হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আরবীয় সংস্কৃতিকে ইসলাম মনে করা ইসলামের অন্যতম বিকৃতি

মুস্তাফিজ শিহাব:
বর্তমানে পৃথিবীতে যতগুলি ধর্ম প্রচলিত রয়েছে তাদের প্রতিটির মধ্যে সময়ের বিবর্তনে আর ইবলিসের প্ররোচনায় বিকৃতি এসেছে। ইসলামের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। এর ফলে এক কালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম জাতি আর ইসলামের অনুসারী হয়েও নিকৃষ্টতম জাতিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের এইসব বিকৃতির হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করার জন্য আলেমদের বড় ভূমিকা থাকবে এমনটাই আশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু বেশ কিছু বিষয় এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের আলেম সাহেবদের বড় ব্যর্থতা হলো ইসলামকে বর্তমান যুগের উপযোগী হিসাবে উপস্থাপন করতে না পারা। তারা হাজার বছর আগের রচনা করা মাসলা মাসায়েল আর ফতোয়াগুলোকে দিয়ে আধুনিক দুনিয়া চালাতে চান। ইসলাম কে তারা সর্বাধুনিক বলেন মুখে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর পরিবর্তনশীলতাকে অস্বীকার করেন এবং ক্ষিপ্ত হয়ে যান। ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলেই তারা প্রাচীন ফিকাহ আর ফতোয়ার কেতাব নিয়ে বসেন। পাঁচশ বছর আগের খোতবা এখনো মসজিদে পড়ে শোনান। এসব ফতোয়ার বিপরীতে যুক্তি, বিবেকের দাবি দূরে থাক কোর’আনকে মানতেও অনেকে নারাজ। আকাশের যত তারা ফতোয়ার তত ধারা। সুতরাং ইসলাম তাদের কুক্ষিগত থাকতে বাধ্য, জনগণ কোনোদিন ইসলাম বুঝতে সক্ষম হোক এটা তারা হতে দেবেন না।
আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহর (সা.) উপর যে কেতাব নাজিল হয়েছিল সেই কেতাব কোর’আন হচ্ছে এমন কিছু মূলনীতির সংকলন যেগুলো শ্বাশ্বত ও চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন কোর’আনে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। ঐক্য মানেই শক্তি, এ কথাটি লক্ষ বছর আগেও সত্য ছিল, এখনও সত্য। কোর’আনে দীনের মূলনীতিগুলো এমন যেগুলো কেয়ামত পর্যন্তই অপরিবর্তনীয়। পরিবর্তন করলে বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) সে সময়ের আরবদের জন্য উপযোগী করে, তাদের জীবনের সাথে মিলিয়ে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছেন। আরবীয়রা আগে থেকে যে পোশাক পরত রসুল তাদেরকে ভিন্ন কোনো পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেন নি। আবার অনারব কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকেও আরবীয় পোশাক পরতে বাধ্য করেন নি। কেননা ইসলামে পুরুষের পোশাকের নীতিমালা হচ্ছে সতর ঢাকা আর সেটা হচ্ছে নাভি থেকে হাঁটু অবধি। আপনি যে কোনো পোশাক দিয়ে যদি এটুকু আবৃত রাখেন ইসলাম তাতে কোনো বিধিনিষেধ দেয় না। রসুল নিজেও আরবের পোশাক ও খাদ্যে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কথাগুলোই হাদিসে এসেছে।
এখন সমস্যা হচ্ছে আমাদের আলেম সাহেবরা সেই আরবীয় প্রেক্ষাপটকেই ইসলাম বানিয়ে নিয়েছেন। তাদের কাছে আরবী ইসলামের ভাষা, খেজুর খাওয়া সুন্নত, দাড়ি রাখা, আরবীয় পোশাক, চেক রুমাল, পাগড়ি পরা সুন্নত। তারা এটা বুঝতে নারাজ যে, আল্লাহর রসুল অন্য দেশে আসলে তিনি সে দেশের ভাষায়ই কথা বলতেন, সে দেশের খাদ্যই খেতেন। তারা সেই আরবীয় সংস্কৃতিগুলোকে ইসলাম মনে করে সেগুলোকে মুসলিমদের উপর চাপানোর জন্য মরিয়া। কেউ উত্তম মুসলিম হতে গেলে প্রথমেই তাকে দাড়ি, টুপি, লেবাস ইত্যাদির শর্ত পূরণ করতে হবে। শার্ট প্যান্ট টি শার্ট জিন্স তাই কোনো ক্রমেই ইসলামিক নয়। ১৪০০ বছরে মানুষের রুচি অভিরুচিতে বিবর্তন সাধিত হবে এটা খুব স্বাভাবিক ও সময়ের বৈশিষ্ট্য। এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করে কোনো জীবনব্যবস্থাই টিকে থাকতে পারে না। এই দীর্ঘ সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে যার মূলে মুসলিম বিজ্ঞানীদেরও অনেক অবদান ছিল। এই যে বিবর্তিত সময় উপস্থিত হয়েছে এই গতিশীল যুগেও যুক্তি ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক ইত্যাদি যাবতীয় সমস্যার সমাধান যে ইসলাম করতে পারে, ইসলাম সারা দুনিয়াকে আরব বানাতে চায় না এইভাবে ইসলামটাকে উপস্থাপন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এখনও সেই পুরনো যুগে যে সমাধানগুলো দিয়ে এ যুগের সমস্যাকে মোকাবেলা করতে উৎসুক। এক হাজার বছর আগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে সমস্যার যে সমাধান ইমাম গাজ্জালী বা ইমাম আবু হানিফারা দিয়ে গেছেন সেই ওখান থেকে সরে আসাকে তারা ইসলাম ত্যাগ করার মতো গর্হিত অপরাধ জ্ঞান করেন। তারা এটা বুঝতে অক্ষম যে, আল্লাহর রসুলের হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদীর পরবর্তী যুগের ফেরকা মাজহাবের আলেম ওলামাদের অতিবিশ্লেষণের ফসল হিসাবে যে জটিল, দুর্বোধ্য ইসলামটি দাঁড়িয়ে গেছে সেটা সেই যুগে হয়তো জোর করে চালানো গেছে, কিন্তু এই যুগে তা বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে বাধ্য।
যুগের সাথে খাপ খাচ্ছে না বলে মানুষ তা গণহারে প্রত্যাখ্যান করছে তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ছে জোর করার – অথচ দীনের মূল নীতির একটি হচ্ছে – দীনের মধ্যে কোনো জবরদস্তি নেই। তারা বলছেন নারীদের ঘরে থাকতে হবে, নারী নেতৃত্ব হারাম, ছেলেদের দাড়ি রাখতে হবে, আরবীয় লেবাস পরতে হবে, নাচ-গান-ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি সব হারাম। কোর’আন এগুলোর একটাকেও প্রত্যক্ষভাবে হারাম করে নি, কিন্তু ফতোয়া দিয়ে সবই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।
তাদের হাতে থাকা কেতাবি ইসলামটা কতটুকু অন্ধ, তার গতিপ্রকৃতি কী – তার বাস্তব নিদর্শন কথিত জঙ্গিবাদীদের কার্যকলাপ, যা ইসলামভীতির সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত ইসলাম তো অন্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা এমন ঘৃণিত হয় নি? প্রকৃত ইসলাম যে এমন ছিল না, এ সরল কথাটি বোঝার জন্য যে মানবিক হৃদয় লাগে সেটার কবর তারা বহু বছর আগেই রচনা করেছেন। তাদের হৃদয়ে মোহর, চোখে পর্দা, কানে তালা।
বর্তমানে ইসলামের মধ্যে যে বহুবিধ বিকৃতি প্রবেশ করেছে আরবীয় সংস্কৃতিকে ইসলামের সাথে গুলিয়ে ফেলা তার একটি। ইসলামের যা কিছু মৌলিক নীতি তা কোর’আনে আছে, সেগুলো কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু যে বিষয়গুলো একান্তই পারিপার্শ্বিকতার উপর নির্ভর করে সে বিষয়গুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকাটা এক প্রকার অন্ধত্ব- এটা বুঝে ইসলামের মূলনীতিগুলোর অগ্রাধিকার দিতে হবে। যারা ইসলামকে আবারো এই যুগে জীবনব্যবস্থা হিসাবে দেখতে চান, যারা ইসলামের বিশেষজ্ঞ তাদের এটুকু বিবেচনা করতে হবে যে, ইসলাম সারা পৃথিবীকে আরব দেশ বানাতে আসে নি, মরুভূমির বিধান নদীমাতৃক বা বনাঞ্চলে চলবে না। ইসলাম এসেছে সর্বযুগের জন্য, সব পরিবেশের জন্য। এটা যদি আমরা না বুঝি, আকাশের মতো উদার ইসলামকে স্থান কাল পাত্রের ক্ষুদ্রতায় বন্দী করে রাখি তাহলে আমাদের এই কূপমণ্ডুক চিন্তাধারার দায় আল্লাহ-রসুলের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং এতে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা আরো বিনষ্ট হবে, ইসলামের আরো বদনাম হবে।
(লেখক: সহকারী সহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...