হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে
অল্পে তুষ্ট থাকা মো’মেনের অনন্য বৈশিষ্ট্য- এটা ঠিক, কিন্তু আজকাল এই ‘অল্পে তুষ্টি’কে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয় তা ঠিক নয়। বর্তমানে রসুলের হাদিস থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়, যেখানে রসুলাল্লাহ বলেছেন, অঢেল সম্পদ থাকলেই ঐশ্বর্যশালী হওয়া যায় না, বরং মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঈশ্বর্য (বোখারী, মুসলিম)। এছাড়াও রসুলাল্লাহ ও তাঁর আসহাবগণের জীবনী থেকে বিভিন্ন ঘটনার অবতারণা ঘটিয়ে অনেকে দেখাতে চান যে, তাঁরা খুব অনাড়ম্বর, সাদাসিধে, প্রকারান্তরে দরিদ্র জীবনযাপন করেছেন, ছেঁড়া পোশাক পরেছেন, অনেক সময় প্রায় অভুক্ত থেকেছেন। কাজেই আমাদেরও অল্পে তুষ্ট থেকে ঐরূপ জীবনযাপন করা উচিত। এই চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে অনেক ধর্মভীরু মানুষ বেশি অর্থোপার্জন করাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। তারা শুধু জীবনধারনের জন্য ন্যূনতম যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু রোজগার করাকেই যথোচিত জ্ঞান করে তার বেশি পরিশ্রম করা বা আর্থিকভাবে আরও স্বচ্ছল হওয়ার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন, অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা বরণ করে নেন। বেশি ধন-সম্পদের মালিক হলে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে, আল্লাহর কাছে সম্পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে, হাশরের ময়দানে তীল পরিমাণ সম্পদের সঠিক হিসাব প্রদান না করে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না- আলেম মাওলানাদের এমন সাবধানবাণী স্মরণ করে তারা দরিদ্র জীবনকেই কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন আর ভাবেন, পৃথিবীর জীবন যেহেতু পরকালের তুলনায় কিছুই না, কাজেই অল্পে তুষ্ট থেকে কোনো রকমে আলুসিদ্ধ ডাল খেয়ে জীবনটা পার করে যেতে পারলেই হলো।
এখানে আমার ভিন্নমত রয়েছে। অল্পে তুষ্টি অর্থ স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা বরণ করা নয়। ইচ্ছা করে দরিদ্রতা অবলম্বন করাই বরং গুনাহ্র কাজ। কারণ, তার এই কাজে না সে নিজে লাভবান হয়, না মানবজাতি লাভবান হয়। অল্পে তুষ্টির অর্থ ভিন্ন। একটি উদাহরণ। ধরুন আপনি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক আয় রোজগার করলেন, যা আপনার প্রাথমিক প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। এই রোজগার থেকে আপনি একশ’টি শার্ট কিনলেন। তার মধ্যে নিজের জন্য বিশটি শার্ট রেখে বাকি আশিটি শার্ট আপনি সমাজের গরীব-দুঃখী, ছিন্নমূল মানুষকে দান করে দিলেন। আপনি ইচ্ছা করলে কিন্তু সবগুলো শার্টই নিজের ও পরিবারের জন্য রাখতে পারতেন, বিষয়টি আপনার ইচ্ছাসাপেক্ষ, বৈধভাবে উপার্জিত টাকায় আপনি একশ’ কেন হাজারটা শার্টও ক্রয় করতে ও ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু আপনি শুধু নিজের কথা চিন্তা না করে সমাজের কথাও ভাবলেন এবং আপনার উপার্জিত সম্পদ থেকে আপনার পাশাপাশি সমাজের আশিটি দুস্থ পরিবার উপকৃত হলো। কিন্তু শুধু ন্যূনতম খাওয়া-পরার চিন্তা করে সামান্য কিছু উপার্জন করেই ক্ষান্ত থাকলে, নিজের ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ বিশটি শার্ট হয়তো আপনি ক্রয় করতে পারতেন কিন্তু তার দ্বারা সমাজ কখনই উপকৃত হতো না।
একইভাবে ধরুন আপনার দশ লক্ষ টাকা আছে। ইচ্ছা করলেই আপনি একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করতে পারেন। কিন্তু আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভিন্ন। ভাবলেন- পৃথিবীতে একটি ছোট ঘর হলেই হবে, এখানে এর বেশি কিছু দরকার নাই, যা নেবার আমি পরকালে আল্লাহর কাছে নেবো। এই ভেবে আপনি যদি এক লক্ষ টাকার ছোট একটি ঘর তৈরি করে বাকি নয় লক্ষ টাকা আর্তপীড়িত গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে ব্যয় করেন তাহলে আপনি অল্পে তুষ্ট থাকলেন। এটাকে বলে অল্পে তুষ্টি। কিন্তু আপনি চেষ্টা করলেন না, পরিশ্রম করলেন না, আল্লাহর দেওয়া সামর্থ্যকে কাজে লাগালেন না, উপায়-উপার্জন করলেন না, ইচ্ছা করে কুঁড়ে ঘরে থাকলেন, ছেঁড়া ছ্যান্ডেল পরলেন, পান্তা ভাত খেলেন, আর বললেন আমি অল্পে তুষ্ট সেটা মানা যায় না। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অল্পে তুষ্টির অজুহাতে সে সামর্থ্যকে ব্যবহার না করাটাই বড় অন্যায়। স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা বরণ না করা, পরিশ্রম করে অর্থোপার্জন করা এবং প্রতিবেশিকে সেই অর্থ থেকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে রসুলাল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন- “আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, দুনিয়ায় যত নবী-রসুল এসেছেন তাদের সবাই রেযেক হাসিলের জন্য চেষ্টা- সাধনা করতেন এবং নিজেদের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতেন না। অতএব তোমরাও রুযী হাসিলের জন্য কোশেশ করো। মেহনত-মজদুরী করা এবং লাকড়ির বোঝা নিজের মাথায় উঠানো অন্যের কাছে সওয়াল করার চেয়ে উত্তম। যার জীবিকা উপার্জনের সামর্থ্য রয়েছে অন্যের কাছে চাওয়া তার জন্য খুবই অসম্মানজনক। সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত এবং শেষ বিচারের দিনও তাকে এমন অবস্থায় হাযির করা হবে যে তার চেহারায় গোশত থাকবেনা। আমি পরিষ্কারভাবে তোমাদের বলছি, যার কাছে একদিনের খাদ্যও মওজুদ রয়েছে তার জন্য সওয়াল করা অবশ্যই হারাম। আমি জানি, কোনো কোনো সংসারত্যাগী ভিক্ষাবৃত্তিকে জায়েয বলে, কিন্তু ইসলাম হাত-পা গুটিয়ে বসা এবং ভিক্ষাবৃত্তি এখতিয়ার করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম আমাদের হুকুম করেছে যে, দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর করুণা তালাশ করো। যে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বাঁচবে, নিজের পরিবার-পরিজনের পর-ওয়ারিশ করা ও প্রতিবেশীর সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য হালাল উপায়ে জীবিকা হাসিল করবে সে কেয়ামতের দিন পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জল চেহারা নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হবে। দুনিয়াতেও তার জন্য সম্মান ও প্রতিপত্তি রয়েছে। [মহানবীর ভাষণ, সিরাত বিশ্বকোষ, ইফাবা]
সুতরাং আমি অল্পে তুষ্ট এ কথা তখনই বলা যাবে যখন আমি সর্বোতভাবে প্রচেষ্টা চালাবো এবং আমার সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে উপার্জন করার পর নিজের জন্য নিতান্তই প্রয়োজনীয় ব্যয় করব আর বাকি সবটুকু অন্য মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেব। এটাই হলো মো’মেনের অল্পে তুষ্টি। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টা না করে ইচ্ছা করে দরিদ্র হলাম, যা দ্বারা আমি ও আমার সমাজ কেউই উপকৃত হলো না, এটা অল্পে তুষ্টি নয়।