হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

রসুলাল্লাহর (সা.) প্রকৃত সুন্নাহ কী?

মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী

মুসলিম জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা পাই, ঐ সদ্যপ্রসূত জাতি যার নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু মিলিয়ে সংখ্যায় পাঁচ লাখও হবে না, অর্থ সম্পদ নেই, প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, প্রায় নিরস্ত্র তবুও রসুলের শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে রসুলের আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ থেকে বহিরাগত হয় এবং তৎকালীন দুই দুইটি পরাশক্তি (Super Power) রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেই রোমান ও পারস্যের নিকট ছিল বিরাট সুসজ্জিত বাহিনী, অপরিমিত সম্পদ, অসংখ্য লোকবল ও উন্নত প্রযুক্তি। যেকোন সামরিক বিশারদকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন তবে সে এই ঘটনাকে নির্দ্বিধায় আত্মহত্যার সাথে তুলনা করবেন। কারণ যদি তাঁরা হেরে যেতেন তবে শুধু তাদেরকেই নয় সমগ্র জাতিকে দুই পরাশক্তি মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতো এবং যদি তা ঘটতো তবে আজ ইসলাম বলে কোন দীন থাকত না ও মুসলিম বলেও কোন জাতি থাকত না।

কিন্তু ইতিহাস বলে ঐ দুই পরাশক্তি এ সদ্য প্রসূত জাতির সামনে টিকতেই পারলো না এবং তারা ঝড়ে খড়-কুটার মতো উড়ে গেল। উম্মতে মোহাম্মদী মাত্র ৬০-৭০ বছরেই পশ্চিমে মরক্কো, আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে পূর্বে চীনের সীমান্ত আর উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এই শেষ জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল। আপাতদৃষ্টিতে এ মহা বিজয় অসম্ভব মনে হলেও এ উম্মাহ দৃঢ়ভাবে আল্লাহ প্রদত্ত পাঁচ দফা কর্মসূচী ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হেজরত ও জেহাদের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ করার মাধ্যমে এ অসম্ভবকে সম্ভব করল। আল্লাহ স্বয়ং এই উম্মাহকে সহায়তা করেছিল কারণ উম্মাহ ছিল আল্লাহর রসুলের আদর্শে আদর্শিত। তাদের আকিদা ছিল সঠিক আর তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন মো’মেন। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন তিনি মো’মেনদের সাথে ওয়াদাবদ্ধ ও তিনি মো’মেনদের ওয়ালী অর্থাৎ অভিভাবক। যে জাতির অভিভাবক স্বয়ং আল্লাহ সে জাতি কখনই পরাজিত হতে পারে না।

রসুলের আসহাবরা বুঝেছিলেন তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যদি তাঁরা পালন না করে তবে রাসুলের উপর মহান আল্লাহ যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, রসুল যে দায়িত্ব পূরণের জন্য এই ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করলেন তার সবকিছুই ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাঁরা বুঝতে পেরেছিল তাদের সংগ্রাম ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না এ সত্য দীন সমগ্র দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচারের শীতল ছায়ায় ধরণীকে ঠাণ্ডা করতে পারে। তাঁরা বুঝে ছিল মানুষকে বুঝিয়ে, কথার মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে অর্থাৎ সর্বাত্মক চেষ্টা করে সার্বিকভাবে এ দীনকে প্রতিষ্ঠা করাই তাদের মানবজন্মের ও জীবনের মূল লক্ষ্য। একজন মো’মেন, মুসলিমের জীবনের মূল টার্গেট। এই কাজের বিশালতা, সংকট কোনটিই তাঁদেরকে এক মুহূর্তের জন্যও পিছপা করতে পারে নি কারণ তাঁরা রসুলের পবিত্র মুখ থেকে শুনেছিলেন, “যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করবে সে আমাদের কেউ না।” রসুল ‘আমাদের কেউ না’ বলতে যে উম্মতে মোহাম্মদী নয় বুঝিয়েছেন তা তাঁরা বুঝতে পেরেছিল। আইহ্যামে জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত জাতি রসুলের সুন্নাহ পাওয়ার ফলে এক রাতে যে বিশ্বজয়ী জাতিতে পরিণত হয়েছিল তার কয়েকটি উদাহারণ ইতিহাস থেকে তুলে ধরছি।

উম্মতে মোহাম্মদী এ শেষ দীনকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে গিয়ে যখন পৌঁছাল তখন তাঁরা দেখলেন তাদের সামনে মহাসমুদ্র, আর এগোবার পথ নেই। তখন বাহিনীর সেনাপতি উকবা বিন না’ফে আটলান্টিক মহাসমুদ্রে তাঁর ঘোড়া নামিয়ে দিলেন এবং যতদুর পর্যন্ত ঘোড়ার পায়ের নিচে মাটি থাকে ততদূর এগিয়ে গেলেন তারপর আকাশের দিকে দু-হাত তুলে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! এ মহাসমুদ্র বাধা না দিলে আমরা তোমার রাস্তায় আরো সম্মুখে অগ্রসর হতাম।’

অন্যদিকে পশ্চিম দিকে বাহিনীর সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রা.) মিশরের আর্চ বিশপের কাছে তাঁর প্রতিনিধি স্বরূপ একটি দল প্রেরণ করলেন যার দলপতি তিনি নিযুক্ত করলেন আবু উবায়দা (রা.) কে। আবু উবায়দা (রা.) নিগ্রো ছিলেন তাই আর্চ বিশপ প্রথমে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে চান নি। পরবর্তিতে যেহেতু দলপতি সে হিসেবে বাধ্য হয়ে যখন কথা বলতে হল তখন আবু উবায়দা (রা.) বললেন, ‘আমাদের বাহিনীতে আমার মত এক হাজার কালো লোক রয়েছে, আমরা বেঁচেই রয়েছি আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের উৎসর্গ করে এ সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমরা ধন দৌলতের কোন পরোয়া করি না। আমাদের শুধু পেটের ক্ষুধা মেটানো আর পরার কাপড়ের বেশি আর কোন চাহিদা নেই। আমাদের কাছে এ পৃথিবীর জীবনের কোন মূল্য নেই। পরকালের জীবনই আমাদের কাছে সব।’

আল্লাহর রসুলের ইসলামের সঠিক আকিদা তাঁরা বুঝতে পেরেছিল তাই তাঁরা তাদের জীবনের আকিদা সম্পর্কে ছিল সন্দেহমুক্ত ও দৃঢ়। কিন্তু বর্তমানে আমরা রসুলের এ প্রকৃত সুন্নাহকে ভুলে গিয়ে রসুলের সুন্নাহ বিকল্প হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস-অনভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি যেগুলোর সাথে তাঁর জীবনের মূল উদ্দেশ্য তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বের কোন সম্পর্ক নেই, সেগুলোকে গ্রহণ করা হয়েছে। নিষ্ঠুর ইতিহাস এই যে বর্তমানের সর্বাত্মক সংগ্রাম ত্যাগকারী মুসলিমদের কাছে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ট বিপ্লবীর সুন্নাহ হিসেবে তাঁর বিপ্লব নয়, গৃহিত হল তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস যেমন মেসওয়াক করা, খাবার আগে জিহ্বায় একটু লবণ দেয়া, খাবার পর মিষ্টি খাওয়া ইত্যাদি। কী পরিহাস! আজ পর্যন্ত ইতিহাসে কোন জাতির নেতার এমন অপমানকর অবমূল্যায়ন হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই!

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...