হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দীন নিয়ে মতভেদ করা কুফর

রিয়াদুল হাসান:
উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা কুফর। সেই বিভেদ সৃষ্টির কাজ সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে দীনের সূক্ষ্মাকিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে উদ্ভাবিত মাসলা মাসায়েলের নামে। এই কাজটি সাধারণ মানুষ করে নি, করেছেন আলেম, ফকিহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ইমামগণ। দীনের বিষয়ে মতবিরোধকে তারা এত উৎসাহের সাথে করেছেন যে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, তার মতামতের খণ্ডনকেই নিজেদের এলেম প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছেন।
বর্তমানে আমরা দেশজুড়ে যত ওয়াজ মাহফিল দেখি তার অধিকাংশই হলো একটি ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধে আরেকটি ধর্মীয় মতবাদের প্রতিবাদ। বিষয়বস্তুগুলো কেমন? নবীজি নূরের তৈরি নাকি মাটির তৈরি, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নাকি আরশে সমাসীন, আল্লাহর কি হাত পা আছে নাকি তিনি নিরাকার, তারাবি আট রাকাত নাকি বিশ রাকাত, টাই পরা জায়েজ নাকি না-জায়েজ, মিলাদের সময় কেয়াম করতে হবে নাকি বেকেয়াম হবে, সুরা ফাতিহা পড়ার পর আমিন জোরে বলতে হবে নাকি আস্তে বলতে হবে ইত্যাদি নিতান্তই তাত্তি¡ক আর গুরুত্বহীন বিষয়। এগুলো একটাও দীনের মৌলিক বিষয়ের ধারে কাছেও নয়। অথচ এগুলো নিয়েই তারা প্রতিনিয়ত জাতিকে টুকরো টুকরো করে করে চলেছেন।
এর কারণ তারা আসলে এই দীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী সেটাই নিশ্চিতরূপে জানেন না। তাদের কাছে এই দীনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি বেশি আমল করে সওয়াব হাসিল করা। এ জন্য তারা আমল করতে করতে খুঁটিনাটি আমল নিয়েও ফতোয়াবাজি করে চলেছেন। একটি গাড়ি যখন রাস্তা থেকে খাদে পড়ে যায় তখন প্রথম কর্তব্য হচ্ছে সেই খাদ থেকে গাড়িটিকে উদ্ধার করা। সেটা না করে যদি আমরা গাড়িটির ভেঙে যাওয়া হেডলাইট মেরামত করতে শুরু করি সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে, কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
এই দীনটি এসেছে কেন? ইসলামের উদ্দেশ্য কী? এক কথায় এই দীনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর হুকুম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির জীবন থেকে সকল অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ-রক্তপাত নির্ম‚ল করে ন্যায় সুবিচার অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ইবলিসের মোকাবেলায় আল্লাহকে বিজয়ী করা। ইবলিসের চাওয়া হচ্ছে অশান্তি, অবিচার, রক্তপাত। সেটা যতদিন সমাজে বিরাজ করবে ততদিন সে আল্লাহর সাথে কৃত চ্যালেঞ্জে বিজয়ী থাকবে। আল্লাহকে সেই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী করার জন্য একটাই করণীয়, অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। শান্তি আসবে কী করে? একটাই পথ- আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা।
বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে যে অন্যায় অশান্তি যুদ্ধ রক্তপাত বিরাজ করছে তার কারণ হলো, মানুষ এখন আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে ইবলিসের হুকুম অর্থাৎ নিজেদের মনগড়া হুকুম মেনে চলছে। তাদের অর্থনীতি চলছে সুদের ভিত্তিতে যা আল্লাহর দীনে সম্পূর্ণ হারাম। তাদের জীবনের সামষ্টিক অঙ্গনগুলো যথা রাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য, প্রশাসন, রাজনীতি, শিক্ষা, সামরিক বিভাগ ইত্যাদির প্রত্যেকটি চলছে পাশ্চাত্যের তৈরি ব্যবস্থা দিয়ে।
আর আল্লাহর হুকুম টিকে আছে ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র অঙ্গনের সংকীর্ণ পরিসরে। ইসলামের সকল সামষ্টিক আমলগুলোকেও ব্যক্তিগত আমলে পরিণত করা হয়েছে। নামাজ, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি সবই সামষ্টিক বিষয় কিন্তু এখন সেগুলোকে ব্যক্তিগত সওয়াব বা ফজিলতের মাধ্যমে পরিণত করা হয়েছে। আর উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে যে, যত বেশি সম্ভব এই ব্যক্তিগত আমলগুলো করে যাওয়ার জন্য। চেষ্টা করা হচ্ছে নিখুঁতভাবে ওজু করতে, নিখুঁতভাবে ঘড়ি ধরে সেহরি ইফতার করতে, হিসাব করে তসবিহ গুনে জিকির করতে, নারীদেরকে যেন কাকপক্ষীয় দেখতে না পায় সেরকমভাবে পর্দা করতে। এসব আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তর্কাতর্কি করে তারা জাতির মধ্যে শত সহস্র বিভাজন সৃষ্টি করছেন কিন্তু দীন প্রতিষ্ঠা করার, আল্লাহর হুকুমগুলো জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা না করলে যে আল্লাহ ইবলিসের চ্যালেঞ্জে পরাজিত থেকে যাবেন। দীনের আগমনের উদ্দেশ্যই, নবী রসুলদের আগমনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এ কারণেই আল্লাহ বলেছেন, এই দীনকে তোমরা কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে মতভেদ করো না (সুরা শুরা ১৩)। দীন কায়েমের ব্যাপারে তো মাজহাব ফেরকা বের করে লাভ নেই। মাজহাব ফেরকার মাসলা-মাসায়েল আর দণ্ডবিধি সংক্রান্ত রায়, ফতোয়ার বিষয়গুলো আসবে দীন প্রতিষ্ঠার পরে যখন সেটা দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করা হবে তখন। কিন্তু দীন প্রতিষ্ঠার আগেই যদি মতভেদ করে জাতিকে টুকরো টুকরো করে তার শক্তি-সামর্থ্য বিনষ্ট করে ফেলি তাহলে দীনটাই তো প্রতিষ্ঠা হবে না।
যারা মাজহাব মান্য করাকে ফরজ বলেন, ফেরকা মাজহাবের পক্ষে নানারকম যুক্তি দাঁড় করাতে চান তারা সেটা করতে পারেন কিন্তু তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই কাজ করে আপনারা আল্লাহর অভিপ্রায়ের বিপরীত করছেন, পৃথিবীর বুকে ইবলিসকে বিজয়ী রেখে আপনাদের এই সব পাণ্ডিত্য আল্লাহর সন্তোষ উৎপাদন করবে না। মতভেদ রেখে আগে দীন প্রতিষ্ঠা করুন। আগে অন্তত একটা বিষয়ে সকলে একতাবদ্ধ হন যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না। তারপর জীবন-সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করে আল্লাহর সেই হুকুমকে প্রতিষ্ঠা করব। নবীর (সা.) সাহাবীরা কেউ হানাফি, হাম্বলি, শিয়া, সুন্নী ছিলেন না। তারা ছিলেন শুধুই মো’মেন। আসুন আমরা মো’মেন হই। এইসব মতভেদ করে আমরা শক্তিহীন দুর্বল হয়ে পড়েছি। সমগ্র দুনিয়াতে আমাদের কোনো সম্মান নেই, অধিকার নেই, আমাদের নিরাপত্তা নেই। সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান আজ উদ্বাস্তু। একটার পর একটা দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই ক্ষুদ্র দেশে পনেরো কোটি মুসলিম বাস করে। আমরাও তাদের টার্গেটের বাইরে নই। এখনও সময় আছে, যদি আমরা এই একটি সহজ কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে ইনশাল্লাহ আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করবেন। কারণ তিনি মো’মেনের রক্ষাকর্তা, ওয়ালী।
আমার এ কথাগুলো শুনুন। কথাগুলো যদি যৌক্তিক হয়, কল্যাণকর হয় তাহলে আসুন কোনো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মতবিরোধ না টেনে এনে, অযথা আমার লেবাস, চেহারা ইত্যাদি ব্যক্তিগত ত্রুটি সন্ধান না করে ঐক্যবদ্ধ হই। জাতিকে রক্ষা করি, তাহলে নিজেরাও রক্ষা পাব। জাতি ধ্বংস হলে নিজেরাও ধ্বংস হবো।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ফেসবুক: riad.hassan.ht
ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...