হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গান

রিয়াদুল হাসান

প্রসঙ্গ কথা: সঙ্গীত সম্বন্ধে ইসলামের ইতিহাস কী বলে?

সঙ্গীত সর্বযুগে সর্বজাতির সংস্কৃতির অঙ্গ। আরবরাও এর বাইরে নয়। কিন্তু ইসলামপূর্ব আরবের সংস্কৃতিতে অনেকভাবে অশ্লীলতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। রসুল সেই সংস্কৃতি থেকে অশ্লীলতা পাপাচারকে বিদূরিত করলেন। আগেও গায়িকারা গান করত, সঙ্গে অশ্লীল নৃত্য ছিল অনুষঙ্গ। অর্থের বিনিময়ে তারা নাচগানের পাশাপাশি দেহব্যবসাও করত। কিন্তু ইসলাম অশ্লীলতাকে হারাম করেছে। সুতরাং সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সমাজের সর্ব অঙ্গন থেকেই যাবতীয় অশ্লীলতা দূর করা হলো। রসুলের সময়ও মদীনায় বিয়ে শাদি বা কোনো দিবসকেন্দ্রিক উৎসবে গান হতো। তখন তো আজকের মতো এত সব বাদ্যযন্ত্র ছিল না, ছিল কেবল দফ জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। সেটা বাজিয়েই তারা অনুষ্ঠান করতেন। একটি বাদ্যযন্ত্র বৈধ হওয়ার অর্থ যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই বৈধ।

জাহেলিয়াতের যুগে আরবে গান আর অশ্লীলতা ছিল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাই অনেক সাহাবি গানকেও ফাহেশা কাজ বা মন্দ কাজ বলে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিলেন। তিনি সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের সূক্ষ্ম ব্যবচ্ছেদ করলেন দক্ষ শল্যবিদের মতো। সঙ্গীতাঙ্গন থেকে বাদ দিলেন অশ্লীলতা, মিথ্যাচার ও আল্লাহর নাফরমানির অংশটুকু আর রেখে দিলেন সঙ্গীত, বাদ্য ও নির্মল বিনোদন। একটি ঘটনা এখানে প্রাসঙ্গিক।

রসুলাল্লাহর নারী সাহাবি রুবাই বিনতে মুআব্বিয ইবনু আফরা (রা.) বলেন, “আমার বাসর রাতের পরের দিন নবী (সা.) এলেন এবং আমার বিছানার ওপর বসলেন, যেমন বর্তমানে তুমি আমার কাছে বসে আছ। সে সময়ে মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিল এবং বদর যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত আমার বাপ-চাচাদের শোকগাঁথা গাচ্ছিল। তাদের একজন গাচ্ছিল, আমাদের মধ্যে এক নবী আছেন, যিনি ভবিষ্যৎ জানেন। তখন রসুলুল্লাহ্ বললেন, এ কথাটি বাদ দাও, আগে যা গাইছিলে তাই গাও (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৫১৪৭)।”

এখানে রসুলাল্লাহ মেয়েদেরকে গান গাইতে বারণ করলেন না, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে একটি মিথ্যা ধারণা তিনি সংশোধন করে দিলেন। অর্থাৎ সঙ্গীত চলবে কিন্তু সঙ্গীতের কথায় মিথ্যার মিশ্রণও থাকা চলবে না।

রসুলাল্লাহ গান নিষিদ্ধ করেন নি, কারণ তিনি জানতেন মানুষের আত্মা আছে, সে পশু নয়। তার চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন আছে। এটা বন্ধ করলে অপ্রাকৃতিক হবে। কিন্তু মানব ইতিহাসের ব্যস্ততম এই পুরুষের পক্ষে গান নিয়ে, শিল্পচর্চা নিয়ে পড়ে থাকার সময় ছিল না। তবু অবসরে নিজ গৃহে অথবা যুদ্ধ থেকে ফিরে সাহাবীদের সঙ্গে তাঁকে গান শুনতে দেখা গেছে এমন হাদীস আমরা যথেষ্ট পরিমাণেই পাই। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, একবার রসুলাল্লাহ কোনো এক সফরে যাচ্ছিলেন। জনৈক উট চালক উটের রশি ধরে হেঁটে যাচ্ছিল আর গান গাচ্ছিল। গান গেয়ে সে উটকে জোরে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করছিল। উটের পিঠে আরোহী ছিলেন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগল। স্ত্রীগণের উটটি রসুলাল্লাহর উটকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। তখন তিনি গায়ককে লক্ষ্য করে বললেন, আনযাশাহ! সাবধানে চলো; এই কাচের পাত্রদের সঙ্গে কোমল আচরণ করো। (মুসনাদে আহমদ, ৩:১৭২, ১৮৭, ২০২)। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ একদিকে যেমন নারীদেরকে সর্ব অঙ্গনে কাজ করার যোগ্য করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন অপরদিকে নারীর সৃষ্টিগতভাবে পুরুষের তুলনায় দুর্বলতর শারীরিক কাঠামোর কথাও তিনি বিস্মৃত হননি।

সঙ্গীত চিরন্তন ও শ্বাশ্বত বিনোদনের মাধ্যম, তাই আরবের নারী-পুরুষ উভয়কেই সঙ্গীতচর্চা করতে দেখা গেছে। রসুলাল্লাহ যখন হেজরত করে মদিনায় এসে পৌঁছান তখন তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আনসারগণ “তালা-আল বাদরু আলাইনা” গানটি গাইতে থাকেন। এই গানটি ১৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো ইসলামি সংস্কৃতির একটি অনন্য নিদর্শন যা আজো গীত হয়।

আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে কোথাও গান ও বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করেন নি, আল্লাহর রসুলও গানবাদ্য হারাম এমন কথা বলেন নি। এগুলো হারাম করেছেন এক শ্রেণির অতি-বিশ্লেষণকারী পণ্ডিত। রসুলাল্লাহর জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে যে তিনি গান শুনেছেন। আম্মা আয়েশা (রা.) খুব সংগীতানুরাগী ছিলেন। তাঁর গৃহে রাসুলাল্লাহর (সা.) উপস্থিতিতেই সংগীত চর্চার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় হাদিস গ্রন্থগুলিতে। নারী সাহাবিদের সঙ্গীতচর্চা নিয়ে তিনটি হাদিস উল্লেখ করছি।

(ক) একবার আরবের একটি জাতীয় উৎসবের দিন ‘বুয়াস দিবস’- এ দুটো মেয়ে রসুলাল্লাহর ঘরে দফ ও তাম্বুরা বাজিয়ে গান গাইছিল। আম্মা আয়েশাও (রা.) গান শুনছিলেন। এমন সময় তাঁর পিতা আবু বকর (রা.) সেখানে আসেন এবং আম্মা আয়েশাকে (রা.) তিরস্কার করেন। তখন আল্লাহর নবী আবু বকরের (রা.) দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবু বকর! তাদেরকে তাদের কাজ করতে দাও” (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৯৮৭)।

(খ) আয়েশা (রা.) একটি মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তাকে এক আনসারের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানস্থল থেকে আয়েশা (রা.) এর প্রত্যাবর্তনের পর রাসুলাল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কি মেয়েটিকে তার স্বামী গৃহে রেখে এসেছো?” উত্তরে তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। পুনরায় রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি এমন কাউকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছ যে গান গাইতে পারে?” আয়েশা (রা.) বললেন, “না”। রাসুলাল্লাহ বললেন, “তুমি তো জান আনসাররা অত্যন্ত সংগীতপ্রিয়” (ইকদ আল ফরিদ)।

(গ) আবু বোরায়দা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.) কোন একটি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী আসহাব মহানবী (স.) এর সামনে এসে বললেন যে- ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি মানত করেছিলাম যে, আপনাকে নিরাপদে আল্লাহ ফিরিয়ে আনলে আমি আপনার সামনে দফ বাজিয়ে গান গাইব।’ মহানবী (স.) বললেন, ‘যদি তুমি মানত করে থাক তাহলে বাজাও। মানত পুর্ণ কর। তারপর মেয়েটি দফ বাজিয়ে গান গাইতে লাগল।’ [তিরমিজি ২য় খণ্ডের ২০৯-২১০ পৃষ্ঠা, মেশকাত শরিফের ৫৫৫ পৃষ্ঠা ও আবু দাউদ শরিফ]।

এই ঘটনাগুলোতে কয়েকটি বিষয় ভাল করে লক্ষ করে দেখুন:

১. যে ঘরে গান হচ্ছে সেটি স্বয়ং রাসুলাল্লাহর ঘর, ২. ঘরে তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, ৩. তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.) সংগীত অনুরাগী ছিলেন, ৪. মেয়েগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিলো, ৫. উৎসবের সাথে সম্পর্কিত গান তা কোনো ইসলামিক গজল ছিল না, ৬. বুয়াস দিবস অর্থাৎ আরবের কোনো জাতীয় দিবস। সেটাও ইসলামিক কোনো অনুষ্ঠান ছিলো না।

উপরোক্ত কোনো ঘটনাতেই স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (সা.) সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রকে নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করেন নি। বরং আবু বকর (রা.) ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও রাসুল (সা.) তাদেরকে গান চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে এই সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করল কারা? ইসলাম সুর-সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রকে কখনই নিষিদ্ধ করে নি। নিষিদ্ধ করেছে অশ্লীলতা, নোংরামী এবং অন্যের ক্ষতি হয় এমন বিষয়কে। অশ্লীলতা নিশ্চয়ই কোনো ধর্মই সমর্থন দেয় না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...