রাকীব আল হাসান
আমি যখন কারও দায়-দায়িত্ব নিব, বড় অংকের বেতন দিয়ে আমার অধীনে কাজ করার সুযোগ দিব তখন অবশ্যই কিছু শর্ত দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করতে বলব অর্থাৎ কিছু প্রতিশ্রুতি নিব। প্রথমেই যে শর্ত দেব তা হলো, আমার হুকুম মান্য করতে হবে, আমি যেভাবে বলব সেভাবে কাজ করতে হবে। এই কথায় স্বীকৃতি না দিলে তাকে দিয়ে আমার কোনো কাজ হবে না। কিছু মানুষ আমার হুকুম মানার স্বীকৃতি দিল, আমার কথামতো কাজও করতে লাগল কিন্তু তাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু ত্রু টি করে ফেলল। তখন আসবে ক্ষমা করার প্রশ্ন, শাস্তি দেবার প্রশ্ন। যদি ত্রুটিটা সামান্য হয় তবে তাকে ক্ষমা করে দিব, যদি ত্রুটিটা সাংঘাতিক হয় তবে শাস্তি দিব, যদি একই ত্রুটি একাধিকবার করে তবে তাকে কঠিন শাস্তি ও সতর্ক করে দিব। কিন্তু যদি সে বলে- “আমি আর আপনার কথা শুনতে পারব না, আপনাকে মান্য করতে পারব না বরং আমি আপনার শত্রু অমুক লোকের কথামতো কাজ করব”, তখন তাকে কি আর আমি বেতন (পুরস্কার) দিয়ে আমার কাছে রাখতে চাইব?
মহান আল্লাহ এ দুনিয়ার মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন-
১- আল্লাহর হুকুম মানবে- এই স্বীকৃতি প্রদান করেছে যারা (অর্থাৎ- মো’মেন)
২- আল্লাহর হুকুম মানার স্বীকৃতি প্রদান করেনি যারা (অর্থাৎ- কাফের)। এর বাইরে আর কোনো মানুষ নেই। (সুরা তাগাবুন-২)।
আল্লাহর হুকুম মান্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে প্রথম দলের সদস্যদের (মো’মেনদের) যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন মহান আল্লাহ এবং তাদের কর্মের ফল স্বরূপ জান্নাত দেবারও প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। অর্থাৎ এটা আল্লাহর সাথে বান্দার চুক্তি। যারা এই চুক্তিপত্রের সাথে যুক্ত হবে না অর্থাৎ দ্বিতীয় দলের সদস্যদের (কাফেরদের) জন্য রয়েছে জাহান্নাম। মো’মেনরা তাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতা, রিপুর তাড়না, অলসতা, গাফেলতি ইত্যাদির কারণে যদি ভুল করে ফেলে তবে আল্লাহ হয় দুনিয়াতে শাস্তি দিবেন নয়ত ক্ষমা করে দিবেন। কোনো কোনো পাপের জন্য তার পুণ্য কাটা যাবে ফলে জান্নাতের স্তর কমবে। কিন্তু কখনোই পাপকর্মের জন্য সে জাহান্নামে যাবে না। আর কাফেররা যত ভালো কাজই করুক জান্নাতে যেতে পারবে না। বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করার জন্য কিছু হাদিস উল্লেখ করলাম-
১- উটের পিঠে পেছনে উপবিষ্ট মুয়ায (রা.) কে রসুলাল্লাহ (সা.) বললেন, “হে মুয়ায! যে সত্য সত্যই সাক্ষ্য দেবে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ (হুকুমদাতা) নেই এবং মোহাম্মদ তার প্রেরিত, আগুন (দোজখের) তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। [আনাস (রা.) থেকে বোখারী, মুসলিম]
২- “যে সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া ইলাহ (হুকুমদাতা) নেই এবং মোহাম্মাদ তার রসুল, আল্লাহ দোযখের আগুন তার জন্য হারাম করে দেবেন।” [ওবাদা বিন সোয়ামেত (রা.) থেকে মুসলিম]
৩- “জান্নাতের চাবি হচ্ছে, এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।” [মুয়ায বিন জাবাল (রা.) থেকে আহমদ]
৪- “আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, এই বিশ্বাস নিয়ে যে মৃত্যুমুখে পতিত হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। [ওসমান (রা.) থেকে মুসলিম]
৫- রসুলাল্লাহ (সা.) আবুযরকে (রা.) বললেন, “যে বলে আল্লাহ ছাড়া ইলাহ (হুকুমদাতা) নেই এবং সেই বিশ্বাস নিয়ে মারা যায় সে জান্নাতে প্রবেশ করবেই। এ কথা শুনে আবুযর (রা.) প্রশ্ন করলেন- যদি সে লোক ব্যভিচার ও চুরি করে? আল্লাহর রসুল (সা.) জবাব দিলেন, সে ব্যভিচার ও চুরি করলেও।” আবুযর (রা.) নিশ্চয়ই কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলেন তার নেতার কথায়, কারণ হাদীসে আমরা পাই তিনি তিন তিন বার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন সে ব্যভিচার ও চুরি করলেও? এবং মহানবী (সা.) তিন তিনবারই তাঁকে একই জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ সে ব্যভিচার ও চুরি করলেও এবং শেষ বার যোগ করেছিলেন “আবু যারের নাক কেটে দিলেও ।” [আবুযর গিফারি (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।
এমনি বহু হাদীস পেশ করা যায়, যা থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় যে, একমাত্র তওহীদই একজন মানুষের জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার এবং জান্নাতে প্রবেশ করার প্রথম ও প্রধান উপায় এবং এটিই যথেষ্ট। আর আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে গ্রহণ না করলে যত নামাজই পড়ুন, যত রোজাই রাখুন, যত কেতাবই মুখস্থ করুন, যত বড় লেবাসই পরিধান করুন না কেন অতি অবশ্যই জাহান্নামে যেতে হবে।
হুকুমদাতা হিসাবে আল্লাহকে গ্রহণ করার অর্থ হলো- ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া নীতি অনুসরণ করা।
এখন আমরা আসলে এই শর্তের মধ্যে আছি কি না, কলেমাতে আছি কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন। সমগ্র মানবজাতি আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, রাষ্ট্র চলবে পাশ্চাত্যদের সিস্টেম অনুযায়ী, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব চলবে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত বিধান দিয়ে। আর ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে আল্লাহকে খুশী রাখার জন্য নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি করে যাচ্ছে। এই যে জীবনের কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহকে মানা অর্থাৎ আংশিকভাবে আল্লাহকে মানা- এটার নামই হলো শেরক। আর শেরকের বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তার সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্য সকল গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন” (সুরা নিসা: ৪৮)। তিনি আরও বলেন, “তবে কি তোমরা কেতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে তাদের পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির (জাহান্নামের) দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন। (সুরা বাকারা-৮৫)।