হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কুয়োর মধ্যেই যার জীবন ও মৃত্যু

রিয়াদুল হাসান:
সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে এক আল্লাহ, এক রাসুল, এক কেতাব, এক উম্মাহ ও এক জাতি উম্মতে মোহাম্মদী, যে জাতিটিকে তৈরি করেছিলেন আখেরী নবী, শ্রেষ্ঠ নবী হুজুরে পাক (স.)। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, অকল্পনীয় ত্যাগ, কঠোর অধ্যবসায় ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আরবের তৎকালীন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অনৈক্য, হানাহানি, অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠীকে তিনি একটা মহান জাতিতে পরিণত করেছিলেন। তাদের জীবনের কোন লক্ষ্য ছিল না, একেক জনের একেক লক্ষ্য ছিল। রসুলাল্লাহ সবাইকে এক লক্ষ্যের অভিমুখী করেছেন। তাদের কোন ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা ছিল না, তাদের জীবনের কোন কর্মসূচি ছিল না, রসুলাল্লাহ তাদেরকে কর্মসূচি দিয়েছেন। তাদের কোন আদর্শ ছিল না, তিনি তাদেরকে একটি আদর্শের উপর দাঁড় করিয়েছেন। ফল হয়েছে এই যে তারা অল্প কিছুদিনের মধ্যে তৎকালীন দুই দুটি পরাশক্তিকে পদানত করে অর্ধ পৃথিবীতে সাম্য সুবিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা দাসত্বব্যবস্থা দুর করে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
রসুলুল্লাহর এন্তেকালের পর সেই জাতির লক্ষ্য যেন ঠিক থাকে এজন্য রসুল তাদেরকে বিভিন্নভাবে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেলেন যার মধ্যে বিদায় হজের ভাষণ অন্যতম। তারা যেন কোনভাবেই ঐক্য নষ্ট না করে, শৃঙ্খলাভঙ্গ না করে, আনুগত্য ভঙ্গ না করে এজন্য বার বার করে এই কথাটি তিনি বললেন যে, “যদি কিসমিসের ন্যায় ক্ষুদ্র মস্তকবিশিষ্ট কোন নাক বা কানকাটা (অর্থাৎ বিকলাঙ্গ) ক্রীতদাসকেও তোমাদের নেতা নিযুক্ত করা হয় তোমরা তার কথা শুনবে এবং মান্য করবে, অর্থাৎ বিনা বাক্যব্যয়ে তা আনুগত্য করবে [হাদিস, উম্মুল হোসাইন (রা.) থেকে মুসলিম, আনাস (রা.) থেকে বোখারি]।” তিনি আরো বললেন, তোমরা আল্লাহর হুকুম থেকে কখনও বিচ্যুত হবে না। আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এই দুটি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কেতাব ও অপরটি রসুলের সুন্নাহ। তিনি জাতিকে পাঁচদফা কর্মসূচী দিয়ে বলে গেলেন যে এই কর্মসূচি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, এখন এটা তোমাদের হাতে অর্পণ করে আমি চলে যাচ্ছি। সেগুলো হলো:
(১) (সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে) ঐক্যবদ্ধ হও।
(২) (যিনি নেতা হবেন তার আদেশ) শোন।
(৩) (নেতার ঐ আদেশ) পালন করো।
(৪) হেযরত (অন্যায় ও অসত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ) করো।
(৫) (এই দীনুল হক কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করো। এখানে জেহাদ অর্থ: সর্বাত্মক চেষ্টা, প্রচেষ্টা।
যে ব্যক্তি এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হলো, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেলল- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামায পড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রাঃ) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত]।
রসুলাল্লাহর এই সব নির্দেশনা অনুসরণের ফলে আরব জাতির ইতিহাস পাল্টে গেল। তারা অবিশ্বাস্য সামরিক বিজয় অর্জন করল, অতঃপর তারা জ্ঞানে বিজ্ঞানে, আর্থিক সমৃদ্ধিতে, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলো। কিন্তু এরই মধ্যে যে আকিদার উপর, লক্ষ্যের উপর আল্লাহর রসুল জাতিটিকে রেখে গিয়েছিলেন ইবলিসের প্ররোচনায় জাতিটি তাদের সেই আকিদা, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। তারা সংগ্রাম ত্যাগ করল। জাতির শাসকশ্রেণি অর্ধেক পৃথিবীর ভ‚সম্পত্তি ও সম্পদ হাতে পেয়ে অন্যান্য সব রাজা-বাদশাহদের মত ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশে গা এলিয়ে দিলেন। তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে রাজনৈতিক বিভক্তি সৃষ্টি হলো।  যে জাতি ছিল সার্বক্ষণিক সংগ্রামে লিপ্ত তারা সংগ্রাম ত্যাগের পর বিপুল অবসর পেয়ে দীন নিয়ে গবেষণা করার জন্য কাগজ কলম নিয়ে ঘরে ঢুকল। জাতির মধ্যে জন্ম নিল ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। জন্ম নিল বহু ইমাম, ফকিহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুজাদ্দিদ। তারা দীনের শরিয়তের ও মারেফতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে নিয়ে চুলচেরা ব্যাখ্যা করতে লেগে গেল। তারা রসুলের জীবনের ও কথার প্রতিটিকে ধরে ধরে মাসলা-মাসায়েল আবিষ্কার করতে করতে হাজার হাজার ফতোয়ার কেতাব রচনা করে ফেললেন। সহজ সরল সেরাতুল মোস্তাকীম ইসলামটি হারিয়ে গেল। সেটা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের কুক্ষিগত হয়ে গেল। তা এতই বৃহদায়তন ও দুর্বোদ্ধ হয়ে গেল যে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে একজীবন ইসলাম পূর্ণরূপে পালন করা তো দূরের কথা, পুরোপুরি জানাটাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। গোটা জাতি সেই দুর্বোদ্ধ ইসলামের মাসলা মাসায়েলের মাকড়সার জালে আটকে স্থবির হয়ে গেল। শরিয়তের ব্যাখ্যাকে ঘিরে তারা শত শত মাজহাব ফেরকায় বিভক্ত হয়ে গেল। এর মধ্যে শিয়া ও সুন্নী হলো প্রধানতম দুটো বিভক্তি যাদের উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ ও আকিদাগত মতবিরোধ প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল এবং আজও আছে।
আর সেই সঙ্গে ইসলামের মধ্যে ঘটল ভারসাম্যহীন সুফিবাদের অনুপ্রবেশ। তারাও সংগ্রাম বিমুখ, অন্তর্মুখী ইসলাম জাতিকে শেখাতে লাগল যার দরুন জাতির আরেকটি বড় ভাগ আত্মার ঘষামাজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের মাধ্যমে এই জাতির মধ্যে বহু প্রকার আধ্যাত্মিক তরিকার বিস্তার ঘটল। সুন্নী ও শিয়াদের মধ্যে বহু পৃথক পৃথক সুফিবাদী গোষ্ঠী রয়েছে।
এই সব জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত ফল হয়েছে এই যে, এক সময়ের লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ, দুর্বার দুর্বিনীত শত্রুর বুকে ত্রাস সৃষ্টিকারী জাতিটি বিড়ালের মতো ভীরু কাপুরুষে পরিণত হয়েছে। পূর্ববর্তী আলেমগণ মৌলিক মূল সহজ সরল ইসলাম থেকে সরে গিয়ে তাদের ক্ষুরধার মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা শ্রম ব্যয় করে সূক্ষাতিসূক্ষ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, মতামত, মাসলা মাসায়েল নিয়ে ক‚টতর্কে জাতিকে লিপ্ত করে গেলেন। এখনও সেই ক‚টতর্ক বাহাসের ধারাবাহিকতা বহমান রয়েছে। দেশের সর্বত্র ওয়াজের মৌসুম আসলেই শুরু হয় কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক যেমন নবী নূরের নবী না মাটির তৈরি, দোয়াল্লীন হবে না যোয়াল্লীন হবে, মিলাদের মধ্যে কেয়াম হবে নাকি বেকেয়াম হবে, রসুল হায়াতুন্নবী নাকি তিনি এন্তেকাল করেছেন, তাঁর প্রশ্রাব পায়খানা পাক নাকি নাপাক ইত্যাদি। সমগ্র বিশ্বে যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে এসেছে, মুসলিমরা বিশ্বময় নির্যাতিত, উদ্বাস্তু হচ্ছে তখন ও আমাদের ধর্মব্যবসায়ী আলেম ওলামারা এসব নিয়ে মহাব্যস্ত। কারণ এগুলোই তাদের উপার্জনের মাধ্যম। যতদিন না মুসলিম নামক এই জনগোষ্ঠীকে এই সব ক্ষুদ্রতার গণ্ডিবদ্ধতা থেকে উদ্ধার করে বিশ্বজনীন দৃষ্টি প্রদান করা যাবে ততদিন এই জনগোষ্ঠীর মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা ঐ কুয়োর ব্যাঙের মতই জীবন কাটিয়ে কুয়োর মধ্যেই মৃত্যুবরণ করবে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...