হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

গল্প নয়, সত্যি; বিদায় হজ্জ

হজ্জের সময় ঘনিয়ে আসল। মক্কায় গিয়ে হজ্জ উদ্যাপন করতে মহানবী (সা.)-এর প্রাণ আকুল হয়ে উঠল। তিনি বহু সহচর সঙ্গে নিয়ে মদীনা হতে যাত্রা করলেন।
মহানবী (সা.)-এর কাফেলা পবিত্রভূমি আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হলো। আরবের চর্তুদিক হতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নরনারী আরাফাতের মুক্ত প্রান্তরে সমবেত হলো।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) অভিভাষণ দিতে দাঁড়িয়া দেখলেন, তাঁর সম্মুখে এক বিপুল জনসমুদ্র আবেগ-হিল্লোলে উদ্বেলিত। মাতাপিতার স্নেহ, বন্ধু-ভ্রাতার প্রীতি, আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধ, সনাতন সমাজের রক্ত ভ্রুকুটি, সম্পদ, স্বাচ্ছন্দ ও বিলাসের আকর্ষণ, জালিমের অকথ্য অত্যাচার সমস্ত উপেক্ষা করে সত্য প্রচারের প্রথম যুগে যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর সহায়তা করেছিলেন, আজ তাঁরা মহা-পুরুষের সঙ্গে আছেন। আরবের নবীন জীবন প্রভাতে যে সমস্ত কুরায়েশ তাঁকে সংকল্পচ্যুত করবার জন্য সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও প্রভুত্বের ডালি নিয়ে প্রলুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছে, যে সব অত্যাচারী তাঁর পথে কাঁটা ছড়িয়েছে, তাঁর উপাসনারত মস্তকের উপর মৃত উটের অন্ত্রভার চাপিয়ে তাঁকে শ্বাসরোধ করে মারবার চেষ্টা করেছে, আজ তাঁরাও তাঁর সম্মুখে ময়দানে উপস্থিত: কিন্তু অন্তরে বিদ্বেষবহ্নি জ্বেলে নয়, ভক্তিপ্লুত চিত্তে। মক্কায় উৎপীড়িত পয়গম্বর দীর্ঘপথ অতিবাহন করে সুদূর তায়েফে উপনীত হয়েছেন, ব্যাকুল কণ্ঠে আহ্বান করেছেন তায়েফ বাসিগণকে ইসরামের শান্তিছায়াতরে, উত্তরে যে নিষ্ঠুরেরা সেদিন কঠিন প্রস্তর নিক্ষেপে তাঁর কোমল অঙ্গে রক্তের প্রবাহ তৈরি করেছে, তারাও আরাফাতে হাযির। সত্য প্রচারে বাধা জন্মাবার জন্য বিরুদ্ধবাদীরা মহানবী (স.)-কে তাঁর সহচরগণসহ অনশনে তিল তিল করে মারবার প্রয়াস পেয়েছে, তাদের নিযুক্ত অগ্নিমূর্তি যুবকেরা তাঁর অস্তিত্বকে দুনিয়া হতে মুছে ফেলবার জন্য খোলা তলোয়ার হাতে নিশীথের অন্ধকারে তাঁর বাসস্থানের দিকে প্রধাবিত হয়েছে, হযরত (স.) অদৃশ্যভাবে গৃহ হতে বের হয়ে মদীনার পথে চলেছেন, দুশমনেরা শিকার-হারা ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের মত দিকে দিকে তাঁকে অন্বেষণ করে ফিরে এসেছে., আজ তারা তাঁর পরম অনুরক্তরূপে হজ্জের জন্য হাযির। হযরত (স.)-এর জন্য মক্কা ও তায়েফের সকল দুয়ার যখন অবরুদ্ধ সেই দুর্দিনে যে মহাপ্রাণ মদীনাবাসীরা তাঁকে বাহু বাড়িয়ে বিপুল সম্মানে আমন্ত্রণ করে ছিলেন এবং তাঁর সমস্ত বিপদ-আপদকে আনন্দে নিজেদের স্কন্দে গ্রহণ করে ছিলেন, সেই আনসারগণও তাঁর সান্নিধ্যে উপস্থিত। হযরত (স.) মদীনায় হিজরত করেছেন, সেখানে দুশমনেরা তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করেছে, বার বার সমর-অভিযান দ্বারা তাঁর আশ্রয়দাতা আনসারগণসহ তাঁকে পিষে ফেলতে প্রয়াস পেয়েছে, তাঁর হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আজ তাদের সে বিদ্বেষ-বহ্নি নির্বাপিত, সে শাণিত তরবারি কোষবদ্ধ। আজ তারা ইসরামের ভক্ত সেবকরূপে তাহাদের মহানবী (স.)-এর উপদেশামৃত পান করবার জন্য পিপাসার্ত।
মহানবী (স.) নির্নিমেষ নেত্রে সম্মুখস্থ জনসংঘ নিরীক্ষণ করলেন। এই অভূত-পূর্ব দৃশ্য দর্শনে তাঁর চিত্তপারাবার উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল কিনা কেহ বলতে পারে না। তিনি নীরবে তাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সুদীর্ঘ কালের কঠোর সাধনায় সহস্র বিপদ-ঝঞ্চা কাটাবার পর তাঁর মহান ব্রতের এই মূর্তিমান সাফল্য দর্শনে হয়তো তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর নবুয়তের কর্তব্য শেষ হয়েছে, এবার তাঁর মহাযাত্রার আয়োজনের দিন সমাগত, তাই আজ তিনি তাঁর সাধনার উপসংহার করে প্রিয় অনুচরদের হাতে তা অর্পণ করে যাচ্ছেন। আজকের সম্ভাষণে তাঁর সেই অতুল্য কণ্ঠস্বর ভাবাবেগে ঝঙকৃত হয়ে সে বিরাট জনসমুদ্রকে নীরব স্তম্ভিত করে দিল; শ্রোতৃ-হৃদয়ে, সমীর-স্তরে, খেজুর গাছের পাতায় পাতায়, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় অজ্ঞাত-পূর্ব আবেগ-শিহরণ জেগে ছুটে চললো।
মহানবী (স.) বলতে লাগলেন“হে জনমণ্ডলী,মন দিয়া আমার কথা শোন। কারণ আবার তোমাদের মধ্যে এই স্থানে উপস্থিত হবার জন্য আর একটি বৎসর আল্লাহ আমাকে দিবেন কিনা আমি জানি না।
‘এই পবিত্র মাসে, এই পবিত্র দিনে তোমাদের একের ধন-মান, প্রাণ-নাশ অপরের পক্ষে নিষিদ্ধ হল। সাবধান, তোমাদের প্রভুর সম্মুখে তোমাদেরকে উপস্থিত হতে হবে এবং তোমাদের কাজের হিসাব দিতে হবে।
অজ্ঞযুগের খুনেরে বিনিময় প্রথা আমি পদদলিত করলাম। সর্বপ্রথমে, আমার বংশের খুনের যাবতীয় দাবী প্রত্যাহার করলাম।
সাবধান, আমার পরে তোমরা একে অন্যের গলা কেটো না; মনে রেখো, হাশরের ময়দানে তোমাদের মুখ দেখাতে হবে।
তোমাদের স্ত্রীদের বিষয়ে সাবধান। আল্লাহকে জামিন রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছো। আল্লাহ জামিনের কথা স্মরণ রেখে তাদের সহিত কোমল ও প্রীতিময় ব্যবহার করো। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের উপরও তাদের তদ্রুপ অধিকার আছে।
অজ্ঞযুগের যাবতীয় কুসীদ আমি পদদলিত করলাম। সর্বপ্রথমে আমার পিতৃব্য আব্বাসের প্রাপ্য কুসীদ আমি পদদলিত করলাম।
অতঃপর মহাজন কেবল আসল টাকা পাইবে।
অতীতের অভিজাত্য অহঙ্কার আমার পদতলে বিমর্দিত হল। অ-আরবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠতা নাই, আরবের উপরও অ-আরবের কোনো শ্রেষ্ঠতা নাই। সকলেই আদমের সন্তান এবং আদম মাটির দ্বারা গঠিত।
তোমাদের মধ্যে তিনি সর্বাপেক্ষা মহৎ যিনি সর্বাপেক্ষা সৎকর্মশীল।
মনে রেখো তোমরা সকলে পরস্পর ভাই: তোমরা এক ভ্রাতৃসংঘ। সদিচ্ছায় না দিলে এক ভাইয়ের কিছুই অন্য ভাইয়ের জন্য বৈধ নয়।
তোমরা অনুক্ষন অন্যায় আচরণ হতে বিরত থেকো, সর্বদা হক পথে চলো।
আর সাবধান, তোমাদের দাসদাসী! তোমরা যা খাও, তাদেরকেও তা খেতে দিও এবং তোমরা যা পর তাই তাদেরকে পরতে দিও।
যদি দাসদাসীরা এমন কোনো অপরাধ করে বসে যা তোমরা ক্ষমা করতে অনিচ্ছুক, তবে তাদেরকে মুক্তি দিয়ে দিও। তারা তোমাদের ভাইবোন, আল্লাহ তাদরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাদের প্রতি কঠোর ব্যবহার সঙ্গত নয়।
মহাপুরুষ ক্ষণিকের জন্য নীরব হলেন। তার পর আবার সম্মুখে তাঁর করুণ দৃষ্টি বিস্তার করে বললেন, হে সমবেত জনমণ্ডলী, আমি কি আমার প্রভুর বাণী পৌঁছেয়েছি?
বিপুল জনসংঘ সাগর-কল্লোলের মত সমস্বরে উত্তর করল: পৌঁছিয়েছেন আপনি নিশ্চয় পৌঁছিয়েছেন।
তৃপ্তির বিদ্যুচ্ছটায় অকস্মাৎ মহাপুরুষের বদনমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল; কৃতজ্ঞতার অশ্র“তে তাঁর দুই চোখ ভরে আসল। তিনি আকাশের দিকে তাঁর কম্পিত হস্তদ্বয় প্রসারিত করে গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন: লক্ষ্য কর, প্রভু, লক্ষ্য কর লক্ষ্য কর।
মহানবী (স.) তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা সমস্তই জানতেন; কিন্তু সামরিক শক্তির গৌরবচ্ছটা কিংবা ঐশ্বর্য সাম্রাজ্যের উগ্র কামনা তাঁর নিষ্কাম চিত্তে চাঞ্চল্যের রেখামাত্রও সঞ্চার করতে পারে নাই; তাই শক্তি-উদীয়মান নবীন রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিনায়ক তাঁহার সুদীর্ঘ অভিভাষণে সাম্রাজ্য, সম্পদ বা সমর শক্তি সম্বন্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। বিদায়মান বীরের মুখ হতে তাঁর সর্বশেষ বৃহত্তম প্রকাশ্য বতৃতায় তাঁর দেশ, তাঁর জাতি, তাঁর সৈন্য ও তাঁর পত্নী সম্বন্ধে একটি বর্ণও নির্গত হল না যদিও এ সমস্তই তাঁর ছিল। শুধু দীন দরিদ্র, দুর্বল, নারী, দাসদাসী, এই অবজ্ঞাত অবহেলিত, নির্যাতিতদের রক্ষণে বজ্রগম্ভীর স্বরে তিনি তাঁর শেষ আদেশ বাণী ঘোষণা করে গেলেন।
এই স্মরণীয় অভিভাষণের পর প্রায় তের শত বৎসর কালের সাগরে বিলীন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতে ইসলামের নিরক্ষর নবী (সা.) জীবনের যে আদর্শ উপস্থাপন করে গিয়েছেন, তা আজও জগতের কার্যতঃ উপলব্ধির বিষয় হয়ে রয়েছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...