হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জঙ্গিবাদ: স্রষ্টা পশ্চিমা বিশ্ব, শিকার মোসলেম বিশ্ব (পর্ব: ০৩)

রিয়াদুল হাসান:

বন্দুকের নল ঘুরল এবার ইসলামের দিকে
পূর্ব প্রকাশের পর: হার্ভার্ডের প্রফেসর হানটিংটন ১৯৯৩ সনে ÔThe clash of civilizations?’ নামে যে প্রশ্নটি তুলে দিয়েছেন সেটা ছিল খুবই বাস্তবসম্মত। তিনি তার তত্ত্বে উল্লেখ করেন যে, বিশ্বে শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির পরে বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক ইস্যুর উপর যুদ্ধ হবার আশঙ্কা অনেক কমে এলেও এ যুদ্ধ বাধবার সম্ভাবনা থাকবে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে। হানটিংটনের মতবাদে পশ্চিমা সভ্যতার সাথে মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য-এশিয় মোসলেম দেশগুলো, যেগুলোকে বহু আগেই ‘ক্রিসেন্ট অব ক্রাইসিস’ নামকরণ করা হয়েছিল, এ দু’য়ের মধ্যেই এ সংঘাত হবে। স্মরণ থাকে যে, ইসলাম আবির্ভাবের প্রায় পাঁচশ’ বছর পরে দু’শ’ বছর প্রত্যক্ষভাবে ক্রুসেড এবং ইসলাম আবির্ভাবের পর থেকেই প্রায় দেড় হাজার বছর বছর ধরে পরোক্ষভাবেই দুই সভ্যতার সংঘাত চলছে। হানটিংটনের তত্ত্ব সে ঐতিহাসিক সত্যকেই মনে করিয়ে দেয়। আরো উল্লেখ্য যে, বিগত শতকে বিশ্বজুড়েই মোসলেম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় চেতনার মধ্যে অভূতপূর্ব জাগরণ ও সম্প্রসারণ ঘটেছে যদিও সেই ধর্মটি প্রকৃত ইসলাম নয়।
হানটিংটন বলেছেন, সমাজতন্ত্রের পতনের পর একটি সভ্যতার সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী যেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য সভ্যতার মুখোমুখি অবস্থান। কারণ কোনো ধর্মেই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা নেই। সার্বভৌমত্বসহ রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন ধর্মীয় বা অধর্মীয় মতবাদ হিসাবে গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে কেবলমাত্র একটি জীবনব্যবস্থা, আর তা হলো ইসলাম। এর আছে উজ্জ্বলতম ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সংখ্যায়ও এরা ১৬০ কোটির বিরাট জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের চেতনাও বেশ দানা বেঁধে উঠেছে সম্প্রতি। সুতরাং ইসলামি চেতনার ক্রমাগত উত্থানকে যে করেই হোক ঠেকাতে হবে। পশ্চিমা ষড়যন্ত্রকারীরা কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলার ফন্দি করল। তারা মুসলমানপ্রধান দেশগুলিতে বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দল ও ধর্মব্যবসায়ী আলেম-মোল্লাদের মাধ্যমে এই জাতিটির ধর্মীয় চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে লাগল। উদ্দেশ্য, এই চেতনাকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে ইসলামকেই একটি মানবতাবিরোধী, মহাবর্বর ধর্ম বলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হলো জঙ্গিবাদ, তারপর একটা সময়ে এসে সাজানো হলো টুইন টাওয়ার ধ্বংসের নাটক। এরপর থেকেই ইসলামের এই জেহাদি চেতনার নামকরণ করা হলো- মৌলবাদ, কট্টরপন্থা , উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি।
নিউইউয়র্ক আর পেন্টাগনে হামলার পরের দিন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বুশ এ সন্ত্রাসের হোতা ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ শুরু করবার মত হুমকি দিয়ে বসেন। তিনি কি জানতেন না ‘ক্রুসেড’ শব্দটি সমগ্র মোসলেম বিশ্বের জন্য কত বেদনাদায়ক এবং উত্তেজক শব্দ? এ শব্দটি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা এবং পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। তাই সীমিত আকারে হলেও সমগ্র বিষয়টি বৃহৎ আঙ্গিকে সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। ১৯৯৩ সন থেকে চলে আসা হানটিংটনের বিতর্কিত তত্ত্বটির কথা বারবার সুধি এবং সাংবাদিক মহলে উচ্চারিত হতে থাকে, এমনকি প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিটি মোসলেম দেশকে সভ্যতার সংঘাতের এ তত্ত্ব প্রভাবিত করে তোলে।
৯/১১ এর কয়েকদিন পর (২০ সেপ্টেম্বর) আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ বিশ্বময় সম্প্রচারিত এক ভাষণে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে আহ্বান জানান ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে সঁপে দেবার জন্য এবং বলেন যে, “পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলোকে এ মুহূর্তে নির্ণয় করতে হবে- হয় তারা আমাদের সাথে অথবা সন্ত্রাসীদের সাথে” (Either you are with us, or you are with the terrorists)। জর্জ বুশের এ উক্তি ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে, যার বিশ্লেষণ চলবে বহু সময় ধরে। তার এ উক্তি পৃথিবীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেবে একক বিশ্বশক্তি আমেরিকার ক্ষমতার দম্ভকে। ইতোপূর্বেই সরকারিভাবে ওসামা বিন লাদেনকে এ সন্ত্রাসী হামলার হোতা হিসাবে আখ্যায়িত করার কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্যে আরো আগ বাড়িয়ে বলেন যে, ‘আজ থেকে যে কোনো দেশকে সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি, প্রশিক্ষণ এবং সাহায্যকারী দেশ হিসেবে সনাক্ত করা হলে সে দেশকে আমেরিকা শত্র“ভাবাপন্ন দেশ বলে মনে করবে।’ প্রচুর করতালির মধ্যে মি. বুশ আরো বলেন, ‘আমাদের এ যুদ্ধ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। এ যুদ্ধ হবে অতি দীর্ঘ সময়ের, এত সহজে এ যুদ্ধ শেষ হবার নয়।’ আমেরিকার কংগ্রেস সেদিন বুশকে দ্বিধাহীনভাবে সমর্থন দেয়। আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ, জর্জ বুশ সমগ্র দেশে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করে রণক্ষেত্র দক্ষিণ এশিয়ার দিকে পাঠানোর হুকুম জারি করেন। টার্গেট আল-কায়েদা ও তালেবান নিশ্চিহ্ন করা। তিনি ভুলে গেলেন যে এই আল-কায়েদা আর তালেবান তো তাদেরই সৃষ্টি? বিন লাদেনও তাদেরই একটি প্রোডাক্ট। ব্রিটেনের লেবার পার্টির রাজনীতিক এবং এম.পি. রবিন কুক(Robert Finlayson “Robin” Cook, 28 February 1946 – 6 August 2005)  গার্ডিয়ান পত্রিকায় মৃত্যুর মাত্র একমাস আগে একটি আর্টিকেলে এই সত্যটি স্বীকার করেন। আর্টিকেলে নামটি ছিল তার সত্যনিষ্ঠতা ও সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ: Al-Qaeda as a product of a western intelligence.
এতে তিনি সুস্পষ্টভাষায় বলেন যে, Bin Laden was, though, a product of a monumental miscalculation by Western security agencies. Throughout the 80s he was armed by the CIA and funded by the Saudis to wage jihad against the Russian occupation of Afghanistan.
অর্থাৎ, “বিন লাদেনও ছিলেন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির ধ্বংসাত্মক একটি ভুল হিসাব। পুরো আশির দশকে তিনি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর জন্য অস্ত্র সরবরাহ পেয়েছেন সি.আই.এ-র থেকে এবং অর্থ পেয়েছেন সৌদি আরব থেকে।” ব্রিটেন যে মুহূর্তে ওসামা বিন লাদেনকে খোঁজার নাম করে আফগানিস্তান তছনছ করছে তখন ব্রিটেনেরই এক মৃত্যুপথযাত্রী পার্লামেন্ট মেম্বার যে জবানবন্দী দিয়েছেন সেটা আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছে দেয় যে, ‘USA is a mother of producing Terrorist Groups.’
মাত্র কিছুদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সেক্রেটারি অব স্টেট, সাবেক ফার্স্ট লেডি, প্রবীণ রাজনীতিক মিসেস হিলারি ক্লিনটন এই বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আজকে আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।’ এ কথাগুলি তিনি আগেও বলেছেন, কিছুদিন আগেও (১ জুন ২০১৪) আরেকবার সদম্ভে বললেন যা ফক্স নিউজ, সি.এন.এন-চ্যানেলে বিশ্ববাসী দেখেছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪ এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। ওই প্রকল্পের আওতায় আফগানিস্তানের বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকে সন্ত্রাস ও মারণাস্ত্র সম্পর্কিত অনেক প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কোন কোন অস্ত্র ব্যবহার করলে ভালো হবে এমন তথ্যও অনায়াসে দেয়া হয়েছিল পাঠ্যপুস্তকগুলোতে। তখন ইংরেজি বর্ণমালা পরিচয়ে ‘জে’-তে জেহাদ শেখানো হতো। এমনকি গণনা শেখানোর সময় ৫ বন্দুক + ৫ বন্দুক = ১০ বন্দুক শেখানো হতো।
আজকের আফগানিস্তানের অবস্থার সৃষ্টি বীজ রোপিত হয়েছিল শেষ আফগান রাজা মোহাম্মদ জহির শাহের উৎখাত থেকে। ১৯৭৯ সনে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান দখল করে হয়তো ঐতিহাসিক ভুল করেছিল বলে সামরিক ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করবেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মানবতার বিরুদ্ধে এক বিরাট পাপ করেছিল। এ পাপটি হলো তাদের (রাশিয়ার) এ অভিযানের মধ্য দিয়ে আমেরিকাকে ‘ক্রুসেড’ আর ‘জেহাদ’-কে একত্রিতকরণের সুযোগ করে দেয়া। স্বভাবসিদ্ধ হস্তে আমেরিকা রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে জেহাদীদের লাগিয়েছিল, পরে এ জেহাদিরাই আমেরিকা প্রদত্ত অস্ত্র তাদের দিকেই ঘুরিয়ে দিল, কারণ তাদের মতে ‘প্রকৃত জেহাদ’ আমেরিকার বিরুদ্ধেই হতে হবে।
আমাদের কথা হচ্ছে, আল কায়েদা যদি সন্ত্রাসী হয়ে থাকে, তাহলে যারা একে সৃষ্টি করল তারা কি? আসল কথা হচ্ছে, তখন বিন লাদেনকে তাদের দরকার ছিল, কারণ তারই নেতৃত্বাধীন আল কায়েদার অন্তর্ভুক্ত মোজাহেদিনরা ‘মাল্টিপারপাস ফাইটার’ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসিকে বাস্তবায়ন করে দিয়েছে। যখনই তাদের দরকার ফুরিয়ে গেল তখনই তাদেরকে জেহাদি, জঙ্গি, সন্ত্রাসী বানিয়ে দেওয়া হলো। আবার কিছুদিন আগে গাদ্দাফির সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য এই আল কায়েদাকেই পুনর্বার অস্ত্র, অর্থ যুগিয়ে লিবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই প্রবঞ্চনার শিকার, বুদ্ধিহত গ্লাডিয়েটরদের রক্তে লিবিয়ার মাটি আজও ভিজে আছে। (চলবে..)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...