হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ঈদে মিলাদুন্নবীর সার্থকতা : মহানবীর (সা.) আগমনের উদ্দেশ্য

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ১২ রবিউল আউয়াল। দেশজুড়ে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও শ্রদ্ধার সাথে পালিত হল দিনটি। এই দিনটিকে ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হবে নাকি সিরাতুন্নবী বলা হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই তর্কবিতর্ক, বাহাস করে আসছেন আমাদের আলেমগণ। এমনকি অনেক জায়গায় এই নিয়ে একদল আরেকদলকে প্রতিরোধ, হামলা, মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। অথচ এটি বিতর্কের কোনো বিষয়ই নয়। মিলাদ, মাওলেদ এবং মাওলুদ এ তিনটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যথাক্রমে জন্মদিন, জন্মকাল ও জন্মস্থান প্রভৃতি। সুপ্রসিদ্ধ আল মুনজিদ নামক আরবি অভিধানের ৯১৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে, মিলাদ অর্থ জন্মসময়। মাওলেদ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। মাওলুদ অর্থ ছোট শিশু।
অনুরূপ মিসবাহুল লুগাতের ৯৬৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মসময়। ‘মাওলেদ’ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। ‘মাওলুদ’ অর্থ ছোট শিশু। রসুলাল্লাহ সোমবারে রোজা বা সওম রাখতেন। আবু কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলাল্লাহর দরবারে আরজ করা হলো তিনি প্রতি সোমবার রোজা রাখেন কেন? উত্তরে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এই দিনেই আমি প্রেরিত হয়েছি এবং এই দিনেই আমার উপর পবিত্র কুরআন নাজেল হয়। [সহিহ মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, ৮১৯ পৃষ্ঠা, বায়হাকী: আহসানুল কুবরা, ৪র্থ খণ্ড ২৮৬ পৃ., মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল ৫ম খণ্ড ২৯৭ পৃ., মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৪র্থ খণ্ড ২৯৬পৃ., হিলিয়াতুল আউলিয়া ৯ম খণ্ড ৫২ পৃ.] যারা নবী করিম (সা.) এর জন্মদিনকে ঈদের মতো উৎসব আকারে পালন করেন তারা এই হাদিসটি দলিল হিসাবে পেশ করেন।
সিরাতও একটি আরবি শব্দ। এর বহুবচন হচ্ছে সিয়ার। অর্থ চাল-চলন, গতি ইত্যাদি। আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান‘আল মুজাম আল আজম’ ও ‘মিসবাহুল লুগাত’-এ সিরাত শব্দের অর্থ করা হয়েছে- (১) যাওয়া, প্রস্থান করা, চলা; (২) গতি, পথ, পদ্ধতি, ধারা; (৩) আকার, আকৃতি, মুখাবয়ব; (৪) চেহারা, আকৃতি; (৫) অবস্থা; (৬) কর্ম-নৈপুণ্য, ঢঙ, চাল; (৭) সুন্নত; (৮) জীবন চলার ধরণ, প্রকৃতি, কাজকর্ম করার ধরণ, জীবন পরিচালনার ঢঙ; (৯) অভ্যাস; (১০) কাহিনী, পূর্ববর্তীদের গল্প বা কাহিনী এবং ঘটনাবলীর বর্ণনা ইত্যাদি।
অন্যদিকে ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ সিরাতের অর্থ লিখেছে- (১) যাওয়া, যাত্রা করা, চলা; (২) মাজহাব বা তরিকা; (৩) সুন্নাহ; (৪) আকৃতি; (৫) অবস্থা; (৬) কীর্তি; (৭) কাহিনী, প্রাচীনদের জীবন ও ঘটনাবলীর বর্ণনা; (৮) নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর গাজওয়ার (যুদ্ধের) বর্ণনা; (৯) অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক, যুদ্ধ এবং শান্তির সময়ে মুহাম্মদ (সা.) যা বৈধ মনে করতেন তার বর্ণনা কিংবা মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবন চরিত; সম্প্রসারিত অর্থে বীরপুরুষদের কীর্তির বর্ণনা।
মিলাদ ও সিরাত দুটো শব্দকে নিয়ে তাই বিতর্কের কোনো জায়গা নেই। রসুলাল্লাহর জন্মদিনকে স্মরণ করে তাঁর জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা করাটাই হচ্ছে এই দিনটিতে করণীয়। এর চেয়ে বেশি কিছু করাকে আমরা অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি বলেই মনে করি। এমনিতেই মুসলমান নামক জনগোষ্ঠী আজকে চরমভাবে লাঞ্ছিত পরাজিত, নিপীড়িত। তাদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এখন মুসলমানদেরকে হত্যা করে তাদের ভূখণ্ডগুলোকে দখল করে নিচ্ছে। সর্বত্র মুসলমান আজকে নির্যাতন নিপীড়ন বৈষম্যের শিকার। তারা নিজেরাও হাজার হাজার ফেরকা-মাজহাবের জালে বন্দী হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়ে আছে। এই বিপন্ন সময়ে সিরাতুন্নী আর মিলাদুন্নবী শব্দচয়ন নিয়ে বিতর্ক আর বিভেদ বৃদ্ধি না করলেও চলবে। কাজেই আমরা ওসব অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে না গিয়ে বরং রসুলুল্লাহর পবিত্র জীবনী নিয়েই আলোচনা করব।
জীবনী আলোচনার পূর্বে আমাদেরকে জানতে হবে, রসুলাল্লাহর আগমনের উদ্দেশ্য কী? আল্লাহ কেন তাঁকে পাঠিয়েছেন? তাঁর সমগ্র সংগ্রামী ও কর্মময় জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল। এই উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানার নামই হলো আকিদা অর্থাৎ কোনো জিনিস বা বিষয় সম্পর্কে সম্যকভাবে জানা (Comprehensive Concept)। আকিদা ভুল হলে ঈমান ভুল আর ঈমান ভুল হলে আমল ভুল – প্রায় সকল আলেম ফকিহ এ ব্যাপারে একমত। রসুলাল্লাহর জীবনাদর্শ সম্পর্কে সঠিক আকিদা পোষণ করতে হলে আমাদেরকে তাঁর নব্যুয়তি জীবনের সূচনা থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে সংগ্রাম তিনি করে গেলেন সেটাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তাঁর জীবনে যারা খণ্ড খণ্ড করে দেখবে, তারা তাঁর সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে যেতে পারবে না। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ অন্তত তিনটি আয়াতে রসুলাল্লাহর আগমনের উদ্দেশ্য বিবৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ স্বীয় রসুলকে হেদায়াহ ও সত্যদীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন এই জন্য যে, তিনি যেন একে অন্যান্য সকল দীনের উপর বিজয়ী করেন (সুরা তওবা ২৮, সুরা তওবা ৩৩, সুরা সফ ৯)।
হেদায়াহ হচ্ছে সঠিক পথের নির্দেশনা (Orientation)। মানুষ কোনদিকে যাবে কোন সিদ্ধান্ত নিবে এ বিষয়ে আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াহ (Guideline) প্রদান করেছেন। এটাই হচ্ছে “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম” – আমাদেরকে সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও। এটা হলো তওহীদ – লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম না মানা। এই তওহীদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে দীনুল হক বা সত্য জীবনব্যবস্থা। মানবজীবন কীভাবে পরিচালিত হবে, তার ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন ইত্যাদি নিয়ে সমগ্র জীবন পরিচালিত করার জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি দীন আল্লাহ দিলেন। যে বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমি আজ তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গতা দান করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসাবে মনোনীত করলাম (সুরা মায়েদা ৩)।
আল্লাহর মনোনীত এই সত্যদীন সমগ্র মানবজাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই রসুলাল্লাহর আগমনের উদ্দেশ্য। একটি দীনের ফল তখনই দৃশ্যমান হয় যখন সেটাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। রসুলাল্লাহর কাজের পরিসীমা হলো সমগ্র মানবজাতি, সমগ্র বিশ্ব, তাঁর সময়সীমা কেয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ বলেন, “হে রসুল! আপনি বলে দিন আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসুল” (সুরা আরাফ ১৫৮)। তাঁর উপাধি আল্লাহ দিয়েছেন, রহমাতাল্লিল আলামিন অর্থাৎ বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত। সেটা কীভাবে হবে? যখন এই সত্যদীন সমগ্র দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করা যাবে তখনই শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই দীনকে সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠার কোনো চেষ্টাই না করে যতই মিছিল করি, মিলাদ পড়ি, ফেস্টুন নিয়ে জনসংখ্যা প্রদর্শন করি লাভ নেই। পূর্বের নবী রসুলদের অনেকে এসেছেন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য। বনি ইসরাইল জাতির মধ্যে আগত নবী-রসুলরা কথা বলেছেন তাঁদের জাতির উদ্দেশে। তাঁরা বলেছেন, “হে বনি ইসরাইল!” কিন্তু শেষ রসুল বলেছেন মানবজাতিকে উদ্দেশ করে। তাঁর এই অভিযাত্রা শুরু হয়েছে হেরা গুহা থেকে এবং ঘোষণা হয়েছে সাফা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে। দীন প্রতিষ্ঠার এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি একটি জাতি গঠন করলেন যার নাম আমরা বলতে পারি উম্মতে মোহাম্মদী। আল্লাহ তাঁকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য পাঁচদফার একটি কর্মসূচি প্রদান করলেন, তিনি সেই কর্মসূচির আলোকে জাতিটিকে গড়ে তুললেন। এই ৫ দফা কর্মসূচি তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করার সময় বলছেন- এই কর্মসূচি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, এখন এটা তোমাদের হাতে অর্পণ করে আমি চলে যাচ্ছি। সেগুলো হলো :
(১) (সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে) ঐক্যবদ্ধ হও।
(২) (যিনি নেতা হবেন তার আদেশ) শোন।
(৩) (নেতার ঐ আদেশ) পালন করো।
(৪) হেযরত (অন্যায় ও অসত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ) করো।
(৫) (এই দীনুল হক কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করো। এখানে জেহাদ অর্থ: সর্বাত্মক চেষ্টা, প্রচেষ্টা।
যে ব্যক্তি এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হলো, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেললো- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামায পড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানী পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রাঃ) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত]।
এই কর্মসূচি মোতাবেক তিনি তাঁর জাতিকে তৈরি করলেন। তিনি জাতিকে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ করলেন যার উপমা আল্লাহ দিয়েছেন গলিত সীসার তৈরি প্রাচিরের সঙ্গে (সুরা সফ ৪)। তিনি হুকুম দিয়েছেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জু (তওহীদ) ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সুরা ইমরান ১০৩)। আর আল্লাহর রসুল ঐক্য বিনষ্টকরাকে কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঐক নষ্টকারীকে জাতির শত্রু বলে সম্বোধন করলেন। ঐক্যবিনষ্ট হয় এমন কাজ দেখলে তিনি রেগে আগুন হয়ে যেতেন। বিদায়হজ্বের ভাষণে তিনি জাতির ঐক্যবদ্ধতার গুরুত্ব সর্বাধিক দিয়েছেন।
তিনি জাতিকে সর্বদা একজন আমিরের বা নেতার অধীনে থাকা শেখালেন। তারা আমিরের শর্তহীন, প্রশ্নহীন, দ্বিধাহীন আনুগত্য করবে, যেভাবে মালায়েকগণ আল্লাহর আনুগত্য করে থাকে। রসুল বলেছেন, তোমাদের আমির যদি কানকাটা, ক্ষুদ্রমস্তিষ্ক, হাবশি ক্রীতদাসও হয় তবু তার আনুগত্য করবে। আমিরের আদেশ মানেই রসুলের আদেশ, রসুলের আদেশ মানেই আল্লাহর আদেশ। তিনি শেখালেন, জাতি হবে একটা, নেতা হবে একজন, সিদ্ধান্ত হবে একটা। সুতরাং এ জাতির মধ্যে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের কোনো সুযোগ নেই।
যারা রসুলাল্লাহর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলেন তারা আবু জাহেল উতবা তাদের সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। তাদের থেকে আলাদা হওয়ার পরিণতি কী হয়েছে তা সুমাইয়া, বেলাল, খাব্বাবদের (রা.) ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে। বেলাল (রা.) যখন কাফের সর্দারদের দ্বারা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন, যখন তার থেকে দীনত্যাগের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য চাবুক পেটা করা হতো, প্রখর রোদের মধ্যে উত্তপ্ত মরুভূমির উপর পাথরচাপা দিয়ে শুইয়ে রাখা হতো তিনি তখন একটি শব্দই বারবার বলতেন, “আহাদ আহাদ”। এই হচ্ছে অন্যায়কে প্রত্যাখ্যানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থানগ্রহণকারী পরিবারকে তারা ত্যাগ করলেন, যখন তাদের জীবনসংকট সৃষ্টি হলো তারা তাদের দেশও ত্যাগ করলেন।
এইভাবে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে চ‚ড়ান্ত সংগ্রামের জন্য, জেহাদের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করলেন। সেহ জেহাদ বলতে আজকের জেহাদের নামে চলা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নয়। জেহাদ হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। এর মধ্যে মুখে বলে, বক্তৃতা দিয়ে, লিখে এক কথায় সর্বতোভাবে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জানমাল দিয়ে চেষ্টা করাই হচ্ছে জেহাদ। মূলত হেরাগুহায় নব্যুয়ত পাওয়ার পর থেকেই সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রাম আরম্ভ করলেন রসুলাল্লাহ। হেজরতের পরে একে একে বদর, ওহুদ, খন্দক, খায়বার, হুনায়ানের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও তাঁকে করতে হয়েছে। প্রতিটি যুদ্ধে রসুলের সাহাবীরা শহীদ হয়েছেন, কাফেররাও আহত-নিহত হয়েছে। সাহাবিরা অধিকাংশই তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়েছেন, কিন্তু তারা কখনোই কারো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি, কোনো প্রলোভনের কাছে বিক্রি হন নি। রসুলাল্লাহ বলেছেন, “যদি তোমরা আমার এক হাতে চাঁদ আর আরেক হাতে সূর্যও এনে দাও, আমি এ পথ ছাড়ব না। এই পথে হয় আল্লাহর বিজয় আসবে, নয়ত মোহাম্মদ ধ্বংস হয়ে যাবে।” আল্লাহর বিজয় মানে মানবতার বিজয় মানেই মানবতার মুক্তি। সেই সংগ্রামের ফলটা কী হয়েছে তা কয়েকটা ঘটনা থেকে বোঝা যায়। সেই নির্যাতিত ক্রীতদাস বেলালকে (রা.) তিনি মক্কা বিজয়ের দিন কাবার উপরে দাঁড় করালেন। মানুষের সামনে ইসলামের মাহাত্ম্য ঘোষণার জন্য আজান দেওয়ার হুকুম দিলেন। এই বেলাল (রা.) হলেন আরব্য জাহেলিয়াতের দাসদের প্রতিনিধি। কিছুদিন আগেও যাকে হাটে বাজারে পশুর মতো বিক্রি করা হয়েছে সেই বেলালকে (রা.) তিনি কাবার উপরে স্থান দিয়ে প্রমাণ করলেন, মানুষ ঊর্ধ্বে-মানবতা ঊধ্বে। মানুষ কাবাকে সামনে রেখে সেজদা করে, কাবা তাওয়াফ করে। কিন্তু মো’মেনের সম্মান সেই কাবারও ঊর্ধ্বে (হাদিস), কারণ মো’মেন সত্য প্রতিষ্ঠা করে।
তিনি এমন পরিবেশ তৈরি করলেন যে একজন সুন্দরী মেয়ে মানুষ একা, স্বর্ণালঙ্কার পরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে শত শত মাইল পথ অতিক্রম করতে পারত। তিনি এমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, সম্ভ্রান্ত ঘরের কোরায়েশ বংশীয় নারীও চুরি করে তার সাজা থেকে মুক্তি পায় নি। যারা তার জন্য সুপারিশ করতে এসেছিল তাদের উদ্দেশে তিনি কঠোর ভাষায় বলেছেন যে, যদি তাঁর মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত তাহলে তাকেও তিনি একই শাস্তি দিতেন। যে সমাজে নারীদের কোনো সম্মান ছিল না, তাদেরকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিত সেখানে তিনি নারীদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গেলেন, সমাজের সর্ব অঙ্গনে সম্মানজনক কাজ করার পরিবেশ প্রদান করলেন। মেয়েরা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে, জুমায়, ঈদে অংশ নিত, তারা হাসপাতাল পরিচালনা করত, বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করত। তিনি সর্বক্ষেত্রে মৃত জাতিকে জাগ্রত করে তুললেন। তারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে পারস্য রোমান সাম্রাজ্যকে যুদ্ধে পরাজিত করল। জ্ঞানে বিজ্ঞানে সামরিক শক্তিতে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে তারা পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে আসীন হয়ে গেল। মানব ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর প্রগতির অধ্যায় রচিত হলো। এই কাজটি করাই ছিল নবীর আগমনের উদ্দেশ্য। তিনি হাতে কলমে পুরো আরব উপদ্বীপে সত্য, শান্তি, ন্যায়, ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধ, রক্তপাত, হানাহানি দূর করে দিলেন। বাকি পৃথিবীতে একই কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তাঁর হাতে গড়া জাতিটির উপর। তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে খোলাফায়ে রাশেদিন ও প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী ৬০/৭০ বছর আপ্রাণ সংগ্রাম করে অর্ধেক দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন তওহীদের পতাকা আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত পতপত করে উড়ত। বিশ্বের আর সব জাতি সভয় সম্ভ্রমে মুসলিমদের দিকে চেয়ে থাকত। এই হচ্ছে অতি সংক্ষেপে মহানবীর জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা।
কিন্তু তারপর ঘটল এক মহা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। জাতি তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে গেল। তারা অর্ধেক দুনিয়ার সম্পদ হাতে পেয়ে রাজা-বাদশাহদের মতো ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে গেল। তারা ভুলে গেল যে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি। ভোগবিলাস তাদের সাজে না। তাদের মধ্যে জন্ম নিল মুহাদ্দিস, মুফাসসির অর্থাৎ পণ্ডিত শ্রেণি যারা সংগ্রাম ত্যাগ করে দীনের সূ²াতিসূ² গবেষণায় মগ্ন হলেন। বিরাট বিরাট কেতাব রচনা শুরু করলেন। তাদের এই কাজের ফলে জাতি বহু ফেরকা মাজহাবে বিভক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হলো। ওদিকে পারস্য থেকে ঢুকল ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফিবাদ। এই সুফিবাদের প্রভাবে জাতির একটি পা হারালো, পঙ্গু হয়ে গেল। ইসলামে অবশ্যই দেহ আত্মার সমন্বয়ে গঠিত একটি ভারসাম্যপূর্ণ দীন। এতে শরিয়াহ যেমন আছে মারেফত বা আধ্যাত্মিকতাও আছে। কিন্তু বিকৃত সুফিবাদ এসে সেই ভারসাম্যকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে জাতিকে অন্তর্মুখী করে দিল। যে জাতি সংগ্রাম করে দীন প্রতিষ্ঠার জন্য দাঁড়িয়েছিল সেই জাতি চোখ বন্ধ করে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা করতে লাগল। আর সাধারণ মানুষও এই সমস্ত তরিকা ফেরকা দলে মাজহাবে বিভক্ত হয়ে অন্তর্মুখী, স্থবির, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেল। কর্মসূচির ঐ পাঁচদফা চরিত্র হারিয়ে যাওয়ার অনিবার্য ফল হলো পরাজয়। তারা হালাকু খানের আগ্রাসনের শিকার হয়ে খলিফাসহ লাখে লাখে মারা পড়ল। তবু তারা বিতর্ক থেকে বিরত হলো না, ঐক্যবদ্ধ হতে পারল না। এরপর আল্লাহ তাদেরকে চ‚ড়ান্ত শাস্তিরূপে ইউরোপীয় ছোট ছোট খ্রিষ্টান জাতিগুলোর দাস বানিয়ে দিলেন। সেই দাসত্ব আজও চলছে। মাঝখানে তারা স্বাধীনতার নাম করে কিছু ভূখণ্ড দিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, বিচারিক, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো তাদেরই রয়ে গেছে। এই মানসিক দাসত্ব দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এখন এই জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য জঙ্গিবাদের ইস্যু সৃষ্টি করে দিয়ে একটার পর একটা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেন ইত্যাদি ধ্বংস করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে মুসলিম জতির সাড়ে ছয় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু, লাখ লাখ নারী ইজ্জতহারা, ইউরোপের নানাদেশে তারা ভিক্ষা করছে। এ অবস্থায় জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করাই যখন মুখ্য কর্তব্য তখন ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হবে নাকি সিরাতুন্নবী বলা হবে এ নিয়ে বিতর্ক, বাহাস, মারামারি করা কতটা নির্বুদ্ধিতা, মূঢ়তা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাই হোক, আজ এমন একটি দিন যেদিন গবেষকদের মতে রসুলাল্লাহর জন্মদিন ও ওফাত দিবস। এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আমরা তাঁর সেই আরাধ্য কাজ অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীময় সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবন থেকে অন্যায় অবিচার দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজেদের জীবন সম্পদ উৎসর্গ করব। তিনি যে তওহীদের সুতোয় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গেছেন আমার আবারও সেই তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবো। আমরা সকল জাতিবিনশী ফেরকা-মাজহাব, তরিকা, দল উপদল ভুলে একজাতিতে পরিণত হবো। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গড়ে তুলব।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...