হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উৎপত্তির কারণ ও নির্মূল করার উপায়

রিয়াদুল হাসান:

সাম্প্রদায়িকতা এক মহাসংকট, যার দ্বারা প্রায়ই হুজুগে মেতে ওঠে ধর্মান্ধ জনতা। বহু প্রাণ ও সম্পদের হানি ঘটে সাম্প্রদায়িকতা নামক দানবের হাতে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকারগুলো গতানুগতিকভাবে কেবল শক্তি প্রয়োগের নীতিই অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু সেটা আদৌ কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা যদি টেকসই সমাধান চাই তাহলে আমাদের ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীকে এটা সুস্পষ্টভাবে জানতে হবে যে, সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হল কীভাবে।

ধর্মবিশ্বাস মানুষের একটা শক্তি (Resource)। একে গঠনমূলক কাজে যেমন লাগানো যায়, অতীতে মানবসভ্যতার বিকাশে ধর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, কিন্তু যখনই ধর্মবিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে পড়ে তখন এটাকেই ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করা হয়। ধর্মের জন্য মানুষ অনেক কিছু করতে পারে, এমন কি জীবন দিতে পারে এটা একটি বাস্তবতা। এর কারণ কী? এর অনেক ব্যাখ্যাই মনস্তত্ত্ববিদগণ করেছেন কিন্তু আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন যে তিনি মানুষের মধ্যে তাঁর রূহ ফুঁকে দিয়েছেন, অর্থাৎ মানুষের ভেতরে আল্লাহর রূহ আছে। ফলে পরমাত্মার অংশ ক্ষুদ্র মানবদেহে সাময়িক ঠাঁই পেয়েছে। নদীর ধর্ম যেমন সাগরের পানে ছুটে চলা, তেমনি প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্থিত আল্লাহর রুহ মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চায়। এটা তার আত্মার অভিপ্রায়। মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতো কেবল একটি প্রাণী নয়, বস্তু নয়, তার যেমন প্রাণীসত্ত্বা আছে তেমনি তার মধ্যে একটি আত্মাও আছে। দেহ ও আত্মা এই দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষ। সেই আত্মার শক্তিটাকে অর্থাৎ মানুষের ঈমানটাকে অস্বীকারের কোনো উপায় নাই। এটাকে বার বার ভুল খাতে প্রবাহিত কায়েমী স্বার্থে মানবতার ক্ষতিসাধনে কাজে লাগানো হয়েছে। এই সাম্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টিও সেখান থেকেই হয়েছে।

ধর্মগুলি কীভাবে সৃষ্টি হল সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক। আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মানবজাতির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে দিক-নির্দেশনাসহকারে নবী-রসুল পাঠিয়েছেন। একজন নবী তাঁর জাতিকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে দিয়ে ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদায় নেওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা বিশেষ করে ধর্মব্যবসায়ী ও শাসকগোষ্ঠী তাঁর শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলেছে। ফলে সমাজে আবার অন্যায় অশান্তি হানাহানি বিস্তার লাভ করেছে। এমতাবস্থায় আল্লাহ আবার একজন নবী পাঠিয়েছেন যিনি সেই জনগোষ্ঠীকে সঠিক পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে কিছু লোক সাড়া দিয়েছে কিছু লোক পূর্বের নবীর আনীত বিকৃত শিক্ষার উপরই থেকে গেছে। এভাবে দুটো সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই সারা পৃথিবীতে আল্লাহ এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল-অবতার পাঠিয়েছেন যাদের মূল শিক্ষা এক হলেও অজ্ঞতাবশত তাঁদের অনুসারীরা বহু ধর্ম-সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ কথাটি আল্লাহ বলেছেন এভাবে যে, “মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে তারা মতভেদ করল (সুরা ইউনুস : ১৯)।”

এই সম্প্রদায়গুলোর প্রত্যেকেই নিজেদেরকে সঠিক মনে করে এবং অন্যদের আপাদমস্তক ভুল মনে করে। তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য অপর ধর্মের প্রবর্তক নবী-রসুল-অবতারগণকে, উপাস্য দেবদেবীদেরকে অকথ্য গালিগালাজ করে। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে অহংকার করছে (সুরা মো’মেনুন : ৫৩)।” এভাবে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বিদ্বেষ মানুষের হৃদয়ের গভীরে বাসা বেঁধেছে যা প্রায়শই যে কোনো ইস্যুতে দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর ধর্মীয় উল্লাসে বর্বরতা চালাতে মানুষকে প্ররোচিত করে। ধর্মের শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় বৃহত্তর জনগণ ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা, মর্মবাণী থেকে বঞ্চিত থাকে এবং তারা ধর্মের ঐ ধ্বজাধারী গোষ্ঠীর কথাকেই আল্লাহর কথা বলে বিশ্বাস করতে শেখে। এই গোষ্ঠীটিই সাম্প্রদায়িকতার বীজ নিজ জাতির হৃদয়ে বপন করে থাকে, সেই বিষবৃক্ষকে বড় করে তোলে। প্রত্যেকটা ধর্মের মধ্যে এটা হয়েছে। এরাই সাধারণ জনগণকে বলে যে অমুক ধর্মের লোকেরা যদি আপনার পানির গ্লাস ধরে তাহলে সেটা নাপাক হয়ে যাবে, অমুক যদি মসজিদে বা গোরস্তানে ঢোকে তাহলে সে স্থান নাপাক হয়ে যাবে। বহু মসজিদের সামনে এও লেখা আছে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এমন কি মসজিদের রাস্তা দিয়ে মহিলাদের চলাচল নিষিদ্ধ। এমন ধারণা সেটা মহিলাদের বিষয়ে হোক কি অমুসলিমদের ব্যাপারে হোক, এটা কিন্তু ইসলামের ধারণা নয়। এটা সৃষ্টি করেছে ধর্মের ধ্বজাধারী একটি স্বার্থান্বেষী ফতোয়াবাজ গোষ্ঠী। এসব গোঁড়ামিকেই তারা সময় সুযোগমতো নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য, নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে ফলাও করে প্রচার করার জন্য উসকে দেয়। যখন একটি সহিংসতার সূচনা হয় তখন একে কাজে লাগানোর জন্য ছুটে আসে রাজনৈতিক ধান্ধাবাজেরা। তারা একে বাড়িয়ে তুলে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যায়।

এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত সহিংসতা একদিনে সৃষ্টি হয় নি, এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সৃষ্টি হয়েছে। একে দূর করার জন্য সরকার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগাচ্ছেন। কিছু দিন আগে আমরা দেখলাম জঙ্গিবাদী হামলা থেকে নিজেদের উপাসনালয় ও জীবন রক্ষার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাগণ সংখ্যালঘুদের হাতে বাঁশের লাঠি তুলে দিচ্ছেন। আমরা পত্রিকা ও সভা-সমাবেশে বলেছিলাম যে এই বাঁশ বা বাঁশি দিয়ে কাজ হবে না, প্রয়োজন হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আন্তধর্মীয় ঐক্য সম্প্রীতি হিন্দু মুসলমানের ভিতরের যে দেয়াল, যে দূরত্ব সেটা দূর করতে হবে। তাদেরকে ধর্ম থেকেই বুঝতে হবে যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ ভাই ভাই, হিন্দু মুসলিমও পরস্পর ভাই ভাই। সে প্রমাণ ধর্মগ্রন্থের মধ্যেই আছে। তাদেরকে এই শিক্ষাটা দিতে হবে যে সবাই আমরা একই স্রষ্টার সৃষ্টি, এক বাবা-মায়ের সন্তান। হিন্দু মুসলিম বিভক্তি আল্লাহ সৃষ্টি করেন নি। করলে হিন্দুর রক্ত শরীরে গ্রহণ করে মুসলমানের প্রাণ র¶া হতো না। হিন্দুর রক্ত দিয়ে যদি মুসলমানের জীবন রক্ষা হয় তাহলে হিন্দুর স্পর্শে মুসলমানের পানির গ্লাস আর গোরস্তান নাপাক হয়ে যায় না। এই সত্যটি উভয় ধর্মের মানুষকেই বুঝতে হবে।

মুসলমানদেরকে বলতে হবে তোমার ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষের জীবন সম্পদ ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষার কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সেটা একটু জানো। যিশুর মূর্তির নাক ভাঙ্গার বিনিময়ে মিশরের প্রশাসক আমর ইবনুল আ’স (রা.) নিজের নাক খ্রিষ্টানদের সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন কর্তন করার জন্য। এমন উদাহরণ অনেক দেওয়া যাবে। আল্লাহ তো কোর’আনে বলেছেন এমন কোনো জনপদ নেই, জনগোষ্ঠী নেই যেখানে তিনি নবী-রসুল প্রেরণ করেন নি (সুরা ফাতির ২৪)। কাজেই তোমরা যে মহাদেব শিব, মনু, শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র ইত্যাদি চরিত্রকে গালি দিচ্ছ, হতে পারে এরাও প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রেরিত আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। কোর’আনে তো মাত্র সাতাশজন নবীর নাম এসেছে। বাকি লক্ষাধিক নবী-রসুলের অনেকের অনুসারীরাই এখনও নানা ধর্মের পরিচয় নিয়ে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করছেন। এই সম্ভাবনার কথা মুসলিমদের মাথায় রাখতে হবে, অন্য ধর্মের শিক্ষাগুলোর সাথে তারা ইসলামের শিক্ষাকে মিলিয়ে দেখলে এই যে বিদ্বেষ আর অশ্রদ্ধা এটা বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য। কেবল নিজ ধর্ম ও অন্য ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভিতকে মজবুত করে রেখেছে। কোর’আন হাদীসের বহু কথা বেদ, পুরান, মহাভারতে প্রায় হুবহু দেখতে পাবো। তাই এটা হতেই পারে যে সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলোও পূর্ববর্তী নবীদের উপর আল্লাহর নাজিল করা কেতাব বা সহিফা। কাজেই এক ধর্মের অনুসারীরা বেদে আগুন দেবে, আরেক ধর্মের অনুসারীরা কোর’আনে আগুন দেবে এটা যুক্তিহীন।

সুতরাং এক ধর্মের লোকেরা আরেক ধর্মের সত্যগুলোকে স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই স্বীকৃতি দেওয়ার মতো সত্যগুলো কোথায় সেটা আমরা তুলে ধরছি যেন তারা কোনো একটি ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে নিজেদেরকে আপন ভাবতে পারেন, নিজ নিজ বিশ্বাসকে বজায় রেখেই মানুষ হিসাবে নিজেদের মধ্যে বন্ধন গড়ে তোলার প্রেরণা লাভ করতে পারেন। সুতরাং শক্তি দিয়ে আত্মার বন্ধন তৈরি হবে না আর সেটা না হলে সাম্প্রদায়িক হামলার সম্ভাবনাও দূর হবে না।

আমাদের উপমহাদেশে এই যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এর রূপকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা। ভারতের সর্বত্র ইসলাম বিস্তার লাভ করে প্রায় এক হাজার বছর আগে, যা অনেকাংশে বিকৃত হলেও তা মৌলিক শিক্ষার প্রভাবে এই সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে সিংহাসন নিয়ে রাজনৈতিক লড়াই অনেক হয়েছে কিন্তু কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস নেই। মাত্র কিছুদিন আগে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার সভাপতি ও সাবেক বিচারপতি মার্কেন্ডি কাতজু বললেন, ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বলতে গেলে ছিলই না। হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য ছিল বটে, কিন্তু শত্রুতার সম্পর্ক ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও হিন্দু ও মুসলিম একতাবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। বিদ্রোহ দমনের পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দেরকে ঐক্যহীন করার জন্য Divide and Rule নীতি গ্রহণ করেন।” ব্রিটিশরা ১৯৪৭ এ এই উপমহাদেশকে আপাতঃ স্বাধীন করে চলে গেলেও যাওয়ার আগে ধর্মের ভিত্তিতে পাক-ভারতকে ভেঙ্গে ভাগ ভাগ করে রেখে যায় যে ভাগগুলি বিগত বছরগুলিতে নিজেদের মধ্যে বহু যুদ্ধ করেছে এবং আজও একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন, রক্ত¶য়ী সংগ্রামে লিপ্ত। এমনকি আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সহিংসতা এখনও চলছে। এ থেকে মুক্তির পথও আল্লাহ দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা যদি সেই পথে না গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রমূলক Divide and Rule নীতির কুফলকে ললাট-লিখন হিসাবে মেনে নেই, তাহলে এই দাঙ্গা কোনদিনই বন্ধ হবে না। কারণ এক ধর্মের অনুসারীরা সুযোগ পেলেই অন্য ধর্মের বিধাতা ও ধর্মপ্রবর্তকদেরকে গালি দিয়ে, কার্টুন এঁকে, ফটো এডিটিং করে, সিনেমা বানিয়ে ঘৃণা বিস্তার করবেন, ফলে নিভু নিভু আগুন আবার জ্বলে উঠবে। তারচেয়ে বড় কথা এই সহিংসতার সূত্রপাত ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা অজ্ঞ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতির অপপ্রয়োগ থেকে ঘটলেও সেটা দ্রুত চলে যায় স্বার্থবাদী রাজনৈতিকদের কব্জায়। তাই এটা যতটা না সাম্প্রদায়িক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। ব্রিটিশরা যেমন তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে, ষড়যন্ত্র করে হিন্দু ও মুসলিমের রক্ত ঝরিয়েছে, আজও ঠিক সেভাবেই তাদের স্বার্থবাদী রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীরা ধর্মকে ব্যবহার করে ভোটযুদ্ধে জয়ী হবার চেষ্টা করেন। এই চক্রব্যুহ ভেদ করেই সাম্প্রদায়িকতা নামক অপশক্তিকে আমাদের ধ্বংস করতে হবে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...