধারিত। কারণ আল্লাহজ মুমিনদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি ভুলে যান নি।
আল্লাহ ভুলেন নি, কিন্তু আমরা কি নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত? ব্যক্তিগত আমল আর মসজিদ-মাদ্রাসায় কমবেশি দান-খয়রাত করেই যখন আমরা মোল্লা-মুন্সীদের তাদের কাছ থেকে জান্নাতের সার্টিফিকেট পেয়ে যাই, তখন কি আসলে এত কিছু করার প্রয়োজন আছে? হ্যাঁ, আমাদেরকে গোড়াতেই হত্যা করা হয়েছে। আর কাজটা করেছেন, এই দীনেরই একদল পণ্ডিত-পুরোহিত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।