হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

এখন কি করবে মুসলমানরা?

মোহাম্মদ আসাদ আলী
আমরা মুসলিম নামক জাতিটি কালের এমন একটি বিন্দুতে এসে উপনীত হয়েছি যেখানে আজ আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তান ধ্বংস হলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে আবারও চলছে ধ্বংসের উন্মাদনা। সিরিয়ায় গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে। সামরিক বেসামরিক নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করা হচ্ছে। ভয়ানক রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ হচ্ছে যার প্রথম শিকারে পরিণত হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুগুলো। কিছুদিন আগেই একটি রাসায়নিক হামলায় ছটফট করতে করতে মারা গেল ২৭টি শিশু। লেবাননে রক্ত ঝরছে মুসলমানের। আফ্রিকার ত্রাতা বলে পরিচিত সমৃদ্ধ একটি দেশ ছিল লিবিয়া। মুসলিমপ্রধান এই দেশটি সা¤্রাজ্যবাদী ও জঙ্গিবাদী তা-বে আজকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। উত্তর আফ্রিকায় চলছে খরা ও দুর্ভিক্ষ। মায়ানমারে, ফিলিস্তিনে মুসলিমদের উপর কী নির্মম পৈশাচিকতা চলছে তা সারা বিশ্বের মানুষ স্বীকার করেন। এইভাবে বিশ্বের সর্বত্র আক্রান্ত হচ্ছে মুসলমানরা। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্তত ছয় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু যাদের প্রায় সবাই মুসলমান। যে দেশগুলো এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় নি সেগুলোও যে খুব নিরাপদে আছে তা কিন্তু নয়। প্রত্যেকটা মুসলিমপ্রধান দেশে আস্তানা গাড়ছে জঙ্গিবাদ। আর সেই জঙ্গিবাদের সূত্র ধরে জঙ্গিদমনের নামে দেশ দখল করে নেওয়ার সা¤্রাজ্যবাদী নীল নকশা তো সবারই জানা। বলা বাহুল্য, আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশও এখন আক্রান্ত।
এ এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে, আমরা মুসলমানরা সংখ্যায় ১৬০ কোটি হলেও ভৌগোলিক ভাবে আমরা ৫৪টি রাষ্ট্রে বিভক্ত; শরীয়াহগতভাবে শিয়া-সুন্নি, হানাফি, হাম্বলি, শাফেয়ী ইত্যাদি ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত। শিয়াদের মধ্যে আবার আছে শত শত দল-উপদল। সুন্নিদের মধ্যেও তেমন। রয়েছে হাজার হাজার পীর। সেই একেক পীরের একেক রকম তরিকা। আবার ইসলামের নামে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার রাজনৈতিক দল। একেক দলের একেক কর্মসূচি। জঙ্গিবাদী দলের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাদের মধ্যে একটি দলের আকীদার সাথে আরেক দলের আকীদায় বিস্তর তফাৎ। আর মাঝখানে সাধারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ন্যুনতম জ্ঞানটুকুও নাই ইসলাম সম্পর্কে। তারা না জানে কোরআন, না জানে হাদিস, না জানে ইসলামের ইতিহাস। হালবিহীন নৌকার মত বাতাস যেদিকে যাচ্ছে তারাও সেদিকে ছুটছে। ইসলাম জানার ও মানার জন্য এই সাধারণ জনগণকে নির্ভর করতে হয় এমন একটি শ্রেণির উপর যারা ধর্মকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিকসহ নানাবিধ স্বার্থ হাসিল করে থাকে। তারা যেটাকে ইসলাম বলে সেটাই সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ইসলাম মনে করে। এই শ্রেণিটির পিছু পিছু কেউ যাচ্ছে পীরের আস্তানায়, কেউ যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে, কেউ যাচ্ছে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে, কেউ ঢুকছে মসজিদে-মাদ্রাসায়; কেউবা ধর্ম-কর্মের তালে না থেকে পশুর মত আহার-বিহার-নিদ্রার মধ্যেই জীবনকে আবদ্ধ করে রেখেছে। ওদিকে জাতির বিরুদ্ধে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যে চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে, এই জাতিকে বিশ্বময় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। তাদের খেয়াল নেই যে, সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে প্রত্যেকটি মুসলিমপ্রধান দেশের সরকারের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। নতুন নতুন বাহিনী তৈরি করা হচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি, আধুনিক যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। জঙ্গিদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে, গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে, ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। এক কথায় প্রচেষ্টার কোনো অন্ত নেই। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
এখন মুসলিম নামক জাতিটিকে সম্মিলিতভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে এই সঙ্কট কোনো নির্দিষ্ট দেশের সঙ্কট নয়, কিংবা কেবল কোনো সরকারের একার সঙ্কট নয়। এই সঙ্কট সমগ্র মুসলিম জাহানের সঙ্কট। বিশ্বময় মুসলিম নামক জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যই এই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা। কাজেই এখন সবাইকে ভাবতে হবে কীভাবে তারা তাদের দেশকে, তাদের জাতিকে, তাদের সমাজকে রক্ষা করবে। কীভাবে তারা অনিবার্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের সন্তানদেরকে রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে কে কত বড় আলেম, কে কত বড় পীর, কে কত বড় প্রভাবশালী নেতা, কার কত লক্ষ অনুসারী- এইসব আত্মাভিমান ছুড়ে ফেলে এই জাতীয় দুর্যোগের মুহূর্তে ঈমানদার মুসলিম হিসেবে আমাদের সবাইকে এক টেবিলে বসতে হবে। এই বিপর্যয় এখনও এড়ানো সম্ভব কিন্তু তার জন্য সরকার, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ জনগণ সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আবশ্যক। এখানে দেখা চলবে না কে কোন মতের, কে কোন দলের। ন্যায্য কথা যেই বলুক সেটা গ্রহণ করতে হবে। সমাধানের উপায় যেই প্রদান করুক সেটা ভেবে দেখতে হবে।
এক্ষেত্রে হেযবুত তওহীদের কথা হচ্ছে- ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে যদি ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা, আরবিতে যাকে বলে ‘আকীদা’ শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে তাদের ঈমানকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল আর ভুল খাতে প্রবাহিত করে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে লিপ্ত করতে পারবে না। কেননা আকীদা হচ্ছে দৃষ্টিশক্তির মত যা একজন মানুষের সামনে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম, বৈধ-অবৈধ স্পষ্ট করে দেয়। ফলে তারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারবে যে কেন জঙ্গিবাদ ভুল পথ, কীভাবে এই পথ মানুষের ইহকাল ও পরকালকে ধ্বংস করে দেয়। সেই সাথে এও বুঝতে পারবে যে কোনটা সঠিক পথ। এক কথায় মানুষের সামনে প্রকৃত ইসলামের রূপরেখা সম্যকভাবে তুলে ধরতে হবে।
আমরা প্রকৃত ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে পাই বিশ্বনবী কঠোর পরিশ্রম করে সর্বপ্রথম একটি জাতি গঠন করেছিলেন। সেই জাতির সদস্যরা একটি বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছিল যে, ‘তারা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবে না, আর আল্লাহর রসুল হবেন তাদের নেতা, পথ প্রদর্শক।’ সেই মোতাবেক তারা ‘এক নেতা এক হুকুম’ এর অধীনে একটি জাতীয় সিস্টেম গড়ে তুলল। সেই নেতার (রসুলাল্লাহ) নির্দেশে তাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালিত হত। সেই নেতাই ঠিক করে দিতেন জাতির ডিসিপ্লিন কী হবে, কে কার আনুগত্য করবে, সামাজিক ব্যবস্থা কেমন হবে, সামরিক বাহিনী কেমন হবে ইত্যাদি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে আল্লাহ কোর’আনের আয়াত নাজেল করে তার সমাধান দিতেন। আর আল্লাহর রসুল (সা.) পরিস্থিতি বুঝে জাতির কল্যাণের কথা ভেবে যেভাবে সেই আয়াতের প্রয়োগ ঘটানো ভালো মনে করতেন সেইভাবে প্রয়োগ করতেন। তাতে কেউ বাধা দিত না বা আপত্তি করত না, কারণ সবাই তো আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা ও বিশ্বনবীকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এইভাবে একদেহ একপ্রাণ হয়ে ওই জাতিটি তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সেই লক্ষ্য হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার স্থাপন করা।
এরপর রসুলাল্লাহ ইন্তেকাল করলে জাতির সদস্যরা বসে শলা-পরামর্শ করে তাদের একজন নেতা ঠিক করে নিল এই শর্তে যে তিনি আল্লাহর হুকুম ও রসুলের সুন্নাহ মোতাবেক জাতিটিকে পরিচালিত করবেন। এইভাবে চলল মোটামুটি ৬০/৭০ বছর। এই সময়টিতে জাতি আল্লাহ-রসুলের নির্দেশিত পথে ও নির্দেশিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম চালিয়ে গেল। আল্লাহও তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাদেরকে বিজয় দান করতে লাগলেন। ফলে কিছুদিন আগেও যেই জাতিটি ছিল পৃথিবীর সবচাইতে বর্বর, অশিক্ষিত, দরিদ্র একটি জনগোষ্ঠী, তারাই সামরিক শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আর্থিক প্রাচুর্য সর্বদিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করল। কিন্তু তারপর ঘটল এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। হঠাৎ জাতিটি লক্ষ্য ভুলে গেল। শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছেড়ে শাসকরা মেতে উঠল ভোগ বিলাসিতায়। জাতি হয়ে পড়ল গতিহীন, স্থবির। যতক্ষণ জাতির সু¯পষ্ট লক্ষ্য ছিল ততক্ষণ তাদের মধ্যে কোনো মতভেদ, অনৈক্য ইত্যদি সৃষ্টি হতে পারে নি। সবাই এক দেহ এক প্রাণ হয়ে কেবল সংগ্রাম করে গেছে, আর আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বরাবরই বিজয় দান করে এসেছেন। কিন্তু এবার যখন সেই লক্ষ্যটা ভুলে যাওয়া হলো, এই প্রথম বিভিন্ন দিকে তাদের দৃষ্টি পড়তে লাগল, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তাদের দৃষ্টি আটকে যেতে লাগল। একদল শুরু করল দ্বীনের চুলচেরা অতি বিশ্লেষণ। আরেকদল ব্যস্ত হয়ে পড়ল আত্মার ঘসামাজা করে কুরবিয়াত হাসিলের কাজে। আর সাধারণ লোকেরা যে যার মত জীবনপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিল। জাতি একদিকে স্থবির, আর অন্যদিকে বিভক্ত হয়ে প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলল। এইভাবে চলল কয়েকশ’ বছর।
আল্লাহ কোর’আনে বারবার সতর্কবাণী করেছেন ‘সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করলে মর্মন্তুদ শাস্তি দেওয়া হবে’, আল্লাহর রসুল বলেছেন ‘যারা আমার সুন্নাহ ছেড়ে দিবে তারা আমার কেউ নয় আমি তাদের কেউ নই’। এর কিছুই যখন জাতির মনে রইল না, সব ভুলে গিয়ে যখন তারা তর্ক-বাহাস আর ফতোবাজীতে মেতে থাকল, নিজেরা নিজেরা অনৈক্য-মতভেদে ডুবে থাকল, তখন আল্লাহ এদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বর্বর হালাকু খানের সৈন্যরা। মুসলমানদের রক্তে ফোরাত নদী লাল হলো। তাদের মস্তক দিয়ে হালাকু খান পিরামিড বানালো। নারী-শিশুদেরকে পর্যন্ত রেহাই দেওয়া হলো না। স্বয়ং খলিফাকে লাঞ্ছনা আর অপমানের সাথে হত্যা করা হলো। এভাবে হালকু খান কচুকাটা করে গেল কিন্তু তবু এদের হুঁশ হলো না। তারা আবার ফিরে গেল সেই হুজরা, খানকায়। সেই বাহাস, তর্কাতর্কি, চুলচেরা বিশ্লেষণ, আধ্যাত্মিক ঘসামাজাই শুরু হলো নতুন উদ্যোমে। আবার শুরু হলো শাসকদের ভোগ-বিলাসিতার রাজত্ব। ফলে এবার এলো চূড়ান্ত মার খাবার পালা। ইউরোপীয় খৃষ্টান জাতিগুলো সামরিক শক্তিবলে এবার প্রায় সমগ্র মুসলিম জাতিটিকেই গোলাম বানিয়ে ফেলল। এদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সিস্টেম বদলে পাশ্চাত্যের তৈরি সিস্টেম কার্যকরী করল। যে ফিকাহর বই নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণ, এত ফেরকাবাজি, ফতোয়াবাজি, আদালত থেকে সেই ফিকাহ-কোর’আন ছুঁড়ে ফেলে সেখানে দখলদার জাতিগুলোর তৈরি আইন-কানুন দ-বিধি প্রয়োগ করা হলো।
এই সময় সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ যে ঘটনাটা ঘটল সেটা হচ্ছে মুসলিম জাতি যে শর্তের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল অর্থাৎ ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবে না’- সেই শর্তটা এবার ভঙ্গ হয়ে গেল। কেননা জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে তাদেরকে এবার মেনে নিতে হলো ব্রিটিশদের হুকুম। তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী আল্লাহর হুকুম (বিকৃতভাবে হলেও) মেনে অভ্যস্ত। তাদের একটি প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম ছিল। একটি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু ছিল যুগের পর যুগ ধরে। তাদের প্রচলিত একটি শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এগুলো কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যাপার ছিল না, সেখানে ঈমানী বাধ্যবাধকতাও ছিল। কিন্তু সেটাকে অচল করে দিয়ে তাদের মাথার উপর ব্রিটিশরা আরেকটি হুকুমত চালু করে দিল। তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার বিপরীতে ব্রিটিশরা দাঁড় করালো আরেকটা রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা। তাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড় করানো হলো আরেকটা শিক্ষাব্যবস্থা। তাদের আইন-কানুন দ-বিধির বিপরীতে চালু করা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন আইন-কানুন, দ-বিধি। এক কথায়, এতদিন যে হুকুম দেওয়ার এখতিয়ার ছিল কেবলই আল্লাহর, সেই হুকুমের ক্ষমতা চলে গেল ব্রিটিশের হাতে। আর মুসলমানরা হয়ে গেল ব্রিটিশের হুকুমের গোলাম। শুরু হলো মুসলিমদের জাতীয় জীবনের সাথে ব্যক্তি জীবনের সংঘাত!
এই যে ঘটনাটি ঘটল, এটা মুসলিমদের ক্ষেত্রে যতটা প্রবল সঙ্কট হয়ে দাঁড়াল তা কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে হয় নি। অন্যান্য ধর্মগুলো হাজার হাজার বছরে এমনিতেই এতখানি বিকৃত হয়ে গেছে যে, তা দিয়ে কোনো জাতির সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অনেক ধর্মে তো জাতীয় জীবন পরিচালনার কোনো বিধানই নেই। কাজেই ঐসব ধর্মাবলম্বীদের জাতীয় জীবনে কার হুকুম চলছে বা না চলছে তা নিয়ে তাদের কোনো ঈমানী বাধ্যবাধকতাও নেই। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। একটা জীবন্ত ইতিহাস রয়েছে ইসলামের। কিছুদিন আগেও মুসলিমরা দুনিয়া শাসন করেছে। একটি সুমহান সভ্যতার জন্মদাতা তারা। তারা আবু বকর (রা.), ওমরের (রা.) শাসনামল নিয়ে আজও গর্ব করে। এই জাতির প্রাণশক্তি যে কোর’আন, তা হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যেটা ‘অপরিবর্তনীয়’ ও ‘অবিকৃত’ আছে। সেখানে হাজার হাজার আয়াত রয়েছে মুসলিমদের জাতীয় জীবনের সাথে জড়িত। সেই আয়াতগুলোর বাস্তবায়ন করা মুসলিমদের ঈমানী বাধ্যবাধকতার অংশ। কিন্তু জাতীয় জীবনে হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা যখন তারা হারাল তখন স্বভাবতই প্রশ্নের জন্ম হলো- এখন তারা কী করবে? তারা না পারছে আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশের হুকুম গ্রহণ করে নিতে, আবার না পারছে ব্রিটিশের হুকুম প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করতে। মুসলমানরা দেখল ব্রিটিশরা কেবল নতুন একটি শাসনব্যবস্থাই নয়, নতুন একটি সভ্যতাও চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। ফলে জীবনের প্রতিটি পদে পদে তাদেরকে হোঁচট খেতে হয়েছে যে, এটা গ্রহণ করব কিনা, এটা ইসলামসম্মত হবে কিনা, এই পোশাক পরব কিনা, এই খাবার খাব কিনা, এই চাকরি করব কিনা, এই ভাষায় কথা বলব কিনা ইত্যাদি। শুধু ‘ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা হবে কিনা’ এই দ্বিধার জন্য মুসলিমদেরকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল এ কথা ইতিহাস।
যাহোক, প্রায় তিনশ’ বছর ইউরোপীয়দের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হবার পর একটি সময় এলো যখন পৃথিবীময় স্বাধীনতার দাবিতে একটার পর একটা আন্দোলন সৃষ্টি হতে লাগল। তুরস্ক, মিশর, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিস্তিন ইত্যাদি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঢেউ খেলে গেল। ভারতবর্ষেও গড়ে উঠল অনেকগুলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। আমাদের এই বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও তার ভিত্তিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতারা তাদের স্ব স্ব ভূখ-গুলির জনগণকে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে লাগলেন। লক্ষণীয় যে, এই নেতারা কিন্তু ইসলামের চেতনার উপর নির্ভর করতে পারলেন না। কারণ তারা দেখলেন যে ইসলামের সঠিক কোনো রূপরেখা কোথাও নেই। হাজারো দল-উপদল, ফেরকা-মাজহাব, তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেছে মুসলিম জাতি। তাদের একেক ভাগের আকীদা একেক রকম। লক্ষ্যের ঐক্য নেই, কর্মসূচির ঐক্য নেই। আর বৃহত্তর ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ধর্মের প্রশ্নে স্থবির, অন্তর্মুখী মনোভাব লালন করে। তাদের দিয়ে আর যাই হোক কোনো শক্তিশালী অপশক্তিকে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। অতএব জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পৃথিবীর কোথাও ভাষাকে ব্যবহার করা হলো, কোথাও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করা হলো। এভাবে পৃথিবীর বহু ভূ-খ- স্বাধীনতা লাভ করল। সেই ভূখ-গুলোতে স্বাধীন সার্বভৌম সরকার গঠিত হলো, নতুন সংবিধান প্রণিত হলো। আর এই সংবিধানগুলো প্রণয়নের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে কোথাও বেছে নেওয়া হলো ধর্মহীন সমাজতন্ত্র, কোথাও ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ইত্যাদি। ধর্ম যে অপাংক্তেয় ছিল, তাই রয়ে গেল। ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন এই মতবাদগুলোর ভিত্তিতে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোয় এই যে সংবিধান প্রণিত হলো, সেই সংবিধান মোতাবেক গড়ে উঠল পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রকাঠামো। আইন-প্রনয়নের জন্য সংসদ তৈরি হলো, আইন প্রয়োগের জন্য বিচারালয় তৈরি হলো, আইন রক্ষার জন্য পুলিশবাহিনী গঠিত হলো। প্রতিরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীও তৈরি হলো। এক কথায় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই চালু হলো ধর্মকে বাদ দিয়েই।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঘরে ঘরে রইল কোর’আন, হাদীস, ফিকাহ ও ইতিহাসের বই। কোর’আনের অনুবাদ সব ভাষাতেই পাওয়া যায়। কোর’আনের সেই আয়াতগুলোর কথা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যেগুলো রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমতাবস্থায়, এই আয়াতগুলোর বাস্তবায়ন বর্তমান সময়ে কীভাবে হবে, নাকি সেগুলোকে পরিত্যক্ত বলে গণ্য করা হবে এইসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু কেউ পেল না। হাদীসে-সিরাতে বিশ্বনবীর রাষ্ট্রশাসনের যে দৃষ্টান্তগুলো রয়েছে যেগুলো মুসলিম জাতির জন্য পালনীয়- সেসবের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সে প্রশ্নেরও কোনো সমাধান হলো না। আবার ইউরোপীয়রা আসার পূর্বে মুসলিমরা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে যে রাষ্ট্রকাঠামো অনুযায়ী শাসিত হয়েছে, যে হুকুমগুলোকে আল্লাহর হুকুম বলে মান্য করাকে ঈমানী কর্তব্য মনে করেছে, কাজীরা আদালতে যে রায় দিয়েছেন, ফকিহরা কোর’আন-হাদীসের বিশ্লেষণ করে যে আইন তৈরি করেছেন, মুফতিরা যে ফতোয়া দিয়েছেন- সেই সবকিছুই কিন্তু গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আজও মাদ্রাসাগুলোতে লক্ষ লক্ষ ছাত্রকে সেগুলো পড়ানো হচ্ছে, সেগুলোর উপর পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ও সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো পড়েই মাদ্রাসা থেকে বের হচ্ছেন আলেম, মুফতি, ফকিহরা যাদেরকে মানুষ ইসলামের কর্তৃপক্ষ মনে করে। এই ফকিহ-মুফতিদের কাছে যখন মানুষ ইসলাম শিখতে যাচ্ছে তখন তারা অতীতের ঐ ফতোয়ার কিতাবগুলো থেকেই ফতোয়া দিচ্ছেন। এখানে সমস্যা দাঁড়াচ্ছে মানদ-ে। এমন একটি কাজ যা হয়ত ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অন্যায়, কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনে তাকে অন্যায় মনে করা হচ্ছে না, কিংবা ইসলামের দৃষ্টিতে সেই অপরাধের শাস্তি একরকম, প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনে ভিন্নরকম- সে ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কার কথা শুনবে? আজকে আমরা যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি সেই জঙ্গিবাদকে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত নির্মূল করতে সমর্থ হব না যতক্ষণ না এই প্রশ্নের সমাধান হয়। এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট সমাধান যদি করা যায় তাহলে অনেক জটিল প্রশ্নের সহজ জবাব মিলে যাবে, অনেক সঙ্কটের মীমাংসা আপনা থেকেই হয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজকে আমরা দেখি সরকারকে, রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাগুত, মুরতাদ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন রাস্তায় চেষ্টা করছে। কেউ ইসলামের নামে রাজনীতিতে নেমেছে, কেউ আবার জিহাদের নামে সশস্ত্র উপায়ে চেষ্টা করছে। এর মাঝামাঝিও কিছু গ্রুপ আছে, যারা বিভিন্ন সময় ঈমান-আকীদা সংরক্ষণের কথা বলে রাজপথে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ইত্যাদি করেন। এইসব গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যে হাজারো মতভেদ থাকলেও একটি ব্যাপারে তারা সবাই একমত যে, তারা রাষ্ট্রে কোর’আন-হাদীসের হুকুম প্রতিষ্ঠা হোক তা চান। আর তা করতে গিয়েই তারা কেউ রাজনীতি করেন, কেউ আন্দোলন করেন, কেউবা সশস্ত্র হামলা করেন। কিন্তু তারা এই সহজ সত্যটি বোঝেন না যে, তারা একটি সার্বভৌম দেশের নাগরিক, যে দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত সংবিধান আছে, বিচারালয় আছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, সেনাবাহিনী আছে। কাজেই তারা এখানে এমন কোনো কর্মকা- করতে পারেন না যেটা প্রতিষ্ঠিত সংবিধানের বিরুদ্ধে যায়, প্রচলিত আইনে যেটা কিনা অপরাধ। তারা এখন কেবল সেটাই করতে পারেন যেটা আল্লাহর রসুল করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা। তারপর মানুষ সিদ্ধান্ত নিবে তারা আল্লাহর হুকুম মানবে কিনা। যদি মানতে চায় তবে আজকে তারা যে রাষ্ট্রপরিচালকদেরকে তাগুত-মুরতাদ ইত্যাদি বলছেন হয়ত তারাই কালকে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক দেশ শাসন করবেন। মূল কথা হচ্ছে মানুষ সেটা চায় কিনা। যারা ইসলামের জন্য সত্যিকার অর্থেই কিছু করতে চান তাদের উচিত হবে মানুষের সামনে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা। আর যারা রাষ্ট্রচালনা করছেন তাদেরকে ভাবতে হবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাদেরকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে ধর্মকে তারা কী করবেন। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে মুছে ফেলা যায় না, অতীতে অনেক প্রচেষ্টা করেও লাভ হয় নি। আবার ধর্মকে নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করবেন? তারও উপায় নেই। মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে। আপনারা একটি ধর্মবিশ্বাসী জাতির নেতা। আপনারা এমন একটি জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাদের কাছে অবিকৃত ধর্মগ্রন্থ কোর’আন আছে। তারা আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্তকে, প্রতিটি কাজকে কোর’আন-হাদীস খুলে যাচাই করবে। আবার ধর্মবিশ্বাসকে অবজ্ঞারও উপায় নেই। অবজ্ঞা করলে সেই ধর্মবিশ্বাসকে ধর্মব্যবসায়ীরা লুফে নিয়ে আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে। তাহলে কী করবেন? করণীয় একটাই- ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে এবং সেই শিক্ষার উপরে নিজেদেরকেও দ-ায়মান থাকতে হবে। জাতিটাকে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ধর্মবিশ্বাসী জনগণের সামনে ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরে বলতে হবে, তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় বিভেদ-বিসম্বাদকে ব্যক্তিগত জীবনেই রেখে দিয়ে জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে, বাঁচা-মরার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হও। ঐক্যের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই। আল্লাহর রসুল বলেছেন ঐক্য ভঙ্গ কর কুফর। কাজেই আগে তো ঐক্যবদ্ধ হই। আগে তো জীবন বাঁচাই।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...