রাকীব আল হাসান:
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, মানুষ দুই প্রকার- মো’মেন ও কাফের (সুরা তাগাবুন ২)। কারা মো’মেন আর কারা কাফের তার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা কি আমাদের জানা আছে? প্রকৃতপক্ষে আমরা অনেকেই এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানি না। আজকে আমরা অন্য কোনো দলিল নয়, সরাসরি কোর’আন থেকে জানব আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা মোতাবেক কারা মো’মেন আর কারা কাফের।
বর্তমান বিশ্বে আমরা প্রায় ২০০ কোটির জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে মো’মেন ও মুসলিম বলে বিশ্বাস করি। আমরা অনেকে মনে করি একটু পরহেজগার মুসলিমরাই হচ্ছে মো’মেন। নিজেদেরকে মোমেন ও মুসলিম বলে বিশ্বাস করার কারণেই আমরা আমরা ইহকালে আল্লাহর দয়া ও পরকালে জান্নাত আশা করি। কিন্তু আসলেই কি আমরা মো’মেন? আসুন জেনে নেওয়া যাক- কোর’আনের আলোকে কে মো’মেন, কে মুসলিম, কে কাফের আর কে মোশরেক।
মো’মেন কে?
মো’মেন শব্দটি এসেছে ‘ঈমান’ শব্দ থেকে। ঈমান শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘বিশ্বাস’। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী- আল্লাহ, নবী-রসুলগণ, ফেরেশতাকূল, আসমানি কিতাবসমূহ, তকদির, কিয়ামত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসকেই বলা হয় ঈমান। আর যারা এসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখে তারাই হচ্ছে মো’মেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? না। এই সবকিছু বিশ্বাস করেও একজন মানুষ কাফের হতে পারে, যেমন কাফের হয়েছিল আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগের আরবরা। কীভাবে ব্যাখ্যা করছি।
ঈমানের প্রথম ঘোষণাই হচ্ছে আল্লাহর তওহীদের ঘোষণা অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, এর সঙ্গে সমসাময়িক নবী-রসুলের নাম। একে আমরা কলেমা বলে থাকি। এই কলেমার অর্থ আমাদেরকে বাল্যকাল থেকে শেখানো হয়েছে- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ বা উপাস্য নেই’। কিন্তু খেয়াল করুন- ‘উপাস্য’ শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘মাবুদ’। কলেমা বা তওহীদের ঘোষণায় ‘মাবুদ’ শব্দটিই নেই, বরং রয়েছে ‘ইলাহ’ শব্দটি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- ইলাহ বলতে কী বুঝায়?
আরবি ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে- হুকুমদাতা, বিধানদাতা, সার্বভৌমত্বের মালিক।
একটু বিস্তারিতভাবে বললে, ‘ইলাহ’ হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যার হুকুম মানতে হবে; যার হুকুম অনুসারে ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনীতিক কাঠামো, আইন-আদালত ইত্যাদি সমস্ত কিছু পরিচালিত হবে।
সুতরাং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই।’ এটাই আল্লাহর তওহীদের ঘোষণা, একত্ববাদের ঘোষণা। স্রষ্টা একজন আছেন এই বিশ্বাস থাকার অর্থ তওহীদ নয়, বরং সেই স্রষ্টার আনুগত্য করার ঘোষণাই হচ্ছে মো’মেন হওয়ার পূর্বশর্ত। একজন মো’মেন ব্যক্তি এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার জীবনে একমাত্র বিধান হিসেবে আল্লাহর বিধানকে আলিঙ্গন করে নেন এবং অন্য সমস্ত বিধানকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু পৃথিবীতে যদি আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিতই না থাকে তাহলে তিনি আল্লাহর বিধান মানবেন কী করে? তাই তওহীদের ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম (জিহাদ) করাও মো’মেন হওয়ার শর্ত। তাই মো’মেনের সংজ্ঞা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে – মো’মেন তো কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমান এনেছে, এতে আর কোনো সন্দেহ পোষণ করেনি এবং জীবন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ (সংগ্রাম) করেছে, তারাই সত্যনিষ্ঠ। (সুরা হুজরাত ৪৯:১৫)।
সুতরাং মো’মেন হতে হলে একজন মানুষকে দুটো শর্ত পুরন করতে হবে:
তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে হুকুমদাতা (ইলাহ) হিসেবে মানবেন না।
আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করবেন।
কাফির কে?
খুব সহজভাবে বলতে গেলে, মো’মেনের এই সংজ্ঞায় যারা নেই তারাই কাফের। কারণ মানুষ তো মাত্র দুই প্রকার যা শুরুতেই বলেছি। তারপরও আল্লাহ কাফেরের সংজ্ঞা স্পষ্টভাষায় আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা অনেকে মনে করি যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, ইসলামবিদ্বেষী বা যারা মুসলিম না তারাই কাফির। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। বরং আল্লাহকে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি বা একটি জনগোষ্ঠী কাফিরে পর্যবসিত হতে পারে যদি তারা আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে। আল্লাহর হুকুম কিন্তু কেবল নামাজ রোজা করা নয়। তিনি মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি এক কথায় তার সমগ্র জীবন কীভাবে চলবে সকল বিষয়েই হুকুম বিধান দিয়েছেন। মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর হুকুম (নামাজ, রোজা ইত্যাদি) পালন করেও, জাতীয় জীবনের হুকুমগুলো প্রত্যাখ্যান করলে সে কাফের হয়ে যাবে। অর্থাৎ জীবনের যে কোনো অঙ্গনে আল্লাহর হুকুম যারা প্রত্যাখান করবে, আল্লাহকে ইলাহ (হুকুমদাতা) হিসেবে অস্বীকার করবে, তারা আল্লাহর কাছে কাফির হিসেবে বিবেচিত হবে, তাদের ধর্ম পরিচয় যেটাই হোক না কেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা নিজে বলেছেন- ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান দিয়ে ফয়সালা দেয় না তারা কাফির।’ (সুরা মায়িদা : আয়াত-৪৪)
মুশরিক কে?
‘মুশরিক’ শব্দটি এসেছে ‘শিরক’ থেকে। শিরক মানে হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বা অংশীদার করা। শিরক বলতে আমরা সাধারণত বুঝি- একদিকে আল্লাহর উপাসনা করা, অপরদিকে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে তারও উপাসনা/আরাধনা করা। কেউ এমনটা করলে সে অবশ্যই শিরক করলো। কিন্তু শিরক কেবল এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যারা কিছু ব্যাপারে আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে মানলো আর কিছু ব্যাপারে মানুষের তৈরি হুকুম বিধান মানলো তারাও শিরক করল অর্থাৎ মুশরিক হয়ে গেল। এদের ব্যাপারে পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ নিজে বলেছেন- তবে কি তোমরা কিতাবের (অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমের) কিছু অংশ মানো আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করো? তোমাদের মধ্যে যারা এমনটা করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কেয়ামতের দিন তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। (সুরা বাকারা : আয়াত-৮৫)। সুতরাং মুসলিম দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র দুনিয়ায় আমরা কেন লাঞ্ছিত অপমানিত হচ্ছি তার কারণ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
সুধী পাঠক, এবার আসুন আমরা দেখি বর্তমানে আমরা কার হুকুম মেনে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করছি।

অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনের সামান্য আমল-আখলাকের বাইরে অন্য সকল ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করেছি। কোর’আনের বিধান প্রত্যাখ্যান করে আমরা মানুষের তৈরি বিধান দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, আইন-আদালত, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছু পরিচালনা করছি। অর্থাৎ আল্লাহকে ইলাহ বা হুকুমদাতার জায়গা থেকে সরিয়ে আমরা মানুষকে হুকুমদাতার আসনে বসিয়েছি।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে-
আমরা ইলাহ হিসেবে কাকে মেনে নিয়েছি? আল্লাহকে নাকি মানুষকে?
যদি আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে না মানি, তাহলে আমরা কি কলেমার ঘোষণায় (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) অটল রইলাম?
যদি কলেমার ঘোষণায় অটল না থাকি তাহলে কি আমরা মো’মেন রইলাম?
নাকি আল্লাহর দৃষ্টিতে আমরা কাফির ও মুশরিক হয়ে গেলাম?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে একটু চিন্তা করুন। আশা করি উত্তর পেয়ে যাবেন।
সুধী পাঠক, আজকে সারা পৃথিবী অন্যায়-অশান্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠেছে। জুলুম, দুঃশাসন, যুদ্ধ-রক্তপাত, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানিতে ভরে গেছে গোটা বিশ্ব। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়ানক শোচনীয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মানুষ সত্যিকার অর্থে মুক্তি পায়নি। সর্বত্র কেবল দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক হয়রানি, ক্ষমতাবানদের দৌরাত্ম্য, ধনী-গরীবে বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, ক্ষুধা, দারিদ্র্য। অধিকাংশ মানুষের জন্য বউ-বাচ্চা নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতার সঠিক চিকিৎসা দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চারদিকে মানুষের দুর্দশা আর কান্না। এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তি চায়।
কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আজকের এই অসহনীয় পরিস্থিতির কারণ কী? কি কারণে আমাদের এই নিদারুণ পরিণতি?
আমরা হেযবুত তওহীদ বলছি, আমাদের এই করুণ পরিণতির একমাত্র কারণ, আমরা আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ ইসলামের পরিবর্তে মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছি। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি এবং আল্লাহর উপাসনা করি। এভাবে আমরা আল্লাহকেও কিছু বিষয়ে মানি, আবার জাতীয় রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের বিধান পুরোপুরি মানি। এটাই শিরক। আমরা আজকে আল্লাহর সাথে মানুষকে শরিক করার শাস্তি ভোগ করছি। পাশাপাশি আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে কুফর করে আল্লাহর গজবে পতিত হয়েছি। আমাদের ইহকাল ও পরকাল দুটোই ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় আমরা হেযবুত তওহীদ এদেশের প্রত্যেক ইসলামবিশ্বাসী মানুষকে আহ্বান করছি, আসুন আমরা সকলে মিলে আল্লাহর হুকুম বিধান মেনে নেই। আসুন আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, আইন-আদালত, রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ প্রতিটি অঙ্গনে আল্লাহর দেয়া সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করি। একমাত্র হুকুমদাতা আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের আলোকে আমাদের সবকিছু ঢেলে সাজাই। তবেই কেবল আমরা আল্লাহর দরবারে মো’মেন হিসেবে কবুল হবো। তবেই কেবল চলমান সমস্ত অন্যায়, অশান্তি দূর হয়ে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পরকালে আমাদের মুক্তি মিলবে।
প্রিয় পাঠক, আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য রসুলাল্লাহ (সা.) এর দেখানো তরিকায় সংগ্রাম করে যাচ্ছে কেবল হেযবুত তওহীদ। ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আসুন আমরা সবাই সামিল হই। আসুন আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা মোতাবেক নিজেরা মোমেন হই এবং এই অশান্তিপূর্ণ সমাজকে শান্তিময় করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করি।
(লেখক: খতিব, শহীদী জামে মসজিদ, সোনাইমুড়ী নোয়াখালী। যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭৮৩৫৯৮২২২]