হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

নারীদের জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ ইসলামসম্মত

মুস্তাফিজ শিহাব

প্রচলিত ইসলামের ধ্যান-ধারণা মোতাবেক নারীদের কারো জানাজায় অংশগ্রহণের অনুমতি নেই, এমন কি স্বামী সন্তানের জানাজাতেও না, নারীদের জানাজাতেও না। কিন্তু প্রকৃত ইসলামের ইতিহাস অন্য কথা বলে। রসুলাল্লাহর ঘনিষ্ঠ সাহাবি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) যখন এন্তেকাল করেন তখন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণ তাঁর জানাজায় অংশ গ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁর মৃতদেহ মসজিদে নিয়ে আসার জন্য বলেন। তাঁদের কথা মোতাবেক সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রা.) দেহ মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে নিয়ে আসা হয়। তখন তাঁর জানাজার সালাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু সাহাবি অংশগ্রহণ করেন। রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণও তাতে অংশগ্রহণ করেন। এ হাদিসটি সহিহ মুসলিম শরীফের জানাযা অধ্যায়ের মসজিদে জানাযা পড়া অনুচ্ছেদের (৩য় খ-) ৬৩ পৃষ্ঠায় রয়েছে।

এ ঘটনাটি থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নারীদেরকে জানাজায় অংশ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সিদ্ধান্তটি ইসলামের নয়, এই ধ্যান ধারণার জন্ম হয় বহু পরে যখন পর্দা প্রথার নামে নারীদেরকে পেছনে ফেলে রাখার নানা মাসলা-মাসায়েল আবিষ্কার করা হয় তখন। পুরুষ শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায়, সমাজের নিয়ন্ত্রক হওয়ায় তারা চিরকাল চেয়েছে নারীদেরকে পদানত আর আজ্ঞাবহ করে রাখতে। তাদেরকে মানুষের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করাই ছিল সচরাচর সমাজবিধি। তাদেরকে এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সংগ্রাম করে গেছেন সকল নবী-রসুল অবতারগণ।আরবের জাহেলিয়াতের যুগে যে নারীদের কোনো মানবিক মর্যাদা ছিল না, যারা ছিল ভোগের উপকরণ, কন্যা সন্তান হলে পিতার মুখ অন্ধকার হয়ে যেত, তাদেরকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা পর্যন্ত করত সেই নারীদেরকে আখেরি নবী পুরুষের পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে অবাধ অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তারা মসজিদে গেছেন, সালাতে, ঈদে, জুমায়, আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছেন, তারা হাসপাতালের পরিচালক হয়েছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন, রসুলের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছেন। যুদ্ধে নারীরা রসদ সরবরাহের দায়িত্ব থেকে শুরু করে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে দুর্দান্ত ও বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকা রেখেছেন। মুসলিম জাতির বহু নারী ছিলেন দুর্ধষ যোদ্ধা যারা রোমান-পারস্যের প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদেরকে বারবার ধরাশায়ী করেছেন। জেনারেল এ আই আকরামের দ্য সোর্ড অব আল্লাহ গ্রন্থে তিনি উম্মতে মোহাম্মদীর নারীদের বীরত্বগাঁথার বহু বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন তিনি দেরার বিন আজওয়ার এর বোন খাওলা বিনতে আজওয়ারের বীরত্বে কথা বলেছেন। রোমান সম্রাটের কাছে খবর গেল যে মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে কিছু কমান্ডার আছেন যারা শরীরে বর্ম না পরেই যুদ্ধ করেন। তারা ছিলেন মৃত্যুভয়হীন, বেপরোয়া ও শাহাদাতপিপাসু। এদেরকে বলা হতো নেকেড ওয়ারিয়র। দেরার ছিলেন এদেরই একজন। রোমান সম্রাট তাঁকে জীবন্ত বন্দী করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। রোমান বাহিনীর সৈন্যরা অনেক কষ্ট করে যুদ্ধের একটা পর্যায়ে দেরারকে ঘিরে ফেলে এবং তাঁকে বন্দী করতে সক্ষম হয়। ঐ ময়দানেরই অন্য অংশে যুদ্ধ করছিলেন তাঁরই বোন খাওলা। ভাইয়ের বন্দী হওয়ার সংবাদ যখন খাওলার কানে গেল তিনি কালবিলম্ব না করে একটি প্রশিক্ষিত ঘোড়ায় চড়ে হাতে বল্লম আর খোলা তলোয়ার নিয়ে ছুটে যান অকুস্থলে। গিয়ে তিনি বহুসংখ্য রোমান সৈন্যকে একটা পরাভূত করে ভাইকে উদ্ধার করে আনেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াই দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেন মহাবীর খালেদ। তিনি খাওলাকে ডাকেন এবং তাঁর বীরত্বের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন।

এই ছিল মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নারীর জায়গা। আর আজকে মসজিদে পর্যন্ত নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। তাদেরকে আবৃত করে রাখা হয়েছে কালো কাপড়ে। তাদের সামনে দিবানিশি কেবল তাদের একটা চুলও যদি দেখা হয় তাহলে কী ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে সেই বিবরণ শোনানো হয়। যার পরিণাম এই হয়েছে যে, জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী অবলায় পরিণত হয়েছে। তারা জাতিরক্ষায় ভূমিকা রাখা তো দূরের কথা, সামান্য বখাটে ছোকড়াদের হাত থেকে নিজেদের ইজ্জতটাও রক্ষা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। মুসলিম নারী তো এমন ছিল না। কে তাদেরকে এমন জড়বুদ্ধি-অথর্ব বানালো, জাতির বোঝায় পরিণত করল?
আজকে ইসলামের নামে যে সব নারী নিগ্রহকারী ফতোয়ার জাল বিস্তার করা হচ্ছে সেসব দেখে যুক্তিশীল শিক্ষিত মানুষ ভাবছে যে ধর্মগুলোই হলো নারী প্রগতির অন্তরায়। তারা রসুলাল্লাহর সৃষ্ট নারীদের ইতিহাস দেখতে রাজি নয়, দেখার দরকারও তাদের নেই। কারণ তারা বর্তমানে নারীদের আপাদমস্তক কালো বোরকা আর মুফতিদের চাপিয়ে দেওয়া পরহেজগার রমণীর কর্তব্যগুলো দেখেই ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের উপাদানগুলো পেয়ে যাচ্ছে। যারা ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীদের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না, তারা অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে ইসলামবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছেন। এই হচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজির নেট ফল। কারো জানাজায় একজন নারী অংশ নিলে সমাজের ক্ষতিটা কী সে প্রশ্নটি কেউ করছে না, বরং ধরেই নিয়েছে যে ইসলামের বিধানগুলো নারীদের জন্য অপমানজনক। কে তাদেরকে বলে দেবে যে, রসুলের যুগের নারীরা এমন কি তাঁর স্ত্রীরাও যে কোনো নারী বা পুরুষের জানাজায় অংশ নিতেন? ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে ইসলামবিদ্বেষীদের জবাব দেওয়ার কাজটি ছিল আলেম ওলামাদের। কিন্তু সেটি না করে তারা শত শত বছর ধরে, এমন কি আজকের দিনটি পর্যন্ত বেগানা নারীকে দেখলে কী ভয়াবহ গজব জাতির উপর নেমে আসবে সেই ওয়াজেই ব্যস্ত। ফলে আধুনিক নারীরাও ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। তাই যারাই ইসলামকে ভালোবাসেন তাদের সবার দায়িত্ব এখন ইসলামের প্রকৃত রূপটি তুলে ধরা এবং হাজার বছরের ফতোয়ার নিচে চাপা পড়ে থাকা অনাবিল সত্য ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরা।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...