হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কী দিল এই বস্তুবাদী সভ্যতা? (৩য় পর্ব)

১৫৩৪ সনে ব্রিটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মকে মানুষের সার্বিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসিত করার সময় থেকেই শুরু হয় মধ্যযুগ থেকে আধুনিক ইউরোপের পথচলা। একটি নতুন সভ্যতার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। অবশ্য এই বিকাশ ও উন্নতি কেবল বৈষয়িক জীবনের, চারিত্রিক নয়। ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা ক্রমেই বস্তুবাদী (Materialistic) হয়ে পড়তে শুরু করল। এটা একটা পরিহাস (Iroû) যে, যে জাতির সকল লোক এমন একটি ধর্ম গ্রহণ করলো যে ধর্মের মূলমন্ত্রই হচ্ছে আত্মশুদ্ধি, কেউ এক গালে চড় দিলে তাকে অন্য গাল পেতে দাও, জোর করে গায়ের কোট খুলে নিলে তাকে আলখেল্লাটাও দিয়ে দাও, সেই জাতি একটি কঠোর বস্তুবাদী সভ্যতার জন্ম দেবে। তারা প্রথমেই সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও ভৌগোলিক আবিষ্কার শুরু হয়। সমুদ্রতীরের দেশসমূহের মানুষজনের পেশা ছিল মাছ ধরা ও ব্যবসা বাণিজ্য। তবে মহাসাগর অতিক্রম করার কথা প্রথমে ভাবে পর্তুগিজ ও স্পেনিশ নাবিকরা। এসব অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে লাভজনক উপনিবেশিক রাজত্বের বিস্তার। নতুন নতুন ভূখণ্ড ও সমুদ্রপথ আবিষ্কারকারী নাবিকদের মধ্যে কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামা, বার্থোলোমে দিয়াজ, ম্যাগেলান অন্যতম। তাদের দুঃসাহসী অভিযানের দ্বারা নতুন গোলার্ধ, নতুন মহাদেশ, নতুন দেশ, নতুন দ্বীপ, নতুন সভ্যতা আবিষ্কৃত হল। আমেরিকা মহাদেশ, ভারতর্ষ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার অধিকাংশ ভূখণ্ডই ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতি দখল করে নিল।

১৫শ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই আবিষ্কার ও অনুসন্ধানের যুগে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ব্যাপক সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায় এবং বিশ্বায়নের সূচনা করে। ইউরোপে উপনিবেশবাদ ও বাণিজ্যবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটে এবং তা বিভিন্ন দেশের জাতীয় নীতি হিসবে গৃহীত হয়। ইউরোপিয়ানদের সমুদ্র অভিযানে দাস ব্যবসার বিশ্বায়ন শুরু হয়। স্পেনীয়রা আমেরিকায় পৌঁছালে সেখানকার বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে রাস্তাঘাট নির্মাণে প্রচুর সস্তা শ্রমিকের দরকার পড়ে। তারা দেখল যে ক্রীতদাস প্রথাই আদর্শ সমাধান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পেরু, মেক্সিকো, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের গরিব জনগণকে ধরে ধরে দাস বানিয়ে এ কাজ উদ্ধা করা হল। মাটি খুঁড়ে সোনা রূপা কয়লা বের করতে আরও দাস দরকার পড়ল। এভাবে গড়ে প্রতি বছরে ৭৫ হাজার থেকে ৮৬ হাজার দাসকে আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারের আমেরিকা মহাদেশে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা উচ্ছেদের ঘোষণা (Emancipation Proclamation-1863) দিলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিগ্রহ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়।

এদিকে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটতে থাকে। মুসলিম বিজ্ঞানীদের বহুবিধ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের ভিত্তির উপর নতুন প্রযুক্তিগত সভ্যতার ইমারত প্রতিষ্ঠা করেন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা। এই কারিগরি আবিষ্কারগুলো ইউরোপে সামতন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে নতুন ধনতন্ত্রের পথ সুগম করেছে। এই প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে অশ্বশক্তি, জলশক্তি ও বায়ুশক্তির ব্যবহার। সমুদ্রপথে চলাচলের জন্য জাহাজের হাল ও কম্পাসের আবিষ্কার, বারুদের আবিষ্কার; কাচ, কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার। এই সকল প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পেছনে মুসলিম আবিষ্কর্তাদের বিপুল অবদান রয়েছে। এভাবে জ্ঞান হাতবদল হয়ে প্রাচ্য থেকে ইউরোপে চলে আসে। ইউরোপের পদানত দাসে পরিণত হতে থাকে একের পর এক মুসলিম ভূখণ্ড।

এভাবে ইউরোপীয়দের চিন্তার ঘরের এক হাজার বছরের রুদ্ধদ্বার খুলে যায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে, শিল্পবিপ্লবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, ব্যাঙ্ক বীমা স্থাপনে, কৃষিতে, সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায়, চিকিৎসায়, প্রকৌশলে, যুক্তিবিদ্যায়, দর্শনে, শিল্পে, সাহিত্যে বিকশিত হয়ে উঠল। অতীতের ভাববাদী দর্শনের পৃষ্ঠাকে উল্টে রেখে সকল বিষয়ে একটি বস্তুবাদী দর্শন, সকল প্রশ্নের, সকল ইতিহাসের একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলল। আগে মানব ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা হত আদম-হাওয়া থেকে, এখন ডারউইনসহ অন্যান্য প্রকৃতিবিদগণ নিয়ে আসলেন বিবর্তনবাদ। বিশ্বজগৎ সৃজনের কৃতিত্বও আর স্রষ্টাকে দেওয়া হল না, বলা হল আমরা একটি আকস্মিকভাবে সৃষ্ট মহাবিশ্বে (an accidental universe) বাস করছি। বিজ্ঞান ও ধর্মকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানো হল। এই যুগটিকে আলোকায়নের যুগ (১৬৮৫-১৮১৫), Age of Enlightenment অথবা Age of reason বলা হয়ে থাকে। আলোকিত যুগের দর্শনের মতে ক্যাথেলিক চার্চের কর্তৃত্বের পাশাপাশি রাজতন্ত্রও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। তারা এসকল প্রথা বা ঐতিহ্যের পরিবর্তে যুক্তিনির্ভর একটি সমাজকাঠামো গড়ে তুলতে মানুষকে উৎসাহিত করেন।

ফ্রান্সের সাধারণ মানুষকে রাজার আরোপ করা কর, গির্জা কর্তৃক আরোপ করা কর, ভুস্বামী বা জমিদারদের আরোপ করা কর দিতে হতো। আইনও ছিল গরিবের বিপক্ষে। তাদের বিচার করার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হতো না। সব মিলিয়ে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। মানুষ সামাজিক বৈষম্য, কর্মহীনতা, ক্ষুধা, প্রভাবশালী, অভিজাত, বুর্জোয়া শ্রেণির আগ্রাসন, করারোপের মাধ্যমে শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়ষ লুইয়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ডাক দেন আলোকিত যুগের অন্যতম প্রবক্তা জ্যাক রুশো। তিনি তাঁর লেখনির মাধ্যমে ফরাসি মননে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জাগ্রত করতে সক্ষম হন। মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, দেনিস দিদেরো প্রমুখ লেখক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাহিত্যিকগণও ফরাসি বিপ্লবের (১৪ জুলাই ১৭৮৯) মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুতে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল। মানুষের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। বহুদেশে রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব গোটা মানব সভ্যতাকে বস্তুবাদী ধর্মবিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনভাবে লিখতে ভূমিকা রেখেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। উনিশ শতকে ফ্রান্স ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে নতুন ভাবধারার সূচনা করেছিল এই বিপ্লব।

খ্রিষ্টধর্ম মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা ব্যর্থ হওয়ার পর সার্বভৌমত্ব আল্লাহর হাত থেকে মানুষের হাতে তুলে নেবার পর সংবিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি তৈরী করে মানব জীবন পরিচালনা আরম্ভ হলো, যার নাম দেয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র (Secular Democracy)। টমাস হবস, ডেভিড হিউম, জন লক, স্পিনোজা প্রমুখ দার্শনিকগণ তাঁদের বিভিন্ন তত্ত্বে এই সংসদীয় গণতন্ত্রের রূপরেখা প্রস্তাব করেন। এই গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রইলো মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে। অর্থাৎ মানুষ তার সমষ্টিগত, জাতীয় জীবন পরিচালনার জন্য সংবিধান ও সেই সংবিধান নিঃসৃত আইন-কানুন প্রণয়ন করবে শতকরা ৫১ জন বা তার বেশী। যেহেতু মানুষকে আল্লাহ সামান্য জ্ঞানই দিয়েছেন সেহেতু সে এমন সংবিধান, আইন-কানুন দণ্ডবিধি, অর্থনীতি তৈরী করতে পারে না যা নিখুঁত, নির্ভুল ও ত্রুটিহীন, যা মানুষের মধ্যকার সমস্ত অন্যায়, অবিচার দূর করে মানুষকে প্রকৃত শান্তি (ইসলাম) দিতে পারে। কাজেই ইউরোপের মানুষের তৈরী ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল আইন-কানুনের ফলে জীবনের প্রতিক্ষেত্রে অন্যায় ও অবিচার প্রকট হয়ে উঠলো। বিশেষ করে অর্থনৈতিক জীবনে সুদভিত্তিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করায় সেখানে চরম অবিচার ও অন্যায় আরম্ভ হয়ে গেলো। মুষ্টিমেয় মানুষ ধনকুবের হয়ে সীমাহীন প্রাচুর্য্য ও ভোগবিলাসের মধ্যে ডুবে গেলো আর অধিকাংশ মানুষ শোষিত হয়ে দারিদ্র্যের চরম সীমায় নেমে গেলো। স্বাভাবিক নিয়মেই ঐ অর্থনৈতিক অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ইউরোপের মানুষের এক অংশ বিদ্রোহ করলো ও গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রকে বাদ দিয়ে নতুন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসন্ধান করতে শুরু করল। এমন একটি সময়ে জন্ম নিল সমাজতান্ত্রিক মতবাদ।

সবকিছুর বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর ধারাবাহিকতায় জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) উদ্ভাবন করলেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা Dialectical materialism, এবং ১০ বছর ধরে লিখলেন পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক যুগান্তকারী বই ডাস ক্যাপিটাল। ওদিকে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস দিলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা। এই দুইজনে যৌথভাবে লিখলেন কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টো (১৮৪৮)। বাজল পুঁজিবাদের বিদায়ঘণ্টা। তাঁরা বললেন, মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শাসক আর শোষিত। বললেন মানুষের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। তাদের প্রচারিত সমাজতন্ত্র লেনিনের নেতৃত্বে তিন মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম একটি বৃহত্তম সাম্রাজ্য রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে দিল। বিশ্বের বড় একটি অংশের মানুষ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করলো। ইউরোপের মানুষের অন্য একটা অংশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যান্য দিকের ব্যর্থতা দেখে সেটা বাদ দিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলো। অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র, ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এগুলো সবই অন্ধকারে হাতড়ানো, এক ব্যবস্থার ব্যর্থতায় অন্য নতুন আরেকটি ব্যবস্থা তৈরী করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রকৃতপক্ষে সমষ্টিগত জীবনের ধর্মহীনতা অবলম্বন করার পর থেকে যত তন্ত্র (-পৎধপু), যত বাদই (-রংস) চালু করার চেষ্টা ইউরোপের মানুষ করেছে সবগুলির সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে রয়েছে। অর্থাৎ রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, এসবগুলিই মানুষের সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন ধাপ, বিভিন্ন পর্যায় (চযধংব, ংঃবঢ়) মাত্র। এই সবগুলি তন্ত্র বা বাদের সমষ্টিই হচ্ছে এই ইহুদী-খ্রিষ্টান সভ্যতা, দাজ্জাল।

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ইমেইল: mdriayulhsn@gmail.com; ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...