Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

রাজ্যপরিচালনাই যখন ধর্ম


Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36
44ইলিয়াস আহমেদ

একদিন ক্লাসের শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?” ছাত্র-ছাত্রীদের সবার উত্তর ছিল এরকম – কেউ হবে ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ পাইলট, কেউ শিক্ষক, কেউ পুলিশ, কেউ উকিল, কেউ ব্যারিস্টার, কেউ ব্যবসায়ী ইতাদি। কিন্তু ভুল করেও কেউ বলে নি, “সার, আমি বড় হয়ে রাজনীতিক নেতা হব। দেশ পরিচালনার ভার নিব।” ছেলে সরকারি বিশ্ববিদালয়ে চান্স পেয়েছে। বিশ্ববিদালয়ের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ার আগে বাবা-মা বারবার ছেলেকে মনে করিয়ে দেন, “বাবা, ভালো করে মন দিয়ে লেখাপড়া করিস। সাবধান! কোনো রাজনীতিতে জড়াস না কিন্তু।”
রাজনীতি নিয়ে এই হলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু এমনি এমনিই তৈরি হয় নি। একজন ধর্মনেতাকে (আলেম/পীর) মন থেকে যতটা ভক্তি ও শ্রদ্ধা দিয়ে দেখা হয় ঠিক তার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই দেখা হয় রাজনীতিক নেতাদের। প্রকাশ্যে রাজনীতিক নেতাদের প্রতি গদ-গদ, নম-নম ভাব থাকলেও, অন্তরালে থাকে ততটাই হৃদয়ভরা ঘৃণা। তাই বলে সৎ, দক্ষ রাজনীতিক নেতা আমাদের দেশে যে নেই, তা কিন্তু নয়। আছে, তবে তারা সংখ্যায় এতই কম যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশকালে অনেকেই সততা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে রাজনীতি করতে চাইলেও কিছুদিন না যেতেই স্বার্থপরায়ণ হয়ে যান। বাকা পথে গাড়ি কখনো সোজা চলে না।
তত্ত্বে যা-ই থাক, বাস্তবে রাজনীতি আজ স্বার্থোদ্ধারের সবচেয়ে বড় সিঁড়ি আর নির্বাচনের মৌসুমটাই ক্ষমতালিপ্সুদের মাহেন্দ্রক্ষণ। আজকে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতি তথা রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে মানবসেবার সাথে জড়িত তারা সবাই বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সুরম্য ফ্লাট-বাড়ি, দামি দামি গাড়ি, জীবনে লেটেস্ট প্রযুক্তির সমাহার, পোষাক-আশাক, স্ত্রী-কন্যার চেহারায় আভিজাত্যের চেকনাই, গায়ে ভরি ভরি স্বর্ণের গহনা, পুত্রের ধরাকে সরাজ্ঞান। নামে-বেনামে জায়গা, জমি, গাড়ি, বাড়ি করে এলাহি কারবার কিন্তু সম্পদের উৎস কী এ প্রশ্ন উঠলে দিশেহারা-বেগতিক অবস্থা দাঁড়ায়। আসলে সব করছেন জনগণের অর্থে। প্রজার অধিকার কুক্ষিগত করে দিনের পর দিন রচিত হচ্ছে রাজাদের রাজনীতিক প্রহসন। ফলে সাধারণ মানুষের মন-মস্তিষ্কে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে, রাজনীতি মানেই নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের জনগণকে শান্তি দেওয়ার নামে স্বার্থোদ্ধারের কলাকৌশল (ঞৎরপশ); জ্বালাময়ী ভাষণ, প্রতিশ্র“তি প্রদান, আমজনতার জন্য হঠাৎ করে দরদ উথলে উঠা, দেশপ্রেমে কেঁদে ফেলা – এসবই ছলাকলা। আসলে সত্যিটা কী? রাজনীতি কি তাহলে ধর্মের বিপরীত, অর্থাৎ অধর্ম?
পৃথিবীতে মানুষজাতির সূচনালগ্ন থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচার উদ্দেশ্যে মানুষের মধ্যে ন্যায়-নীতির মানদণ্ড, ঐক্য-শৃঙ্খলা-আনুগত্য, আত্মা ও দেহের ভারসাম্য হিসেবে প্রয়োজন ছিল একটা প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা। যে গোত্রে বা জাতিতে ন্যায়-নীতির মানদণ্ড নেই অর্থাৎ অপরাধ-অন্যায়ে ভরপুর; যে গোত্রে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য, শৃঙ্খলার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা, পরস্পর সম্মান-ভালোবাসা-দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ অর্থাৎ আনুগত্যের পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারিতা-অহমিকা-ঘৃণা-অবাধ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই গোত্র বা জাতি কখনোই প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানও তাই বলে, ইতিহাস ও যুক্তিও এটাই প্রমাণ করে। আজও পৃথিবীর অনেক দেশে, অনেক অঞ্চলে এমন কি আমাদের দেশেও এমন কিছু সম্প্রদায় হরহামেশায় দেখা মেলে যারা বর্তমান সভ্যতার তেমন স্পর্শ পায় নি – আমাদের রাষ্ট্রে থেকেও তারা নিজেরাই অন্য এক সমাজের, অন্য এক গোত্রের দাবিদার, যে গোত্রে রয়েছে প্রাচীন মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির জলবায়ু। তাদের আর আমাদের অর্থাৎ প্রজাদের প্রাত্যহিক রুটিন ও চালচলনে যথেষ্ট ফারাক। আমরা যখন অত্যাধুনিক পোশাক-আশাক পরে নাগরিক সভ্যতার বুকে আঁচড় কেটে চলেছি, তখন ঐ নির্দিষ্ট গোত্রের মানুষগুলো তাদের যাবতীয় চাহিদা মেটাতে এখনো প্রকৃতির উপরই নির্ভর করছে, তারা নানাভাবে আজও আদিম সমাজের সাক্ষ্য বহন করে। আদিম সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে আঁকড়ে ধরার কারণেই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক আমরা এই সম্প্রদায়টিকে আদিবাসী বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যদিও অনেক অঞ্চলের এই সম্প্রদায়টির অনেকেই তথাকথিত ‘আধুনিক’ সভ্যতার নাগালে আসতে শুরু করেছে কিন্তু তাঁদের প্রসঙ্গ এখানে টেনে আনার কারণ হলো- আমরা যদি খুব গভীরভাবে এই সম্প্রদায়গুলোর দিকে লক্ষ্য করি তাহলে একই সাথে অনেকগুলো জিনিস দেখতে পাব যা প্রমাণ দিবে – পৃথিবীতে মানুষের সূচনালগ্ন থেকেই একটা জীবনব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছে, যে জীবনব্যবস্থায় ন্যায়-নীতির মানদণ্ড থেকে শুরু করে, গোত্রীয় ঐক্য-শৃংখলা-আনুগত্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ অর্থাৎ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছুর প্রয়োজন তার সবই ছিল। এ জীবনব্যবস্থাগুলো আত্মিক ও দৈহিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, আজকের মতো জড়বাদী ভারসাম্যহীন না। স্রষ্টা যখনই পৃথিবীতে মানুষ প্রেরণ করলেন তখন থেকেই সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনব্যবস্থাও দিলেন। এ জীবনব্যবস্থার মৌলিক বিষয়গুলো সবসময় একই ছিল।
আমরা যে সময়ে বাস করছি সে সময়ের পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তাই নিজস্ব সংস্কৃতি-কৃষ্টি-কালচার বাদে গোত্র-সস্প্রদায় ভেদে আমাদের দেশে পৃথক কোনো আইন নেই। যে দেশে বাস করতে হবে, সে দেশের আইন সবাইকে মেনে চলতে হবে। হোক সে মারমা, হোক সে সাঁওতাল কিংবা পাঙ্গন, হোক সে প্রান্তিক বাঙ্গালি কৃষক।
জীবনব্যবস্থা শব্দটি আজকে অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। কিন্তু রাজনীতি বা পলিটিক্স শব্দটির সাথে সবাই পরিচিত। রাজনীতি আসলে মানুষের সামষ্টিক জীবনব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আদিকাল থেকেই মানবজীবনে রাজনীতি ও ধর্মনীতি একইসাথে ছিল। রাজনীতিই ধর্মনীতি, ধর্মনীতিই রাজনীতি। সেই নীতির বাস্তবিক প্রয়োগের ফলাফল কালের ইতিহাসে কিছু লিপিবদ্ধ আছে, অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অংশই দখল করে আছে রাজতন্ত্র, রাজনীতি শব্দটিও রাজতন্ত্রেরই উত্তরাধিকার। রাজ্যে যখনই অন্যায়-অবিচার-অশান্তি ছেয়ে গেছে, মানুষ যখন ভুলে গেছে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্যের সীমারেখা তখনই স্রষ্টা তাঁর বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন, ভাষাভেদে তাদেরকেই বলা হচ্ছে নবী, রসুল, অবতার, বুদ্ধ, তীর্থঙ্কর, পয়গম্বর, প্রফেট ইত্যাদি। তাঁরা এসে স্রষ্টার দেয়া রাজনীতি অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তৎকালীন রামরাজত্ব, মক্কা-মদীনার মতো স্বর্গরাজ্য। সকল ধর্মের একটি মাত্র উদ্দেশ্য, তা হলো মানুষের সুখ-শান্তি। সেই সুখ শান্তির জন্যই পৃথিবীতে এতো আয়োজন, এতো কষ্ট করছে সবাই। শান্তির জন্যই আজও মানুষ রাজনীতি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
রাজনীতির নীতিমালাগুলো এখন এতোই বৃহৎ পরিসরে লিখা যে তা পড়তে কয়েকদিন লেগে যাবে, এবং সাধারণ মানুষ পড়েও কতটা বুঝতে পারবে সন্দেহ আছে কারণ এ বিষয়ে ভালোভাবে জানতে কয়েক বছর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে রীতিমত ডিগ্রি নিতে হয়। সেটা হচ্ছে তাত্ত্বিক দিক, কিন্তু রাজনীতির বাস্তব দিক বোঝে না এমন লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছে। রাজনীতি বুঝে, রাজনীতি করে এমন লোকের সংখাটাও নেহায়েৎ কম না হওয়া সত্ত্বেও, পৃথিবীর কোথাও এতোটুকুও সুখ শান্তি নেই। কেন?
সেবা আর পণ্য দুটিই আলাদা জিনিস। দুটোর পার্থক্যগত বিষয় হলো বিনিময়। অর্থাৎ সেবার বিনিময়ে কিছু নেয়া হলে সেটা আর সেবা থাকে না, হয়ে যায় পণ্য। ধর্ম এসেছিল মানবতার কল্যাণ তথা মানবসেবার জন্য। উম্মতে মোহাম্মদীর সৃষ্টিই করা হয়েছিল এক বিশাল দায়িত্ব পালনের জন্য। পূর্ববর্তী নবীদের দায়িত্ব ছিল স্বগোত্রে সীমিত, কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব হলো সমগ্র মানবজাতির শান্তিবিধান করা। আল্লাহ সুস্পষ্ট করেছেন জাতির এই লক্ষ্য- “তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ করবে, অন্যায় কাজে বাধা দিবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” (সুরা ইমরান ১১০) প্রতিটা নবী-রসুল সেই মানবতার কল্যাণে আজীবন কাজ করে গেছেন, রাজ্যপরিচালনা তথা রাজনীতিও করে গেছেন। তার বিনিময়ে একটা পয়সাও নেন নি। ধর্মের বিনিময় নিতে আল্লাহ কোর’আনে অনেকবার নিষেধ করেছেন, যেহেতু রাজনীতি ধর্মেরই তথা মানবকল্যাণেরই বৃহত্তম অংশ তাই রাজনীতির বিনিময় গ্রহণও একই নিষেধাজ্ঞার দ্বারা নিষিদ্ধ (সুরা বাকারা ১৭৪, সুরা ইয়াসীন: ২১, সুরা শোয়ারা: ১০৭-১০৯, ১২৪-১২৭ সহ বহু আয়াত)। যেহেতু মানবতার কল্যাণে কৃতকর্মের বিনিময় গ্রহণে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেহেতু মানবসেবা কখনো পণ্য নয়, তাই মানবসেবার বাণিজ্য বড় অধর্ম। যতদিন রাজনীতি সেবারূপে ছিল ততদিন মানুষ সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করেছে। আর যখন থেকে ধর্মব্যবসায়ী ও স্বার্থবাদী রাজনেতৃবৃন্দের আবির্ভাব হয়েছে তখন থেকে সেবা হয়ে উঠে পণ্য। ধীরে ধীরে এই সেবার পরিবর্তে পণ্যবাদই (পড়হংঁসবৎরংস) আজকের চরম কর্পোরেট দুনিয়ার জন্ম দেয়। এখানে প্রতিটা মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কর্পোরেট দুনিয়ার শিকার। জন্ম হয়েছে? আকীকা-অন্নপ্রাসন করতে হবে, মিলাদ পড়াতে হবে, জন্মুকুণ্ডলীর আয়োজন করতে হবে, যজ্ঞ-পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সবকিছুর জন্য টাকা চাই। শিক্ষা অর্জন করতে চাও? টাকা লাগবে। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা। চিকিৎসা চাও? অনেক টাকা লাগবে। মারা গেছ? ব্যস, জানাযা-মিলাদ, চেহলাম-চল্লিশার জন্য টাকা লাগবে। কালক্রমে ধর্মে যখন এভাবে বিনিময় গ্রহণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তখন থেকেই কোনো ধর্মই মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। পারবে কী করে? ঐ যে সেবা আর পণ্য আলাদা জিনিস। সেবা পণ্য হওয়ার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। স্বার্থ যেন এক বিরাট দানবের রূপ নিয়ে পদভারে সমগ্র বিশ্বকে দলিত মথিত করে দিচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় সেবার চাহিদা সৃষ্টি করা হচ্ছে (যেমন শোবিজ তারকাদের সার্বক্ষণিক রূপের প্রদর্শনী দ্বারা রূপচর্চা ও ফ্যাশনের চাহিদা সৃষ্টি), অপ্রয়োজনীয় কথার চাহিদা সৃষ্টি করে মোবাইল ফোন ও কমুনিকেশনকে (আই.সি.টি) সুবিধার তুলনায় অপচয়ের খাতে পরিণত করা ইত্যাদি।
রাজ্য পরিচালনার নীতিই রাজনীতি। আর মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ সমাজে বা রাষ্ট্রে যে নীতির ফলে সমাজবদ্ধ হয়ে, সুসংঘবদ্ধ হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে সে নীতিই তো রাজনীতি। রাজনীতি ছাড়া একটা সুখী-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বা জাতি কখনই কল্পনা করা যায় না। যে নীতি এতো মহান দায়িত্ব তথা আমানতের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই নীতি দ্বারা যারা পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-ইউনিয়ন-পৌরসভা থেকে শুরু করে সমগ্র রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব নিবেন, নিশ্চয় তাঁরা মানবসমাজের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক দায়িত্বগ্রহণকারী। শুধু পৃথিবীতেই নয়, আল্লাহর কাছে তারাই প্রকৃত সম্মানিত ও পুণ্যবাণ ব্যক্তি, তারাই প্রকৃত মোমেন, প্রকৃত ওলি-আল্লাহ, শর্ত হচ্ছে এই কাজ করতে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে অর্থাৎ তারা হবেন সত্যের মূর্ত প্রতিক, তারা কথা-চিন্তা ও কর্মে সত্যনিষ্ঠ হবেন, নিঃস্বার্থ হবেন। কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপস করতে পারবেন না। মানুষের কল্যাণকেই তারা একমাত্র ধর্ম বলে পালন করবেন। মানবসেবার ব্রত ধারণ করে তিনি একটি পয়সাও রাজনীতি থেকে হাসিল করবেন না। মহান আল্লাহ সুন্দর ও সুনিপুণ নীতি দ্বারা সমগ্র বিশ্বজগৎ পরিচালনা করছেন। আর পৃথিবীতে তাঁর মতোই করে নিজেদের পরিচালনা করার জন্য তিনি মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি (খলিফা) করে বানালেন। দাউদ (আ.) কে যখন রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন তখন আল্লাহ তাঁকে রাজ্য পরিচালনার নীতিস্বরূপ কিছু মৌলিক নীতি শিখিয়ে দিলেন। কোর’আনে বিষয়টি এসেছে এভাবে, “হে দাউদ, আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার করো এবং নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত সিদ্ধান্তের (হাওয়াউন) অনুসরণ করো না, কেননা এটা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ পরিতাগ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ, তারা কর্মফলদিবসকে ভুলে রয়েছে।” (সুরা সোয়াদ ২৬)।
এখানে লক্ষণীয়, রাজ্যে সত্য প্রতিষ্ঠার দ্বারা সুবিচার করা, আল্লাহর সিদ্ধান্ত যেখানে আছে সে বিষয়ে তা উপেক্ষা করে নিজের মনগড়া সিদ্ধান্ত প্রজার উপর চাপিয়ে না দেয়ার নীতিই মূলত রাজনীতি। আর যদি এর বিপরীত যেকোনো কিছু যথা দুর্নীতি, ঘুষ, দুঃশাসন, অবিচার, পাশবিকতা, বৈষম্য ইতাদি অন্যায়-অপকর্মের সাথে রাজনীতিক নেতারা জড়িত থাকে সেটা কখনোই রাজনীতি নয়, সেটা অপরাজনীতি, রাজনীতির নামে স্বার্থোদ্ধারের নীতি, এটা আল্লাহর নীতির বিপরীত, এর দ্বারা শান্তি আসে নি, আসবেও না কোনোদিন। এদেরকে লক্ষ্য করেই উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, এদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তাদের শাস্তির কারণ রাজনীতি হলো ধর্মের প্রধানতম অংশ, অত্যন্ত পবিত্র এক দায়িত্ব, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিভূ হিসাবে কাজ করা, যে দায়িত্ব পালন করেছেন নবী-রসুল, অবতার-বুদ্ধগণ। আদম (আ.) থেকে শুরু করে নূহ-মুসা-রামচন্দ্র-কৃষ্ণ-মুহাম্মদ (সা.) সবাই রাজ্য পরিচালনা করেছেন। তাঁদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই ছিল রাজ্যে কীভাবে সুখ আসবে, কী করলে সবার দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। তাই আমরা দেখতে পাই, ধুলোর তখতে বসা রাষ্ট্রপরিচালক মুহাম্মদকে (দ.) মরু-ভাস্করের ন্যায়, যিনি নিঃস্বার্থভাবে কোনো বিনিময় ছাড়াই নিজে অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে সুশাসন-সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিনিয়তই লড়াই করে গেছেন। ঠিক এভাবেই রাজ্যপরিচালনা করে গেছেন আবুবকর-উসমান-উমর-আলী (রা.)। আমরা জানি, একজন রাষ্ট্রপরিচালক হয়েও নিজের পিঠে আটার বস্তা বহন করে প্রজার ঘরে দিয়ে আসার উমরের (রা.) ঘটনা। অথচ আজকের দিনে রাজনীতিক নেতানেত্রীদের দেখি উল্টোপথের পথিক। রাজনীতিতে তাদের আগমনের হেতুই স্বার্থোদ্ধার। ধর্মের ন্যায় রাজনীতিও আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে রাজনীতি সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। একটা পদের জন্য আজ মানুষ দলে দলে রাজনীতিতে ভিড়ছে, পুঁজি বিনিয়োগ করছে, ষড়যন্ত্র করছে, প্রতিপক্ষকে জেল খাটাচ্ছে, গুম করছে, পঙ্গু করছে, পারলে খুনও করে ফেলছে, তবুও ঐ চেয়ারটা আজ খুবই প্রয়োজনীয়। তারা রাজনীতিকে স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার বানিয়েছে কারণ, তারা স্বপ্নেও ভাবে না যে, রাজনীতি ও রাজ্যপরিচালনা করা ধর্মের কাজ, এটা আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের প্রতি একটা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। একটি জমির মালিক তার জমি চাষের জন্য কোন চাষিকে বর্গা দেবে এটা তার সিদ্ধান্তের বিষয়, তেমনি এই পৃথিবীর প্রকৃত মালিক আল্লাহ, তিনি তাঁর ভূভাগের কোন ভূখণ্ড কাকে দিয়ে আবাদ করাবেন সেটা তাঁরই সিদ্ধান্ত। সুতরাং বর্গাচাষিকে মনে রাখতে হবে, এ জমির মালিক সে নয়, তাই জমিদারের চাওয়া মোতাবেকই চাষাবাদ করতে হবে, অন্যথায় ঐ জমি ও ফসল তার দণ্ডপ্রাপ্তির কারণ হবে।
রাজনীতি তথা মানুষের শান্তি-অশান্তির দায়িত্ব গ্রহণের আগে অনেক ভাবতে হবে। ভাবতে হবে, আমি কি সত্যি সত্যিই মানবসেবার জন্য এই দায়িত্ব গ্রহণ করছি না নিজের স্বার্থোদ্ধারের জন্য। ভাবতে হবে রাজনীতি তার পেশা নয়, বরং নিজের সব বিলিয়ে দিয়ে জনসেবার নামই রাজনীতি। আর এই রাজনীতিই হবে তার দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মান, পুরস্কার ও সফলতার মাধ্যম। এটাই তার পুলসেরাত। যার এই বোধ (Sense) নেই, তার রাজনীতিতে পদার্পণ মানেই রঙ্গমঞ্চে শয়তানের প্রবেশ। সমাজে, রাষ্ট্রে তারচেয়ে আরো অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতির মাধ্যমে মানবসেবার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত। তাঁদের কর্তব্য হচ্ছে শয়তানের হাতে শাসনদণ্ড না ছেড়ে দিয়ে নিজেদের অসাড়তা পরিহারপূর্বক ন্যায়ের ধ্বজা উড়িয়ে মঞ্চে পদার্পণ করা এবং মানবকল্যাণে সময়োপযোগী ভূমিকা রাখা। এ কারণেই আল্লাহর রসুল হেরাগুহার ধ্যানমগ্নতা ভেঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার দুর্নিবার সংগ্রামে।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ