হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

গলদ যখন সিস্টেমে!

মোহাম্মদ আসাদ আলী
আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, আগে নিজে ভালো হোন, তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এই কথাটি সম্পূর্ণ অমূলক। কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে পথ চলতে পারে না। জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনের চাপে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না। বিশাল এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যমুনা নদীর তুলনায় এক টুকরো শোলার মতো। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সেটা দ্বারা ব্যক্তিও প্রভাবিত হতে বাধ্য, ইচ্ছে করলেও সৎ থাকা যায় না। কাদামাটি দিয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলবেন, কিন্তু গায়ে কোনো কাদার ছিটা লাগবে না- তা কি সম্ভব? কাজেই গায়ের কাদা পরিষ্কার করার চেয়েও বেশি প্রয়োজন রাস্তা মেরামত। রাষ্ট্রব্যবস্থা হচ্ছে ওই রাস্তার মত, সেখানে পরিচ্ছন্নতা না থাকলে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় ফল হবার নয়, নোংরা-আবর্জনার ছিটা লাগবেই।
আমরা দেখছি প্রচলিত সিস্টেমে একদলের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে অন্যদলের ভোটের বাক্স ভরে দিচ্ছে জনতা, যাদেরকে নির্বাচিত করল তারাও পরীক্ষিত দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস লালনকারী, বিদেশে অর্থপাচারকারী, ওয়াদা ভঙ্গকারী এবং যাদেরকে পরাজিত করল তারাও এদেরই মতো। এই ক্ষমতার দৌড়ঝাঁপে আজ পর্যন্ত কত প্রাণ গেল, কত রক্ত ঝরল, কত গাড়ি-বাড়ি পুড়লো, কত মানুষ পঙ্গু হল, কতজন অন্যায়ভাবে জেলে পঁচলো। এসব করে মানুষের লাভটা কী হল? এ যেন কড়াই থেকে বাঁচার জন্য লাফ দিয়ে চুলোয় পড়া, আর চুলো থেকে উঠে আবার কড়াইতে পড়া। পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার অনুকরণে এমন এক বিষাক্ত সিস্টেমকে আমরা নিজেদের উপর চাপিয়ে রেখেছি যে সিস্টেমে একজন সৎ, যোগ্য, প্রকৃত ওয়াদা রক্ষাকারী, আমানতদার, নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমী, উঠে আসতে পারবে না; এ সিস্টেমে যে যত বেশি অপপ্রচার চালাতে পারে, মিথ্যা প্রচার করতে পারে, কালো টাকা ছড়াতে পারে, পেশীশক্তি ব্যবহার করতে পারে সে নির্বাচিত হয়। সে যত বড় দুর্নীতিবাজ, মিথ্যাবাদী, ওয়াদা খেলাফকারী, দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী, সন্ত্রাস লালনকারী হোক না কেন তাদের কোন অসুবিধা নাই। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
কোন জালের ফাঁকাগুলি যদি বড় বড় থাকে তাহোলে সেটা দিয়ে কোন ছোট মাছ ধরা সম্ভব হয় না, সেগুলি সব ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। থেকে যায় কেবল বড় বড় মাছগুলি। বর্তমানের নেতা নির্বাচন পদ্ধতিটি একটি জালসদৃশ যার ফাঁকাগুলি অনেক বড় বড়। তাই সমাজে যারা প্রভাবশালী, বিত্তবান, পেশীশক্তিতে বলীয়ান অর্থাৎ সমাজের রুই কাতলারা এই জালের মাধ্যমে জাতির নেতৃত্বপদ লাভ করেন। পক্ষান্তরে যারা চরিত্রবান, ভালো মানুষ, ওয়াদা রক্ষাকারী, ভদ্র, সভ্য, কারও ক্ষতি করে না তারা বর্তমানের সমাজে গুরুত্বহীন, সর্বত্র অবদমিত। তারা ছোট মাছের মত জালের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যান এবং কখনওই নেতৃত্বে উঠে আসেন না।
প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে প্রথমে একজন টাকা দিয়ে মনোনয়ন পত্র কিনে প্রার্থী হয়, নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপায়, নিজের গুণগান নিজেই প্রচার করে, মিছিল করে, ব্যানার টানায়, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, মানুষকে তার পক্ষে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়, প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে খুন করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। নিয়মিত শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনী তো আছেই, নির্বাচনের কেন্দ্র এবং ভোটের বাক্স পাহারা দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীও মোতায়েন করতে হয়। পাহারা উঠিয়ে নিলেই বোঝা যায় কে কতটা সভ্য! তখন বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটবাক্স লুট ইত্যাদি অনেক কিছুই ঘটে। গ্রাম্য মেম্বার থেকে শুরু করে যে কোন পর্যায়ের নির্বাচনেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে। এটাই নেতা নির্বাচনের বর্তমান সিস্টেম, সারা দুনিয়াতে এই সিস্টেম প্রায় একই রকম, শুধু কোথাও সহিংসতা কম, কোথাও বেশি। এখন ধরুন একজন সৎ মানুষ আছেন যিনি বিত্তবান নন, নিজস্ব কোন লাঠিয়াল বাহিনী নেই, পেছনে প্রভাবশালী গোষ্ঠির মদদ নেই তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বড়ই দুঃশ্চরিত্র, নীতিহীন এবং অনেক টাকার মালিক। এখন এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কার? অবশ্যই দ্বিতীয় লোকটির। এভাবে প্রতিটি পর্যায় থেকে সাধারণত খারাপ লোকগুলি বিজয়ী হতে হতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আসে। যারা নেতা নির্বাচিত হন তাদের ১০০% ই খারাপ তা অবশ্য নয়, কিছু কিছু ভাল মানুষও যদি কালে ভদ্রে নেতা হন, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আর তারাও বেশিদিন তাদের সচ্চরিত্র ধরে রাখতে পারেন না; সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি যে, কেউ ভালো থাকতে চাইলেই ভালো থাকতে পারেন না।
এই স্বার্থভিত্তিক সিস্টেম বজায় রেখে জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। কাজেই জাতীয়ভাবে আজ আমাদের এমন একটি সিস্টেম দরকার যেখানে শত চেষ্টা করেও কেউ ঘুষ খেতে পারবে না, অন্যায় করতে পারবে না, ওয়াদা খেলাফ করতে পারবে না, কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে এমন অবিচার সৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনাও যেখানে থাকবে না। মানুষ স্বার্থ ও ভোগের চিন্তা না করে অপরের কল্যাণের চিন্তা করবে। নিজে কী পেলাম সেই চিন্তা না করে সমাজকে কী দিতে পারলাম এই চিন্তা করবে। তেমন একটি নির্ভুল জীবনব্যবস্থা কার্যকর করতে চিন্তাশীল সুধী সমাজ কবে সচেষ্ট হবেন?
লেখক: ব্লগার ও কলামিস্ট
mdasadali95@gmail.com

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...