হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

এ জাতি উম্মতে মোহাম্মদী নয়

আবু ফাহাদ

মহান আল্লাহ তাঁর শেষ রাসুলকে হেদায়াহ ও সত্যদীন ‘ইসলাম’ দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন সারা দুনিয়ার সকল জীবনব্যবস্থার উপর একে বিজয়ী করার জন্য (সুরা তওবাহ ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮, সুরা সফ ৯)। উম্মতে মোহাম্মদী ডানে বায়ে না চেয়ে একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) তাদের কর্তব্য চালিয়ে গেল প্রায় ৬০/৭০ বছর। এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে তদানীন্তন পৃথিবীর এক উল্লেখযোগ্য অংশে এই শেষ ইসলামের প্রতিষ্ঠা করল। তখন জাতিটি ছিল মোমেন, মোসলেম এবং উম্মতে মোহাম্মদী। তখন এই জাতির অবস্থা কেমন ছিল? পুরো জাতি ছিল একজন নেতার নেতৃত্বে ইস্পাতের মত কঠিন ঐক্যবদ্ধ, তাঁদের লক্ষ্য ছিল নির্ভুল, সেটা হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করা। তাঁরা ছিল নেতার প্রতি আনুগত্যে অটল, আল্লাহর রাস্তায় জীবন-সম্পদ উৎসর্গকারী এক দুর্র্ধর্ষ জাতি। একজন নেতার হুকুমে জাতির প্রতিটি লোক ছিল সদা সতর্ক ও সজাগ। তাদের জাতীয় জীবনে একটি মাত্র জীবনব্যবস্থা কার্যকর ছিল, সেটা হচ্ছে দীনুল হক, ইসলাম। জাতির মধ্যে ফেরকা, মাজহাবের অস্তিত্ব ছিল না, ফলে ছিল না কোনো হানাহানি, মাসলা মাসায়েল নিয়ে মতভেদ, কূটতর্ক। দীনের যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলে পুরো জাতির সকলে একটি মাত্র উত্তর দিত। এর ফলে সমাজে অতুলনীয় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে তখন অর্ধেক পৃথিবীর কোথাও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী না থাকা সত্ত্বেও সমাজে বলতে গেলে কোনো অপরাধই ছিল না। সুন্দরী যুবতী নারী অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ একা পাড়ি দিত, তার মনে কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হত না। মানুষ রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধন-সম্পদ হারিয়ে গেলেও তা খোঁজ করে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানী প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে বছরের পর বছর কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসত না। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। এই স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মত লোক পাওয়া যেত না। এই পরম শান্তিই হচ্ছে সত্যদীনের ফলাফল- তাই এ দীনের নাম ইসলাম, আক্ষরিক অর্থেই শান্তি। রাসুলাল্লাহর উপর দায়িত্ব ছিল সারা পৃথিবীতে এই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, এজন্য তাঁর উপাধিও আল্লাহ দিয়েছেন রহমাতাল্লিল আলামীন- বিশ্বজগতের জন্য রহমত। কিন্তু সারা পৃথিবীতে দীন প্রতিষ্ঠার মত এতবড় কাজ একজন ব্যক্তি একজীবনে করা সম্ভব নয়, তাই তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ আরব উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে প্রভুর কাছে চলে গেলেন, বাকি দুনিয়ার দায়িত্ব পড়ল তাঁর উম্মাহর উপরে। সেই উম্মাহ ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত একদেহ একপ্রাণ হয়ে একাগ্র লক্ষ্যে রাসুলাল্লাহর উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব পূরণে সংগ্রাম, জেহাদ চালিয়ে গেলেন।

উম্মতে মোহাম্মদী থেকে বহিষ্কার:

তারপর জাতির মধ্যে আরম্ভ হলো উদ্দেশ্যচ্যুতি, আকিদার বিচ্যুতি। জাতি আল্লাহর রাস্তায় ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাদ দিয়ে অন্তর্মুখী, ঘরমুখী হয়ে গেল। কোনো জাতি যদি গতিহীন, নির্জীব, স্থবির হয়ে যায় তখন স্বভাবতই জাতি মূলকাজ বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। উম্মতে মোহাম্মদীরও তাই হলো। জাতি ভুলে গেল যে কাজের জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে, প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সেই কাজ ছেড়ে দেওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। কিন্তু জাতির লোকদের আকিদা অর্থাৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে ধারণা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় জাতি ঠিক তাই করল, আল্লাহর দীন সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জেহাদ অর্থাৎ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ত্যাগ করল এবং ত্যাগ করে অন্যান্য রাজা বাদশাহরা যেমন রাজত্ব করে তেমনি শান শওকতের সঙ্গে তাদের মতই রাজত্ব করতে শুরু করলো। এই সর্বনাশা কাজের পরিণতি কি তা তারা উপলব্ধি করতে পারলেন না। তারা উপলব্ধি করতে পারলেন না যে, যে জিনিস যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয় সেটা যদি সেটাকে দিয়ে না হয়, তবে আর ঐ জিনিসের কোনো দাম থাকে না, সেটা অর্থহীন হয়ে যায়। একটা ঘড়ির উদ্দেশ্য হচ্ছে সময় জানা, ঘড়িটা যদি না চলে, সময় না দেখায়, এমন কি যদি ভুল সময় দেখায় তবে আর সে ঘড়িটার কোনো দাম থাকে না। ঘড়িটা সোনা, হীরা জহরত দিয়ে তৈরি করলেও না।

রসুলাল্লাহকে মেরাজে নিয়ে আল্লাহ তাঁকে স্থান ও কালের বি¯তৃতি থেকে মুক্ত করেছিলেন। তাই অতীত ও ভবিষ্যতের যতটুকু তাঁকে জানিয়েছিলেন তাতেই তাঁর উম্মাহর ভবিষ্যতের অনেক কিছুই তিনি জানতে পেরেছিলেন। তাঁর ওফাতের পর ত্রিশ বছর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে পরিণত হবে তা তিনি জানতেন, বলেও গেছেন [সাফীনা (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজী, আবু দাউদ]। এবং তা যে সত্যে পরিণত হয়েছে তা ইতিহাস। ঠিক ত্রিশ বছর পরে একজনের ছেলে বাপের পর খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হলো। তিনি এও বলে গেছেন যে, আমার উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর [আবু হুরায়রা (রা.) থেকে তিরমিজি, ইবনে মাজাহ]। বর্তমানের বিকৃত ইসলামের ধর্মীয় নেতাদের দৃষ্টিতে তাদের অর্থাৎ যেটাকে তারা উম্মতে মোহাম্মদী বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। সেটার মানুষের ব্যক্তিগত আয়ুর কথা বোঝেন। তাদের এই ভুল বোঝার কারণ হলো অতি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ও আকিদার বিকৃতি। রাসুলাল্লাহ তাঁর উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর বলতে তিনি যে তাঁর উম্মাহর লোকজনের ব্যক্তিগত আয়ু বোঝান নি তার প্রধান দু’টো কারণ আছে। প্রথমত ৬০ থেকে ৭০ বছর আয়ু হবার মধ্যে এমন কী বিশেষত্ব আছে যা একজন নবী তাঁর উম্মাহ সম্বন্ধে বলবেন? তার আগের লোকজনের বা পরের লোকজনের আয়ুর থেকে তার কী তফাৎ? আমাদের মধ্যেই যে অন্যান্য ধর্মের লোকজন বাস করে তাদের আয়ুর সাথে আমাদের আয়ুর কী তফাৎ? কিছুই না। তাঁর ঐ কথা তাঁর উম্মাহর কোনো বৈশিষ্ট্য হিসাবে বলার কোনো অর্থ হয় না। তিনি যদি বলতেন, আমার উম্মাহর লোকজনের দু’টো করে চোখ থাকবে, তবে তার কি অর্থ হতো? কিছুই না। দ্বিতীয়ত, আমার উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর এ কথা বলে দেবার অর্থ ৬০ বয়সের আগে যারা মারা যাবে এবং ৭০ বছর বয়সের পর যারা মারা যাবে তারা আর উম্মতে মোহাম্মদী নয়। এ হতে পারে? অবশ্যই নয়। মনে রাখবেন, এ কথা সাধারণ মানুষের যা মনে চায় বলে ফেলা নয়। এ আল্লাহর রাসুলের বাণী। যাঁর প্রতি কথা, প্রতি শব্দের ব্যবহার ওজন করা, ভেবেচিন্তে বলা।

এ হাদিসের প্রকৃত অর্থ হলো: উম্মতে মোহাম্মদী হলো সেই জাতি যে জাতি তাঁর নবীর অর্থাৎ মোহম্মদের (স.) উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করতে সংগ্রাম করে যায়। যে কথা পেছনে বলে এসেছি। এখানে ঐ দায়িত্ব হলো সমস্ত পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠা করা। এ সংগ্রাম ত্যাগ করলেই সে জাতি আর উম্মতে মোহাম্মদী থাকে না। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করুন, দেখবেন ঐ জাতি মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত ঐ সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছে এবং ঐ সময়ের পর ঐ কাজ জাতি হিসাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ সময় পর্যন্ত এই জাতি সর্বাত্মক সংগ্রাম করে গেছে একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে এবং সেটা হলো বিশ্বনবীর সুন্নাহ্ পালন। যে সুন্নাহর কথা তিনি বলেছেন যে, যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করবে সে আমাদের কেউ নয়। সেই প্রকৃত সুন্নাহ্ হলো সমস্ত পৃথিবীতে এই শেষ ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ আকিদা বদলে গেল ৬০/৭০ বছর পর। এই উম্মাহ তার উদ্দেশ্য ভুলে গেল। ইসলাম প্রতিষ্ঠার বদলে তাদের উদ্দেশ্য হয়ে গেল রাজ্যবিস্তার, সম্পদ আহরণ। জাতির উদ্দেশ্য বদলে গেল। উদ্দেশ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় আর কিছুই হতে পারে না। বাকি সব কম প্রয়োজনীয়। সেই মহা প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যই যদি বদলে যায় তবে যে কোনো জিনিসেরই আর কিছু থাকে না। যে উদ্দেশ্যে শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী প্রেরিত হয়েছিলেন, যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর সৃষ্ট জাতি জীবনের সবকিছু কোরবান করে আরব থেকে বের হয়ে সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই উদ্দেশ্য তাঁদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে পরিণত রাজ্যজয়ের যুদ্ধে।

মহানবীর (দ.) ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক ৬০/৭০ বছর পর উম্মতে মোহাম্মদীর মৃত্যু হলো, একথা বহু লোকই মানবেন না জানা কথা। বিশেষ করে যারা অতি মুসলিম, যারা এই দীনের মর্মবাণী থেকে বহুদূরে, এর মৃত কংকালটা যারা আঁকড়ে ধরে আছেন তারা তর্ক দেবেন বিশ্বনবী (দ.) নিজেই বহু হাদিসে আমাদের তাঁর উম্মাহ বলে বলেছেন, এমনকি পথভ্রষ্ট হলেও আমাদের তাঁর উম্মাহ বলে উল্লেখ করেছেন। ঠিক কথা। কিন্তু ঐসব হাদিসে তিনি তাঁর প্রকৃত উম্মাহ বোঝান নি, বুঝিয়েছেন সাধারণভাবে-ইংরেজীতে যাকে বলা হয় In general sense অর্থাৎ অন্য থেকে পৃথক বলে বোঝাবার জন্য। অর্থাৎ যেটাকে তিনি উল্লেখ করছেন সেটা খ্রিষ্টান, ইহুদি জাতি নয়, মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ (স.) বলে এমনি একটা পৃথক জাতি- একথা বোঝাবার জন্য। প্রমাণ দিচ্ছি- মহানবী (দ.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ক্রমে ক্রমে ভবিষ্যতে তাঁর জাতি বনি ইসরাইলিদের (এখানে তিনি বনি ইসরাইল বলতে ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতাকে বোঝাচ্ছেন) এমনভাবে অনুসরণ করবে যে তাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করলে, তাঁর উম্মাহর মধ্য থেকেও কেউ তা করবে (হাদিস- আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে তিরমিযি, মেশকাত)। প্রশ্ন হচ্ছে কেউ যদি মানসিকভাবে অন্য জাতির এতটা দাস হয়ে যায় যে, হীনম্মন্যতায় সে ঐ পর্যায়ে যায় যে, তাদের নকল ও অনুকরণ করতে যেয়ে সে প্রকাশ্যে মায়ের সাথে ব্যভিচার করতেও বিরত হয় না, তবে সেই লোককে বা জাতিকে উম্মতে মোহাম্মদী বলা যায়? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এখানেও বিশ্বনবী (দ.) তাঁর উম্মাহ বলেই উল্লেখ করেছেন, কারণ এই জাতিটিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করে বোঝাবার জন্য In general sense, তিনি তাঁর প্রকৃত উম্মাহ বোঝান নি। যখন এ জাতি সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করেছে তার কিছুদিন পরই তাদেরকে বিজাতির পদলেহন করতে হয়েছে। অর্ধ দুনিয়ার শাসক থেকে পরিণত হয়েছে গোলামে। আজ এ জাতি ইলাহ হিসেবে বলছে আল্লাহকে, আর হুকুম মেনে চলছে মানুষের। নিজেদের মনগড়া বিধান দিয়ে দেশ শাসন করছে, যার অনিবার্য ফল হচ্ছে অশান্তি,অন্যায় ও অবিচার। আর তা করেই নিজেদেরকে উম্মতে মোহাম্মদী ভেবে নিশ্চিন্ত মনে নামায-রোযা করে যাচ্ছে।

                                                    (এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে সম্পাদিত)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...