হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব ও বর্তমানের ওয়াজ মাহফিল

মুস্তাফিজ শিহাব

ওয়াজ মাহফিলের ধারণা আমাদের দেশে নতুন নয়। এর ইতিহাস বেশ প্রাচীন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলের নামে যেগুলো চলছে সেগুলোকে ওয়াজ-মাহফিল না বলে ‘মেলা’ বা ‘সার্কাস’ বলাটাই উত্তম। ওয়াজ মাহফিলের নামে উদ্ভট আচার-আচরণ, মোটা অংকের অর্থ পারিশ্রমিক হিসেবে লাভ, জনমনে বিনোদন যোগানো ইত্যাদিই যেন ওয়াজের মূল বিষয়বস্তু। এ যেন এক লৌকিকতার মহরা। জনসাধারণকে ধর্মীয় জ্ঞান প্রদান ও তাদের দেশ ও জাতির কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করার যে লক্ষ্য ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে পূর্বে দেখা যেত সেগুলো এখন আর নেই বললেই চলে।
ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুযায়ী ওয়াজ মাহফিল মূলত মোঘল আমলে প্রচার ও প্রসার পায়। এর পূর্বে মূলত ইরানে বা তৎকালীন পারস্যে ওয়াজ মাহফিল বা ইসলামিক জলসা চলত। সেখান থেকে মোঘলদের মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিল ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। মোঘল সা¤্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে তা সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে ছড়ানোর সাথে সাথে বাংলায়ও চলে আসে।
যদিও মোঘলদের থেকে বিষয়টির উৎপত্তি তবুও পূর্বের ওয়াজ-মাহফিলগুলোর থেকে বর্তমানের ওয়াজ-মাহফিলগুলোর পার্থক্য স্পষ্ট। পূর্বে ওয়াজ মাহফিলগুলোতে দেখা যেত বক্তা দূর থেকে এসে বক্তব্য দিচ্ছেন কিন্তু এর কোনো বিনিময় নিচ্ছেন না। এছাড়াও বক্তব্য দেয়ার নামে জনমনে হুজুগ তৈরি, নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া, ধর্মকে রাজনীতিক স্বার্থে ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয় তখন ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমানের ওয়াজ-মাহফিলগুলো হয়ে গিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বক্তা বক্তব্যই দেন অর্থ উপার্জনের অভিপ্রায় নিয়ে। কে কত সুরেলা কণ্ঠে ওয়াজ করল, কে কত উদ্ভট আচরণ করে লোকজন ধরে রাখতে পারল ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দরদামে বক্তাকে ‘উচ্চমূল্যে’ ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়। ওয়াজের নামে দিন নেই রাত নেই চলে নানা রং ও ঢং এর আজগুবি আচার অনুষ্ঠান যা ইসলামের অংশ হিসেবে কোনো কালেই প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
ওয়াজের নামে বর্তমানে যা কিছু করা হচ্ছে সেগুলো সবই ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম তথা অবৈধ। ওয়াজ করার নামে ওয়াজের অনুষ্ঠানে সুরেলা কণ্ঠে, আজগুবি গল্প বলে লোক জমানোর চেষ্টা করা হয়। লোকজন এই আজগুবি কীর্তিকলাপ দেখতে যায় ঠিকই কিন্তু সেখান থেকে তারা প্রকৃত ইসলামের কোনো জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এর ফলে ওয়াজ মাহফিলের মৌলিকত্ব আজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। অপরদিকে তাদের এই সকল বাচনভঙ্গি তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মিশকাত শরীফের ৪১০ নম্বর হাদিসে বলা হয়েছে, “যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে তা ব্যাবহার করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদত কবুল করবেন না।”
যারা টাকা নির্দিষ্ট করে, অর্থের বিনিময়ে ওয়াজ করতে আসে তাদেরকে দিয়েও ওয়াজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ ধর্মীয় কাজের বিনিময় গ্রহণকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। ওয়াজ হবে মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখানোর জন্য, মানুষের কল্যাণে, দেশ ও জাতির কল্যাণে, আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে। সেই ওয়াজে যিনি বক্তব্য দিবেন তাকেও হতে হবে নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমিক, সত্যনিষ্ঠ। কিন্তু বর্তমানে যারা ওয়াজ করে তারা অধিকাংশই মোটা অংকের টাকা না হলে ওয়াজ করতে আসে না। এতেই বুঝা যায় তারা কোন শ্রেণীর আলেম। তারা যে হাক্কানী আলেম নন বরং ধর্মব্যবসায়ী তা পষ্ট হয়। আল্লাহ এ সকল ধর্মব্যবসায়ীদের অনুসরণ করতে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের থেকে বিনিময় আশা করেন না (সুরা ইয়াসিন ২১)।” নবী রসুলগণ কখনো দীন প্রতিষ্ঠা করে পারিশ্রমিক আদায় করেননি। “হে জাতি! আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাচ্ছি না। আমার বিনিময় আমাকে আমার আল্লাহই দেবেন (সুরা হুদ ৫১)।” “বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না আর আমি লৌকিকতাকারীও নই (সুরা সোয়াদ ৮৬)।” “বলেদিন, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এটি সারা বিশ্বের জন্য উপদেশ মাত্র (সুরা আনআম ৯০)।”
অনেক সময় ওয়াজ মাহফিলগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত খরচ করা হয় যা অপচয়ের পর্যায়ে পড়ে। এই অপচয় করা থেকেও আমাদের বিরত থাকতে হবে কারণ অপচয়কারী শয়তানের ভাই এবং যিনি অপচয় করেন আল্লাহ তাকে পছন্দ করেন না (সুরা বনি ইসরাইল ২৭)।
অতএব বর্তমানে ওয়াজ করার নামে যাদের ভাড়া করে আনা হচ্ছে তাদের আনা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত। তাদের বদলে যারা ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করছেন তাদের উচিত হাক্কানী আলেমদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা। কারণ হাক্কানী আলেমরা জানেন কোর’আনে বহু আয়াতে মহান আল্লাহ দীনের সকল প্রকার বিনিময়কে হারাম ঘোষণা করেছেন। ওয়াজ মাহফিলের বিষয়গুলোর দিকেও নজর দিতে হবে। ধর্মব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে যদি হাক্কানী আলেমদের দিয়ে ওয়াজ করানো নির্দিষ্ট করা যায় তবে তারা অবশ্যই এমন বিষয়ই চয়ন করবেন যাতে দীন, দেশ ও জাতির মঙ্গল হয়।
রসুলের সময় এ ধরনের ঘটা করে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে, স্টেজ সাজিয়ে ওয়াজ মাহফিল না হলেও রসুল আলোচনা করতেন। রসুলের সামনে বসে নারী-পুরুষ সকলে নির্বিশেষে আলোচনা শুনত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত। রসুলের সেই আলোচনায় দীনের বিষয় ছিল, দুনিয়ার কল্যাণে কী কী করণীয় সে বিষয় ছিল, পরকালে উন্নতীর পথ ছিল। রসুলের আলোচনায় উপস্থিতগণ দেশ ও জাতির জন্য নিজেদের কোরবান করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। তারা মানুষের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে, ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন।
অতএব যদি প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলগুলোকে সংস্কার করা যায় এবং সেগুলোকে ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার করা যায় তবে উত্তম, অন্যথায় ওয়াজ মাহফিল হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। ধর্মব্যবসায়ীদের করা এ সকল ওয়াজ মাহফিলে দীন, দেশ ও জাতির উপকারের বদলে অপকারই বেশি হচ্ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলের বেশ গুরুত্ব রয়েছে তাই ওয়াজ মাহফিলগুলো যদি সঠিক উপায়ে না হয় তবে তা আমাদের জন্য ঘোর অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই জনগণের উচিত এ বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং সরকারের উচিত জনগণকে নিয়ে এই সকল বিষয়গুলোকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook/glasnikmira13)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...