হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

তাবুক অভিযানের নেপথ্য কারণ: উম্মাহর অগ্নিপরীক্ষা (প্রথম পর্ব)

এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী:

পৃথিবীর যতোরকম তন্ত্র-মন্ত্র, রংস-পৎধপু, অর্থাৎ এক কথায় জীবন ব্যবস্থা (System of Life), দীন আছে সমস্ত কিছুকে পরাজিত কোরে আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা কোরে সর্বরকম অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর কোরে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ নবী, বিশ্বনবী প্রেরিত হোয়েছেন। সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে এই দীন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এমন একটি জাতি গঠন কোরলেন যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী, মোহাম্মদ (দ:) এর জাতি, যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যারা ছিলো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, ঝড়ের ন্যায় গতিশীল, বজ্রের ন্যায় দুর্নিবার, গলিত সীসার প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ, মালায়েকের মতো সুশৃঙ্খল ও অনুগত, বিস্ফোরণমুখী, বহির্মুখী। মহানবীর এন্তেকালের পর শত্রুর মনে ত্রাসসৃষ্টিকারী মহাজাতি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে অর্ধ পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা কোরেছিল। আর আজ যে জাতিটি মরক্কো থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত মৃত লাশের মতো পড়ে আছে সেটি সর্ব অর্থে, সর্বদিকে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর চরিত্রের ঠিক বিপরীত।

আকিদার বিকৃতির কারণে মোসলেম নামের এই জাতিটি আল্লাহ ও রসুল (দ:) যে দিক পানে এর গতি নির্দিষ্ট কোরে দিয়েছিলেন, তার ঠিক বিপরীত পানে চোলছে এবং চোলছে অতি তাকওয়ার সাথে। এই জাতি একথা বুঝতে পারছেনা যে, আল্লাহ রসুলের পথের বিপরীত দিকে চোললে শত সহস্র তাকওয়াও নিষ্ফল, অর্থহীন, তা তাদের জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না। এই বিপরীত পথ এই জাতিকে নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে এই পৃথিবীতেই অন্য জাতির কাছে পরাজয়, অপমান, ঘৃণিত গোলামিতে এবং পরকালে কঠিন শাস্তির পানে। এবলিসের চ্যালেঞ্জে জয়ী হবার জন্য আল্লাহ তার রসুলকে (দ:) যে দীন জীবন-বিধান দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য পথ, প্রক্রিয়া, তরিকা (Process) স্থির কোরলেন সামরিক। অর্থাৎ আল্লাহ তার প্রেরিতকে (দ:) এই নির্দেশ দিলেন না যে, তুমি মানুষকে বক্তৃতা, ওয়ায কোরে যুক্তি দিয়ে, এই দীনের মাহাত্ম্য-গুণ বর্ণনা কোরে মানুষকে এটা গ্রহণ কোরতে আহ্বান কর। এ নির্দেশও দিলেন না যে তবলীগ কোরে পৃথিবীর মানুষকে এই দীনে প্রবেশ করাও। এ নির্দেশ আল্লাহ দেন নি এই কারণে যে তিনি নিজে এই মানব জাতির স্রষ্টা, তিনি এর মনস্তত্বেরও স্রষ্টা। তাই তিনি জানেন যে এই মানুষের দেহের-মনের ভিতরে শক্তিশালী শয়তানকে প্রবেশ করার অনুমতি দেবার পর খুব কম সংখ্যক মানুষই এমন থাকবে যারা তাদের বিবেক, বুদ্ধি, যুক্তি, ব্যবহার কোরে দীনের এই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে রসুলের (দ:) ঐ আহ্বানকে মেনে নিয়ে এই দীন গ্রহণ কোরবে। কাজেই তিনি তার রসুলকে (দ:) নির্দেশ দিলেন সামরিক শক্তি বলে এই কাজ করার। তার এই আদেশ কোর’আনময় ছড়িয়ে আছে। আল্লাহর এই নীতিকে বুঝে তার রসুল (দ:) ঘোষণা কোরলেন “আমি আদিষ্ট হোয়েছি সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত মানব জাতি এক আল্লাহকে সর্বময় প্রভু বোলে স্বীকার করে এবং আমাকে তার প্রেরিত বোলে মেনে নেয় (আব্দাল্লাহ ইবনে ওমর থেকে বোখারী)।” এ কাজ অর্থাৎ সমস্ত মানব জাতিকে এই দীনের অধীনে আনা এক জীবনে অসম্ভব একথা আহাম্মকও বুঝবে। তাছাড়া সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ঐ কাজ কোরতে গেলে অবশ্যই এমন একটি জাতি গঠন কোরতে হবে- যে জাতির সর্ব প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হবে মৃত্যু ভয়হীন, দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা। যে জাতি সমস্ত কিছু ভুলে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে হবে অনঢ় (হানিফ), ঐক্য হবে ইস্পাত, সবরে (অটলভাবে অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা চালাতে) হবে অদম্য। এর যে কোনটির অভাবে সাফল্য আসবে না। কারণ উদ্দেশ্য, লক্ষ্য অতি বিরাট- সমস্ত মানব জাতির উপর এই জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা। এমনি একটি দুর্দ্ধর্ষ সামরিক জাতি গঠন কোরতে হবে বোলেই আল্লাহ এই জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান ও সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার স্থির কোরলেন ঐ বিরাট ও মহান উদ্দেশ্য অর্জনে যারা সশস্ত্র যুদ্ধে প্রাণ কোরবানি কোরবেন তাদের জন্য। শত সহস্র পাপ গুনাহ কোরলেও তাদের হিসাব নেয়া হবে না, কোন প্রশ্ন করা হবে না, দেহ থেকে আত্মা বের হওয়ার সাথে সাথে তাদের সর্বোত্তম জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তারা মরে গেলেও আমাদের অধিকার দেয়া হোল না তাদের মৃত বলার। আল্লাহর এই একটি মাত্র কাজ থেকেই এ কথা পরিষ্কার হোয়ে যায় যে, এই দীনের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি।

তাবুকের অভিযানের উদ্দেশ্য কি ছিলো?

আল্লাহর রসুলের (দ:) জীবনীর দিকে এক নজর দিলেও এ সত্য প্রকট হোয়ে ওঠে যে তার জাতিটিকে উম্মাহকে একটি ধন-প্রাণ উৎসর্গকারী মৃত্যুভয়হীন দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি রূপে গঠন করাই ছিলো তার সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা। মাত্র তিনশ’ তের জন যোদ্ধা নিয়ে তার প্রথম যুদ্ধ থেকে শুরু কোরে পরবর্তী যুদ্ধ গুলোতে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তার জীবনের শেষ অভিযান তাবুকে তার বাহিনীতে যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ালো ত্রিশ হাজার। তদানীন্তন আরবের জনসংখ্যার দিকে লক্ষ্য কোরলে দেখা যায় এটা একটা বিরাট সংখ্যা। অর্থাৎ ঐ অনুপাতে এই এ দেশে একটি বাহিনী দাঁড় করালে তার সংখ্যা হবে এক কোটিরও বেশি যোদ্ধার। বদর থেকে তাবুকের মাঝখানে আল্লাহর রসুল (দ:) ও ঐ সামরিক জাতির নেতা সাতাশটি যুদ্ধে নিজে নেতৃত্ব দিলেন, নিজে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ কোরলেন নয়টিতে, দারুণভাবে যখম হোলেন। কিন্তু তিনি জানতেন এইই যথেষ্ট নয়, কারণ তিনি জানতেন যে আল্লাহ তার উপর সমস্ত পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠার যে মহাদায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন তা তার এক জীবনে অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই তার অবর্তমানে যে জাতির উপর অর্থাৎ তার উম্মাহর উপর সেই দায়িত্ব অর্পিত হবে সে জাতিকেও সেই সংগ্রামের জন্য তৈরি কোরতে হবে। তাই তার জীবনীতে দেখি তিনি প্রথম দিকের যুদ্ধগুলিতে নিজে নেতৃত্ব দেবার পর অভিযান পাঠাবার সময় অন্য মানুষদের হাতে বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য নতুন নেতৃত্ব নতুন সেনাপতি সৃষ্টি করা, যারা তার পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর এই সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবার উপযুক্ত হবে। যে অভিযানগুলিতে তিনি না গিয়ে অন্যদের সেনাপতি কোরে পাঠিয়েছেন ইসলামের ইতিহাসে সেগুলিকে সারিয়া বলা হয়। সারিয়া শব্দের অর্থ সাধারণতঃ করা হয় রাত্রিকালীন আক্রমণ। এই রকম কয়েকটি বিখ্যাত সারিয়া হোল- ক) নাখলা অভিযান, খ) রাজী অভিযান, গ) বীরে মাউনা, ঘ) মু’তা অভিযান ইত্যাদি। নবী স্বয়ং না গিয়ে অন্যকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হোল এমন ঝড়ের ন্যায় দুর্বার গতিশীল নেতৃত্ব সৃষ্টি করা যারা তাঁর অবর্তমানেও দুর্বার সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।
সারা জীবন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা কোরে এক অজেয় দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি সৃষ্টি করার পর বিশ্বনবীর (দ:) ইচ্ছা হোল পরীক্ষা কোরে দেখা যে তার হাতে গড়া এই জাতিটি সত্যিই কি উপযুক্ত হোয়েছে তার পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তার সুন্নাহ অনুসরণ করার? এই জাতির চরিত্রে কি তিনি সেই দুঃসাহস- আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন শক্তিকে ভয় না করার নির্ভীকতা; নেতার (দ:) সুন্নাহ পালনের জন্য বিষয় সম্পত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য স্ত্রী-পুত্র সমস্ত কিছু কোরবান করার মন দুঃসহ কষ্ট সহ্য করার সবর এবং সর্বোপরি শাহাদাতের জন্য আকুল পিপাসা সৃষ্টি কোরতে পেরেছেন? অর্থাৎ এক কথায় তিনি দেখতে চাইলেন যে তার জীবনের সাধনা সফল হোয়েছে কি হয় নাই। তাই তিনি ডাক দিলেন তাবুক অভিযানে।

তাবুকে কি কোনো যুদ্ধ হোয়েছে?

প্রকৃতপক্ষে তাবুকে কোন যুদ্ধই হয় নি। এমন কি শত্রুপক্ষের যুদ্ধায়োজনের কোন লক্ষণই পরিলক্ষিত হয় নি। তবে তাহোলে মহানবী কেন এত বড় একটি যুদ্ধের আয়োজন কোরলেন? এই অভিযানে যে অন্যান্য অভিযানের মতো ছিলো না তার বেশ কয়েকটা প্রমাণ আছে। কিন্তু তার আগে আমি একথা পরিষ্কার কোরতে চাই যে তাবুক আত্মরক্ষামূলক অভিযান ছিলো না। যখন তাবুকে অভিযানের উদ্দেশ্য আমার কাছে প্রকাশ হোল তখন মনে পড়লো যে এই উম্মাহর অন্যান্য যুদ্ধের মতো তাবুকের অভিযানকেও ইতিহাসে আত্মরক্ষামূলক বোলে বর্ণনা করা হোয়েছে। বলা হোয়েছে যে বণিকদের মারফৎ খবর পাওয়া গিয়েছিল যে রোমনরা মোসলেমদের আক্রমণ করার জন্য সমবেত হোচ্ছে। যারা ইতিহাসে এই কথা লিখেছেন তারা ঐ বণিকদের কোন নাম পরিচয় দেন নি। আল্লাহর রসুল (দ:) এত কাঁচা লোক ছিলেন না যে অমন একটি উড়ো খবর শুনেই তিনি অস্বাভাবিক গরম, ফসল কাটার সময় ইত্যাদি উপেক্ষা কোরে বিরাট বাহিনী নিয়ে বের হোয়ে পড়বেন। মনে রাখতে হবে বিশ্বনবী (দ:) জীবনের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান ছিলো তাবুক। এই অভিযানে যোগ দেয়ার জন্য এবং যার যা সামর্থ্য আছে তা এই অভিযানের আয়োজনের জন্য দান কোরতে তিনি সবাইকে আহ্বান কোরেছিলেন। এ সবই দু’একটা বণিকের মুখের কথায়? যে বণিকদের নাম বা গোত্রের বা কোথাকার কাফেলা তা পর্যন্ত এরা উল্লেখ কোরতে পারেন নি? মহানবী মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম মহাপুরুষ, তাঁর প্রতিটি কথা হিসেব কোরে বলা। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত। তিনি কি মামুলিভাবে হেসে খেলে একটি এতবড় যুদ্ধায়োজন কোরবেন শুধুই এমনি এমনি? নিশ্চয়ই নয়। আসল ব্যাপার যাচাই করার জন্য মহানবীর (দ:) প্রথম প্রামাণ্য জীবনী বের করলাম মোহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের সিরাত রসুলাল্লাহ। বিরাট বই, যাতে তার পূর্ণ জীবনের প্রায় প্রতিটি খুটিনাটি বর্ণনা করা আছে এবং প্রধানত যে বইয়ের উপর ভিত্তি কোরে পরবর্তীতে রসুলাল্লাহর (দ:) বিভিন্ন জীবনী লেখা হোয়েছে। যা ভেবেছিলাম তাই- ইবনে ইসহাকের সিরাতে রসুলাল্লাহর (দ:) রোমান আক্রমণ প্রস্তুতির সম্বন্ধে কোন কথাই নেই, বণিকদের সম্বন্ধে ব অক্ষরও নেই। ইবনে ইসহাক লিখেছেন-“রসুলাল্লাহ (দ:) জিলহজ্ব থেকে রজব পর্যন্ত মদিনায় অবস্থান কোরলেন এবং তারপর বাইযানটাইনদের (রোমান) বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্তুতির আদেশ দিলেন (সিরাত রসুলাল্লাহ (দ:) -মোহাম্মদ বিন ইসহাক, অনুবাদ A.Guillaume, ৬০২ পৃঃ)।” অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীতে এই দীনুল ইসলামকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার জেহাদ ছেড়ে দেবার পর অর্থাৎ আল্লাহর রসুলের (দ:) প্রকৃত সুন্নাহ ত্যাগ কোরে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হোতে বহিষ্কৃত হবার পর জেহাদকে আত্মরক্ষা মূলক বোলে আখ্যায়িত করার যে মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষোচিত চেষ্টা আরম্ভ করা হোয়েছিল তারই ফলে বণিকদের খবরের মিথ্যা বাহানা বহু পরে যোগ করা হোয়েছিল এবং ঐ মিথ্যা ইতিহাসে স্থান কোরে নিয়েছে। (চোলবে…)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...