হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জান্নাতি ফেরকা কারা?

সুলতানা রাজিয়া:
ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে কী কী ঘটবে- এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর রসুল এই উম্মাহকে সাবধান করে গেছেন। এইসব সাবধানবাণীর মধ্যে কিছু আছে এমন যে তা থেকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, যেমন- দাজ্জাল, কেয়ামত, ইয়াজুজ মাজুজ ইত্যাদি সংক্রান্ত হাদিসের বর্ণনাগুলো; আর কিছু এমন আছে যা থেকে শুধু মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উম্মাহর ভবিষ্যৎ বলতে গিয়ে তেমনি একটি সাবধান বাণী দিয়েছিলেন আল্লাহর রসুল। তিনি বলেন, ‘‘বনি ইসরাইলরা (ইহুদিরা) বাহাত্তর ফেরকায় (ভাগে) বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। এর একটি ভাগ ছাড়া বাকি সবই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।” সাহাবারা প্রশ্ন করলেন-“ইয়া রসুলাল্লাহ! সেই একমাত্র জান্নাতি ফেরকা কোনটি?” তিনি জবাব দিলেন-“যার উপর আমি ও আমার সঙ্গীরা (আসহাব) আছি।’’
আজ পৃথিবীময় মুসলিম জাতির বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থাই প্রমাণ করে রসুলের ঐ ভবিষ্যদ্বাণী কতখানি সত্য হয়েছে। এই জাতি বর্তমানে শিয়া, সুন্নি, শাফেয়ী, হাম্বলী, আহলে হাদীস ইত্যাদি ফেরকা-মাজহাব ও নানাবিধ তরিকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে যাদের সবাই দাবি করে একমাত্র তাদের ফেরকাই সঠিক ইসলামে আছে আর অন্যরা পথভ্রষ্ট। কিন্তু আল্লাহর রসুল বলে গেলেন- না, তারা যতই নিজেদেরকে জান্নাতি ফেরকা ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করুক একমাত্র জান্নাতি ফেরকা সেটাই যেটার উপর তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এর দ্বারা আল্লাহর রসুল মানদণ্ড ঠিক করে দিলেন যে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা যেভাবে ইসলাম বুঝেছেন ও নিজেদের জীবনে চর্চা করেছেন সেটাই কেবল মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়, অন্য কারোটা নয়। যেমন উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, ওসমানীয়, পাঠান, মোগলরা কীভাবে ইসলামের চর্চা করল, আলেম মুফতি মোহাদ্দীস মাওলানা বুজুর্গদের মধ্যে কে কী বললেন সেগুলো এই দ্বীনের মানদণ্ড হতে পারে না। কাজেই ওগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সঠিক দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো ফেরকা, কোনো দল, কোন মাজহাব বা কোনো তরিকা দাবি করে যে, একমাত্র তাদের আকীদাই সঠিক, তাদের কর্মপন্থাই সঠিক কর্মপন্থা, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ঠিক সেইভাবে ইসলামকে বুঝেছেন যেভাবে আল্লাহর রসুল ও তাঁর সঙ্গীরা বুঝেছিলেন এবং তারা সেটাই করছেন যেটা আল্লাহর রসুল ও তাঁর সঙ্গীরা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি কী ছিল?
আল্লাহর রসুল যখন নব্যুয়ত লাভ করলেন তখন আরবের অবস্থা ছিল এই যে, জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত পশ্চাদপদ একটি জনসংখ্যা, যারা সর্বদা নিজেরা নিজেরা অনৈক্য-সংঘাতে লিপ্ত থাকত, কাঠ-পাথরের মূর্তি বানিয়ে পূজা করত, আর হুকুম মান্য করত ঐসব দেব-দেবীর পুরোহিত তথা ধর্মব্যবসায়ী কোরাইশ নেতাদের। এই পুরোহিতদের কাছে এমন কোনো মানদণ্ড ছিল না যেটার ভিত্তিতে জনগণকে পরিচালিত করতে পারে। তাদের শাসন ছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতির, ফলে অন্যায় অবিচার রক্তপাতে নিমজ্জিত হয়েছিল পুরো জনগোষ্ঠী। এই অবস্থায় আল্লাহর রসুল যা করলেন তা হচ্ছে-

  1. তিনি পুরো জনগোষ্ঠীকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যের ডাক দিলেন। ঘোষণা দিলেন আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই, ন্যায় অন্যায়ের মানদণ্ড হবে আল্লাহর হুকুম। বহু নির্যাতন, নিগ্রহ আর অপমানের চড়াই উতরাই অতিক্রম করার পর এক সময় এই মানদণ্ড গৃহীত হলো। সবাই মেনে নিল যে, আল্লাহ যেটাকে জায়েজ করেন সেটা জায়েজ ও যেটা হারাম করেন সেটা হারাম, আল্লাহ যেটাকে সত্য বলেন সেটা সত্য, যেটাকে মিথ্যা বলেন সেটা মিথ্যা। এই সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ হবার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে একের পর এক হুকুম আসতে লাগল আর জাতিটি অক্ষরে অক্ষরে তার বাস্তবায়ন করতে লাগল। তারা মদ খাওয়াকে খারাপ মনে করত না। কিন্তু যেইমাত্র আল্লাহ মদ হারাম করলেন, সবাই নির্দ্বিধায় মদ খাওয়া ছেড়ে দিল, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে উঠল মদের প্রবাহে। আল্লাহ দ্বীনের কাজের বিনিময় নেওয়াকে হারাম করেছেন, তাই রসুলের একজন সাহাবীকেও ইতিহাসে দ্বীনের কাজের বিনিময় নিতে দেখা যায় না। কোর’আনের আয়াত নিয়ে, দ্বীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে চূলচেরা বিশ্লেষণ ও মতভেদ করা হারাম, কেননা এতে জাতির লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে ও জাতির ঐক্য নষ্ট হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই রসুলের হাজার হাজার সঙ্গী-সাথীর মধ্যে এমন কাউকে পাই না যিনি কোর’আনের আয়াত নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছেন বা সারাদিন ঘরে বসে বসে কোর’আনের কোনো আয়াতের গুপ্তঅর্থ বের করার চেষ্টা করেছেন, কিংবা দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তৈরি করেছেন। একই কারণে রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের জীবনে আমরা কোনো ফেরকাবাজী দেখি না, শিয়া-সুন্নির টিকিটুকুও খুঁজে পাই না। এক কথায় জাতি ছিল আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ। কেউ শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে রিপুতাড়িত হয়ে যদি কালেভদ্রে আল্লাহর কোনো হুকুম অমান্য করেও ফেলত, অপরাধ করে ফেলত, তার শাস্তিও হত আল্লাহর হুকুম মোতাবেক। ফল হয়েছিল সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার। এমন শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলো একা একজন মেয়ে মানুষ রাতের অন্ধকারে কয়েকশ’ মাইল পথ হেঁটে যেত বন্য জন্তু ছাড়া কোনো ভয় অন্তরে জাগ্রত হত না। স্বচ্ছলতা এমন হয়েছিল মানুষ খাদ্যদ্রব্য নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু গ্রহণ করার লোক ছিল না। এইসবই সম্ভব হয়েছিল আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার ফলে।
  2. কিন্তু আল্লাহর রসুল তো কেবল আরবের জন্য আসেন নি, এসেছেন সমস্ত মানবজাতির জীবনে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ঐ জাতিটিকে ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্যের সমন্বয়ে এমনভাবে গড়ে তুললেন যেন তাঁর অবর্তমানেও জাতিটি তাঁরই মত করে সংগ্রাম করতে থাকে এবং বাকি দুনিয়াতেও আল্লাহর সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার আনয়ন করতে পারে। এজন্য জাতিকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে হয়েছে, অন্তর্মুখী মানুষগুলোকে বহির্মুখী করতে হয়েছে। কোর’আনে আল্লাহ বারবার সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা বলেছেন এবং সংগ্রাম ছাড়লে কঠিন শাস্তি পেতে হবে এই সতর্কবাণীও অনেকবার উচ্চারণ করেছেন, আর রসুল (সা.) হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে হয়। আল্লাহর রহমে এমন একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ তিনি পেয়েছিলেন যারা কখনই তাঁর সঙ্গ ছাড়েন নি। সর্বাবস্থায় তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার প্রতি অনুগত থেকে নিজেদের জীবনের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন নেতার পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যকে সফল করতে। আর তা করতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, গাছের লতা পাতা খেয়ে, মারধোর খেয়ে, নির্যাতন সহ্য করে, পেটে পাথর বেঁধে থেকে, আত্মীয়-স্বজন-পরিবার-পরিজন-খেত-খামারের মায়া উপেক্ষা করে এবং সবশেষে প্রিয় নেতার পদতলে নিজেদের প্রাণটুকুও উৎসর্গ করার জন্য বারবার যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শত্রুর আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়েছেন, প্রিয় নেতাকে শত্রুর তীর থেকে রক্ষা করতে নিজেদের দেহকে ঢাল বানিয়ে তীরে তীরে সজারুর মত হয়ে গেছেন কিন্তু লক্ষ্য থেকে একচুলও সরে যান নি। এভাবে সমগ্র জাজিরাতুল আরবে সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন রসুল (সা.) আল্লাহর কাছে চলে গেলেন, ইতিহাসে পাই, সেই সময়ে সমগ্র উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটি একসাথে ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, খেত খামার সবকিছু বিসর্জন করে পৃথিবীর বুকে বেরিয়ে পড়ল এবং একইসাথে পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে অর্ধপৃথিবী জয় করে নিল। এই যে উম্মতে মোহাম্মদীর বিস্ফোরণ, এর লক্ষ্য কি ছিল পররাজ্য ও পরসম্পদ লুট করা? কখনই না। উদ্দেশ্য এই ছাড়া আর কিছুই নয় যে, আল্লাহ তাঁর রসুলকে পৃথিবীময় সত্য প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার আনয়নের যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং সারাজীবন সংগ্রাম করে আরব উপদ্বীপে সত্য প্রতিষ্ঠার পর রসুল (সা.) বাকি পৃথিবীতেও সত্য প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির উপর অর্পন করে গেছেন সেই দায়িত্ব পূরণ করা। হলোও তাই, মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর কর্তৃত্ব লাভ করল এই জাতিটি। এই জাতির সামনে দাঁড়াবার মত কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই তখন। তারা চাইলে এক নিমেষেই বাকি পৃথিবীতেও সত্য প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর-রসুলের অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে সক্ষম হত এবং তার ফলে সমস্ত পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অনিরাপত্তা দূর হয়ে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হত। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই জাতির যে, জাতিটি মোটামুটি ৬০/৭০ বছর তাদের লক্ষ্য ঠিক রেখে নেতার অর্পিত দায়িত্ব পালন করার পর এক সময় আল্লাহর রসুলের সঙ্গী-সাথীরা এক এক করে যখন সকলেই পরলোকগত হয়ে যান, তারপর অন্যরা তাদের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে অপরাপর রাজা-বাদশাহদের মত রাজত্ব করতে শুরু করল, ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিল। বিকৃতি ও জাতির পতনের শুরু সেখান থেকেই। এই যে সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়ার মত মহাভুলটি করা হলো, তারই মাশুল দিতে হচ্ছে জাতিকে গত ১৩০০ বছর ধরে নিজেরা নিজেরা অনৈক্য-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে এবং অন্য জাতিগুলোর দ্বারা পরাজিত ও গোলামিতে নিমজ্জিত হয়ে।

এতক্ষণে পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আল্লাহর রসুল ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা কীসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। দু’টি বিষয় মাত্র। এক- আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং দুই- রসুল (সা.) এর পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীময় ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করে যাওয়া। ব্যস, এই দুইটি শর্ত যারা পূরণ করতে পারবেন তারাই মো’মেন (হুজরাত ১৫), তারাই সেই জান্নাতি ফেরকা তাতে সন্দেহ নেই।
[সুলতানা রাজিয়া: মনোবিজ্ঞানী; ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...