হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সংকটে বাংলাদেশ: আমরা নির্বিকার থাকতে পারি না

 -রিয়াদুল হাসান

আমাদের দেশের হাজারো সমস্যা, গুনে শেষ করা যাবে না। জীবনের প্রতিটি অঙ্গন ভয়াবহ রকমের অব্যবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। নিত্যব্যবহার্য পণ্য, খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল, পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক, প্রশ্ন ফাঁস, শিক্ষা-চিকিৎসা সবকিছুর বাণিজ্যকরণ, সীমাহীন দুর্নীতি, ঘুষ, অবিচার ইত্যাদি মানুষের জীবনকে নিদারুণ অসহায় করে তুলেছে। প্রতিটি মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে, সবাইকে তাড়া করে ফিরছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার ভাবনা। টাকাই যেন সব, টাকা ছাড়া কোনো মানুষের মূল্য নেই। পশ্চিমা বস্তুবাদী জীবনধারা ধীরে ধীরে মানবজাতির মনুষ্যত্বকে গ্রাস করে নিয়ে তাদেরকে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক আর অর্থপিশাচ বানিয়ে ফেলেছে।
রোগ বহুরকম আছে কিন্তু প্রাণঘাতী রোগ হলে মানুষ যেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং চিকিৎসার জন্য সবকিছু বাজি রাখে, তেমনি আমাদের এই ১৬ কোটি মানুষ যারা হাজারো সমস্যায় আক্রান্ত, তাদেরকে এখন বুঝতে হবে যে এই ব্যাধিগুলোর মধ্যে কোন ব্যাধিটি অবশ্যই তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা নিছক সম্ভাবনার কথা বলছি না, বলছি দাঁড়াবেই। সেগুলো হচ্ছে (১) বৈদেশিক ষড়যন্ত্র (২) ধর্মীয় উগ্রপন্থা (৩) রাজনীতির নামে শত্র“তা (৪) তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কথায় বলে বিপদ একা আসে না। এই সমস্যাগুলোও একে অপরের হাত ধরাধরি করে আছে। ডাক্তার যদি সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় না করতে পারে তাহলে রোগীর যেমন দফারফা হয়, তেমনি আমাদের অস্তিত্বের সংকট কোনটি তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ মঙ্গল গ্রহে অবস্থিত নয়, পৃথিবীতে অবস্থিত। আর বর্তমানে গোটা পৃথিবী একটি গ্রামের মতো। আগে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে যে সময় লাগতো, এখন সেই সময়ে পৃথিবীর অপর প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। একটি সংবাদ সেকেন্ডের মধ্যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বহির্বিশ্ব কথাটি এই বিশ্বায়নের যুগে অবান্তর হয়ে গেছে। তাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যা ফেরানোর কোনো পথ এখনো পাওয়া যায় নি, সেই যুদ্ধ শুরু হলে আমরাও তা থেকে নিজেদেরকে পৃথক রাখতে পারব না। জাতিসংঘ শান্তি মিশন ইত্যাদিতে আমাদের সেনাবাহিনী নাম কুড়িয়েছে। এ থেকে আমরা সুনাম, সম্মান বা অর্থ লাভ করলেও আমরা যখন বিপদে পড়ব তখন ঔ পশ্চিমারা এই গরিব দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় কতটুকু সক্রিয় হবে সে বিষয়ে সন্দেহের কারণ আছে, বিগত ৫০ বছরে তাদের কূটনীতি-রাজনীতি ও সামরিক কর্মকাণ্ড মুসলিম নামধারী জাতিকে কী দিয়েচে তা বিবেচনা করলেই সন্দেহের কারণ বুঝতে কষ্ট হবে না। আসন্ন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা বা রাশিয়া কোনো একপক্ষে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশকে জড়াতেই হবে। বিশেষ করে জীবন দেওয়ার জন্য দাসদেরকেই তারা অগ্রাধিকার দেয়।
নদীর তট থাকে কিন্তু বন্যার কোনো তট থাকে না। বিশ্বযুদ্ধ এমনই এক বন্যা যা কাউকে তটে দাঁড়িয়ে ঢেউ গোনার সুযোগ দেবে না। সবাইকে ডুবিয়ে ছাড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নব্বই পর্যন্ত যে শীতল যুদ্ধ চলেছে ক্রেমলিনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের তা বাস্তবযুদ্ধে পরিণত হতে পারে নি উভয়পক্ষের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র থাকার দরুন। আমি গুলি করলে আমাকেও সে গুলি করবে- এই চিন্তা থেকেই দুই অস্ত্রধারী রাষ্ট্র একে অপরের দিকে অস্ত্র তুলে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের পর মনে হয়েছিল যে, বাঁচা গেল। কিন্তু এভাবে বাঁচা যায় না। গত তিন যুগে আমেরিকা একদিনও যুদ্ধ ছাড়া থাকে নি। যুদ্ধই তাদের পররাষ্ট্রনীতি, অস্ত্রব্যবসাই তাদের মূল ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বাজেটের অধিকাংশ অর্থ বরাদ্দ সামরিক খাতে। এদিকে রাশিয়া কোনো যুদ্ধ করে নি, তারা শক্তি ও মনোবল সঞ্চয় করেছে। অযাচিত মোড়লিপনা, স্বৈরাচারিতা, আধিপত্যবাদ, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানো এবং তাদের নিয়ে ন্যাজে খেলা ইত্যাদি কারণে আমেরিকার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। তাই আবার অস্ত্র তুলে নিয়েছে রাশিয়া, বিশ্বে ভারসাম্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখছে পতিত কম্যুনিস্ট বেল্ট। আমেরিকাও এখন ন্যাটোর শক্তিতে বলিয়ান। কেউ বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী ছাড় দেবে না। একগুঁয়ে হঠকারি বাশার আল আসাদ আর ধর্মোন্মাদ আই.এস ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই যুদ্ধের ইন্ধনমাত্র। যুদ্ধক্ষেত্র হচ্ছে আরববিশ্ব-মধ্যপ্রাচ্য আর বলির পাঠা বা পাটার মরিচ হচ্ছে নিরীহ বেসামরিক জনগণ। সেখান থেকে বিস্তার লাভ করবে অন্যান্য দেশগুলোতে। লক্ষ্যভেদী মিসাইলের যুগ, বোমা ফেলতে কাউকে বিমানও পাঠাতে হবে না। বাংলাদেশ যে পক্ষেই সমর্থন দিক অপরপক্ষের মিসাইলের টার্গেটে পরিণত হবে। আমাদের এই ছোট একটি দেশ ধ্বংস করতে কয়টা মিসাইল লাগবে সেটা বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।
যদি পরিস্থিতির বড় কোনো ‘পরিবর্তন’ সাধন না করা যায় তাহলে বাংলাদেশেরও পরিণতি সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশের মতো হবে এক কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ:
(১) আমাদের দেশে ১৫ কোটি মুসলিম নামধারী জনগোষ্ঠী বাস করে। আফগানযুদ্ধ ফেরত জঙ্গিরা নব্বইয়ের দশকে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জঙ্গি দল গড়ে তোলে। আমাদের দেশেও ইসলামের নামে এই মারাত্মক পথভ্রষ্টতা ছড়িয়ে পড়ে। তারা কোর’আন হাদিস থেকে জেহাদ ও কেতালের আয়াত, রসুলাল্লাহর যুদ্ধপূর্ণ জীবনের নানা ঘটনার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এই উপসংহারে উপনীত হয়েছে যে, এখনই জেহাদের সময়। তাদের ওয়াজে হাজার হাজার মানুষ গোপনে জঙ্গি দলগুলোর সদস্য হয়েছে। গত দেড়যুগে এই সব দলের অগণিত সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। এটা ঠিক যে অনেকে প্রপাগান্ডারও স্বীকার হয়েছে। আমাদের দেশে জঙ্গি হামলায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। আদালতে, ভিন্নধর্মের উপাসনালয়ে, সিনেমা হলে, উদিচির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, রমনা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা, পল্টনে গ্রেনেড হামলা ইত্যাদি বহু ঘটনা আমাদের দেশে ঘটেছে যার জন্য এই ধর্মান্ধগোষ্ঠীকেই দায়ী করা হয়। এরা সশস্ত্র পন্থায় প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে তাদের দৃষ্টিতে ‘ইসলাম’ কায়েম করতে চায়, যদিও তারা যেটাকে ইসলাম মনে করছে সেটা ইসলাম নয়, ইসলামের নামে একটি ভয়ংকর বিকৃতি মাত্র। এই বিকৃতিকে সরকার অপনোদন করতে পারে নি, শুধু জোর করে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কোনোদিন জোর কোরে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয় না, কোনোদিন সম্ভব হয় নি এবং হবেও না।
(২) আমাদের দেশে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করা ধর্মজীবীরা ধর্মের প্রকৃত রূপ না জানলেও তারাই ধর্মের ধ্বজাধারী। মানুষ তাদের কথায় প্রভাবিত হয়। এই ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বা অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে তাদেরকে দিয়ে বহু ধ্বংসাত্মক কাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা ব্লগ, কার্টুন, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে কৃত ধর্ম অবমাননার ইস্যুতে সারা দেশে আন্দোলন করেছে, হরতাল-অবরোধ করেছে, গাড়ি ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও করেছে, এমন কি সরকারের পতন ঘটানোর প্রকাশ্য হুমকি দিয়ে লক্ষ লক্ষ ‘তওহীদি জনতা’-র সমাবেশ ঘটিয়েছে। প্রতিবারই সরকার তার ক্ষমতা খাটিয়ে জোরপূর্বক তাদেরকে দমন করেছে, বহুলোক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। তাদের ভেতরে ক্ষোভ দিনে দিনে পুঞ্জিভূত হচ্ছে। ভূ-অভ্যন্তরস্থ গ্যাসের চাপ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তা জ্বালামুখ নিজেই তৈরি করে নেয় এবং অগ্নুৎপাৎ ঘটায়। কেউ তা দাবিয়ে রাখতে পারে না।
(৩) আমাদের দেশে ইসলামের নামে স্বার্থের রাজনীতির পতন হয়ে গেছে। এদের নেতৃবৃন্দ অনেকেই কারাগারে। বাইরে যারা আছে তাদেরকে মামলার ভারে জর্জরিত করে ফেলা হয়েছে। ফলে তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় চেতনার অপব্যবহার করে তারা স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিল কিন্তু সেটাও ধর্মীয় চেতনাই। মেরে কেটে এই চেতনা মানুষের হৃদয় থেকে নির্মূল করা যায় না। বিশ্বে যতগুলো রাজনীতিক দল ইসলামের নামে গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি করেছে তাদেরকে দমন-পীড়ন করা হলে তারা জঙ্গি দলে যোগ দিয়েছে। ইখওয়ান যোগ দিয়েছে বোকো হারামে। আমাদের দেশেও একই যাত্রায় পৃথক ফল হবে না। মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা জেহাদের চেতনা লালন করে, মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণ আশা করে তারা আইএস-কে তাদের আশা ভরসার স্থল মনে করছে। কারণ আইএস পশ্চিমাদের মদদে এখন বড় একটি শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যুদ্ধের পেছনে ধর্মীয় বিশ্বাস কাজ করে তখন তা একজন যোদ্ধাকে অসীম শক্তির আধারে পরিণত করে। সে বিশ্বাস করে যে আমি এই যুদ্ধে যদি নিহত হই তাহলেই চূড়ান্ত সাফল্য পাব। এখানে মৃত্যুর মাধ্যমে সে কিছুই হারায় না বরং তার সবচেয়ে কাক্সিক্ষত বস্তু আল্লাহর সান্নিধ্য হাসিল করে। এমন যোদ্ধাকে হত্যা করা যায় কিন্তু তার চেতনা আরো বহু যোদ্ধার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এটা তাদের কাছে চাকরি না, এটা তাদের কাছে ধর্মযুদ্ধ। কিন্তু তাদের এই চেতনা আজ ব্যবহৃত হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠী ও ইসলামেরই বিরুদ্ধে। এতে লাভবান হচ্ছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। তারা মুসলিমদের একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করে দিয়ে সেখানে অস্ত্র বিক্রি করছে। মারছে মুসলিম মরছে মুসলিম উদ্বাস্তু হচ্ছে মুসলিম। তথাপি অবদমিত ইসলামিক চেতনাবাজ দলের কর্মীরা আইএসের বিজয়ে উদ্বেলিত হয়। এভাবে জঙ্গিবাদের আমদানি-রপ্তানি হয়। উদ্বেলিত হয় জঙ্গিদলগুলো, মাদ্রাসাশিক্ষিত বিরাট জনগোষ্ঠী এবং সেই সাথে লক্ষ-কোটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষও। নজরুল লিখেছিলেন:
এই যৌবন জল-তরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া বালির বাধ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাঁদ?
এদিকে পশ্চিমা জড়বাদী ধর্মহীন আত্মাহীন ভোগবাদী সভ্যতার নামে প্রচলিত অসভ্যতা, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, একচক্ষু মিডিয়ার অবিশ্রান্ত প্রচারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম জাতির মধ্যে বিরাট একটি অংশ ধর্মবিদ্বেষী হয়ে গেছে। তারা প্রচলিত ধর্মের কূপমণ্ডূকতা, ধর্মব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক আচার-বিচার, ফতোয়াবাজি, অন্ধত্ব দেখে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কেননা ধর্মের প্রকৃত রূপটি তাদের সামনে তুলে ধরা হয় না, কারণ প্রকৃত ধর্ম তো ১৩০০ বছর আগেই হারিয়ে গেছে। বর্তমানের প্রচলিত বিকৃত ধর্মগুলো আলোর বদলে এখন কালিই ছড়াচ্ছে। এই ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণিটি প্রায়ই উস্কানিমূলক কথা বার্তা বলে ধর্মান্ধদের হাতে সহিংসতা ঘটানোর ইস্যু তুলে দেয়। ধর্মের অন্ধ বিদ্বেষ যেমন অকল্যাণকর, ধর্মের নামে অন্ধত্বও অনুরূপ জাতিবিনাশী- এ সত্যটি উভয় পক্ষকেই বোঝাতে হবে।
১৫ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করার সম্ভাব্যতা যদি নির্মূল না করা যায় তাহলে অবশ্যই এখানেও ধর্মব্যবসায়ীরা রণক্ষেত্র তৈরি করে ছাড়বে। তারা না করলেও বৈদেশিক ষড়যন্ত্র বসে থাকবে না। একদিকে চলছে ব্লগার হত্যা, অপরদিকে বিদেশি নাগরিক হত্যা, গির্জার ফাদারকে হত্যা। আবার চলছে মন্দিরে সাম্প্রদায়িক হামলা, শিয়াদের হোসেনি দালানে বোমা হামলা। এসবের মাধ্যমে দেশকে একটি জঙ্গি-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী রাষ্ট্ররূপে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাগী আসামি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সব দেশ আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দিচ্ছে, সতর্কতা জারি করছে যা বাণিজ্যিক অবরোধেরই নামান্তর। এসবের উদ্দেশ্য বোঝা খুবই সহজ।
এদেশের দুটি প্রধান রাজনীতিক দল। সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী দেশে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সফল না হয়ে প্রভুরাষ্ট্র ব্রিটেনে আছেন। দেশে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কিংবা সৃষ্টির পরিকল্পনা কিংবা সম্ভাবনা থাকলে রাজনীতিক নেতানেত্রীরা বিদেশে গিয়ে সপরিবারে আশ্রয় নেন যেন দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও নিজে সুখে থাকতে পারেন। এই স্বার্থের রাজনীতিক ১৬ কোটি মানুষকে শত ভাগে বিভক্ত করে এককে অপরের শত্র“ বানিয়ে রেখেছে। জাতির যে কোনো সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এক নম্বর শর্ত হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। আমরা জাতীয় ঐক্যের স্বাদ পেয়েছিলাম শেষ ১৯৭১ সনে। তারপর থেকে কেবল অনৈক্যের গরলই পান করে চলেছি। বছরের পর বছর নেতাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, সংসদ ভবনে পারলে তারা মারামারি করেন, যদিও কয়েক বছর সংসদই কার্যত না থাকায় এই লজ্জাজনক দৃশ্য আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে না। ক্ষমতার লড়াই এমনই পাশবিক যে আমাদের নেতা-নেত্রীরা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে একে নিজেদের ব্যক্তিগত শত্র“তায় পরিণত করেছেন। তাদের পারস্পরিক হানাহানিতে জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তবু তারা হাস্যকরভাবে গণতন্ত্রমনা, অভ্যাসে ভোট দিয়ে যায়। না দিলেও অবশ্য এখন অসুবিধা হয় না, কেউ না কেউ জয়ী হয়ে যায়। রাজনীতিকরা এখন আর ভোটারের উপর নির্ভর করে না, ভাড়াটে সন্ত্রাসীর উপর নির্ভর করে।
রাজনীতিক দলগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মীরজাফরের মতো বিদেশি শত্র“দের সঙ্গে হাত মেলায়, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না যে মীরজাফর দুই দিন নবাব থাকলেও ইতিহাসে তার ঠাঁই হয়েছিল বেঈমানের তালিকায়। এভাবে তারা নিজেদের দেশকে বিপন্ন করে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়।
ক্ষোভ ও বিকৃত জঙ্গি মতবাদ দ্বারা প্রণোদিত হয়ে এভাবেই ক্রমশ জঙ্গিমনস্ক হয়ে উঠছে বিরাট সংখ্যক তরুণ যাদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিত আছে, সাধারণ শিক্ষিতও আছে। তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে থাকলেও যে কোনো ইস্যুতে এক হয়ে যেতে সময় লাগবে না। জনপ্রিয়তা না থাকায় সরকার এখন দুর্বল, তারা নিজেরাও অন্তর্কোন্দলে লিপ্ত। কেউ যদি এই বাস্তবতাকে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চান, কিছু করার নেই। ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য সমুদ্র জয়, পদকপ্রাপ্তি ইত্যাদি সফলতার প্রদর্শনী যতই করা হোক, জনগণের কাছে এসবের তেমন কোনো মূল্য নেই। এগুলো বড় কোনো সংকট থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারবে না। সামান্য নো ভ্যাট আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা যারা কোনোকালে রাজনীতি করে নি, তারা রাজধানী অচল করে দিয়ে সরকারকে বাধ্য করেছে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে। একজন শিক্ষার্থীর গায়ে যদি পুলিশ হাত তুলতো কেউ আর সেই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। এখন এভাবে যে কেউ চাইলে দেশ অচল করে দিতে পারে, কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেও সরকারবিরোধী শক্তি দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে। বেতন ভাতা দ্বিগুণ করে কোনোমতে সন্তুষ্ট রাখতে হচ্ছে তাদেরকে। দুর্নীতি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকাংশেরই নৈতিকতা শেষ হয়ে গেছে, এটা তাদের কাছে কোনো অন্যায়ই নয়। এই প্রতিটি দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে দেশটি বর্তমানে কতটা ঠুনকো অবস্থায় আছে। বলা হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু নানা কারণে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে অনেক অবনতি হয়েছে আমাদের, বাংলাদেশ রাশিয়াপন্থী হয়ে পড়েছে। এই মেরুবদলও দেশের জন্য অন্যতম হুমকি।
এগুলোই হচ্ছে সেই রোগ যা এদেশটিকে সিরিয়া-ইরাক বানিয়ে ফেলতে পারে যে কোনো সময়ে। তাই এখনো সময় আছে, এখনো যদি আমরা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি, তাহলে এ রোগের নিরাময় হতে পারে। সেই নিরাময় হচ্ছে, দল-মত নির্বিশেষে ষোল কোটি মানুষকে দেশের স্বার্থে, অস্তিত্বের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এই ঐক্য হতে হবে অনৈক্যের বিরুদ্ধে। কী কী উপাদান দেশের বিপর্যয় ডেকে আনে তা পূর্বেই বলেছি- ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি, বৈদেশিক ষড়যন্ত্র।
আমরা যদি এই অপশক্তিগুলো বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই তাহলে আমরা শক্তিশালী একটি জাতিসত্ত্বায় পরিণত হবো। যদি কেউ ভাবে যে, ধর্মীয় চেতনাকে অস্বীকার করে দেশপ্রেমের বিভিন্ন চেতনায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করব তাহলে সেটা আর সম্ভব হবে না। কারণ দেশপ্রেম আর চেতনার নামে যে অনাচার আর হুজুগে বাণিজ্য হয়েছে এদেশের মানুষের কাছে ঐসব চেতনা তার গ্রহণযোগ্যতা আর আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইস্যু হচ্ছে ধর্ম। তাই ধর্মীয় চেতনাকে বিশুদ্ধ করে তা ধর্মব্যবসায়ীদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। আমরা একটি দরিদ্র জাতি। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে কোনো পরাশক্তির সামনে অস্ত্রধারণ করার মতো অবস্থা আমাদের নেই। এখন একটাই বড় অস্ত্র আমাদের হতে পারে, তাহলো এই জাতিকে সীসার তৈরি প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ করে ফেলতে হবে। তারা প্রত্যেকে একেকজন সত্যের সৈনিকে পরিণত হবে। তারা ধর্মের অপব্যবহার দেখলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে। কেউ জাতিবিনাশী কোনো কাজ করতে গেলে জনগণই তাকে প্রতিহত করবে। এই যে জাতির জন্য কাজ করা এটাই যে প্রকৃত এবাদত, এই কাজ যারা করবে তারাই যে ধার্মিক এটা জাতির সামনে দলিল-প্রমাণ-যুক্তি ইত্যাদি দিয়ে তুলে ধরতে হবে। তাহলে তারা আর ধর্মব্যবসায়ীদের অন্ধ অনুসরণকে ধর্মজ্ঞান করবে না, ধর্মকে অনাবিলরূপে নতুন আলোয় জানবে। তারা এখনের মতো আত্মচিন্তায় গণ্ডিবদ্ধ থাকবে না। ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক খাতে নিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো চেতনাই এ জাতিকে রক্ষা করতে পারবে না– এ সত্যটি জাতির কর্ণধারেরা যত দ্রুত বুঝবেন ততই জাতি পরিত্রাণের দিকে অগ্রসর হবে। এটা করার জন্য যে আদর্শ দরকার তা আল্লাহর রহমে হেযবুত তওহীদকে আল্লাহ দান করেছেন। ধর্মবিশ্বাস আমাদের এত বৃহৎ একটি সম্পদ যা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে মানুষের অকল্যাণে আর তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। একে এখনই রোধ করতে হবে। পক্ষান্তরে যারা ধর্মপ্রাণ নয় কিন্তু মানবতার কল্যাণকামী তাদেরকেও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে, দেশের জন্য, নিজেদের অস্তিত্বের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবে।
এভাবে ষোল কোটি মানুষ যদি উল্লিখিত অপশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় তাহলে পৃথিবীর পরিস্থিতি যতই ঘোলাটে হোক, এদেশটিকে কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারবে না। আমরা এই ষোলো কোটি মানুষ বিশ্বের বুকে একমাত্র শান্তিময় দেশরূপে বিরাজ করব। সৃষ্টি করতে পারব সত্যিকার কল্যাণ রাষ্ট্রের উদাহরণ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...