হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

এ বিপর্যয়ের শেষ কোথায়?

মোহাম্মদ আসাদ আলী
পৃথিবীময় খ–বিখ- আকারে ছড়িয়ে থাকা ১৬০ কোটির মুসলিম জাতিটির অবস্থা হয়েছে ফুটবলের মতো, যে যেখানে পারছে এই জাতির সদস্যদের উপর আঘাত করে যাচ্ছে। তাদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে, হত্যা-ধর্ষণ করছে, বাড়িভিটে থেকে উচ্ছেদ করছে, দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। ছোট ছোট শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। আবার শুধু যে বাইরের শত্রু দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে তাও কিন্তু নয়, নিজেরা নিজেরাও হানাহানি-রক্তারক্তি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো এই জাতিটিকে কেউ টেনে নিতে চাইছে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে, আর এরাও আগ-পাছ না ভেবেই অন্ধের মত মৃত্যুখাদের কিনারে পৌঁছে যাচ্ছে।
একটা সময় পৃথিবীময় ইহুদিরা মার খেয়ে বেড়াত। যেখানে যেত অপমান আর নিগ্রহ তাদের পেছনে পেছনে যেত। গোলামির জীবনই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ তাদেরকে আল্লাহর নবী ঈসা (সা.) ও দাউদ (আ.) লানত দিয়েছিলেন। আজ আমাদের করুণ বাস্তবতা এই যে, আমাদের পরাজয়, গোলামি, অপমান আর নিগ্রহের বেদনাদায়ক ইতিহাস ঐ ইহুদিদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে। শুধু পার্থক্য এই যে, তারা মার খেয়েছে বিশেষত ইউরোপে আর এই জাতি মার খাচ্ছে সারা দুনিয়ায়।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা হাজার বছর ধরে দেশটিতে বসবাস করে আসলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে বিদেশি আখ্যা দিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, আর একাজে ধর্ষণকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নারী-শিশুকে ঘরে তালাবদ্ধ রেখে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষদেরকে গুলি করে ও জবাই দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের না আছে থাকার জায়গা, না আছে পালানোর জায়গা। কিন্তু পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান তাদের সাহায্যার্থে কিছুই করতে পারল না।
কম্যুনিস্ট বিপ্লব হবার পর থেকে চীনে মুসলমানরা মার খাচ্ছে। রোজা রাখা, আজান দেওয়ার অধিকারটুকুও তাদের নেই। বিগত রমজানে রোজা রাখার অপরাধে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে ১০০ মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যা, নির্যাতন, জেল, ফাঁসি তো রোজকার ঘটনা।
আফগানিস্তান গত কয়েক দশক ধরে যুদ্ধের দাবানলে জ্বলছে। যুদ্ধ, রক্তপাতটাই সেখানকার স্বাভাবিক চিত্র। লাখো মুসলমানের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে একবার দেশটি কম্যুনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে যায়, পরোক্ষণেই জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, আবার আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে যায়। সর্বক্ষেত্রেই প্রাণ হারায় মুসলমান, ধ্বংস হয় মুসলমানের দেশ।
সত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিনের মাটিতে ফিলিস্তিনীদেরকেই নিধন করছে ইহুদিবাদী ইজরাইল। বেছে বেছে মুসলিম শিশুদেরকে গুলি করে মারা হচ্ছে। শক্তিধর ইজরাইলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে ফিলিস্তিনিরা এখন নিশ্চিহ্ন হবার পথে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচাইতে বড় গণহত্যাটি হয়েছে যেখানে সেটা হচ্ছে বসনিয়া। বসনিয়ায় খ্রিস্টান সার্বরা যা করেছে তার নজীর মানুষের ইতিহাসে নেই। সার্বরা ৭০ হাজার মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেছে, তাদের সাত মাস পর্যন্ত আটকে রেখেছে যাতে তারা খ্রিস্টানদের ঔরসজাত সন্তানগুলো গর্ভপাত করে ফেলে দিতে না পারে।
একইভাবে চেচনিয়ায় মুসলিমদেরকে গুলি করে, ধারাল অস্ত্র দিয়ে, ট্যাঙ্ক দিয়ে পিষে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যেয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে নয়ত বেশ্যালয়ে বিক্রি করা হয়েছে।
এদিকে ৭০ বছর ধরে উত্তাল কাশ্মীর। আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে কাশ্মীরীরা যেন দাবার ঘুঁটি। সেই ঘুঁটি যেদিকেই চালা হোক কাশ্মীরী মুসলমানদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সেখানে এমন পরিবার কমই আছে যাদের কেউ না কেউ অন্যায়ভাবে প্রাণ হারায় নি।
ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন উপনিবেশিক শক্তি আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশ দখল করে নির্যাতন-নিপীড়ন-খুন-ধর্ষণ ও সেই সাথে অবাধ শোষণ আর লুটতরাজ চালিয়ে দেশগুলোকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আফ্রিকানদের স্বর্ণ ও হীরার ক্ষণি এখন ইউরোপকে সমৃদ্ধ করছে, আর আফ্রিকান কঙ্কালসার মানুষগুলো না খেয়ে মারা যাচ্ছে।
লিবিয়াকে বলা হতো আফ্রিকার ত্রাতা। কথিত আরব বসন্তের কাঁধে সওয়ার হয়ে পশ্চিমারা সেই লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে এখন মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে ছেড়েছে। আকাশ থেকে বিমান হামলা করে খুব সহজেই মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দিয়েছে এবং দেশটির তেলের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা মরল কি বাঁচল, খেতে পেল কি অভুক্ত রইল সেদিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। এখন যখন সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া থেকে মুসলমান পরিবারগুলো জীবন বাজি রেখে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছে, কিংবা আমেরিকার ভিসা খুঁজছে, তখন ইউরোপীয়রা রে রে করে তেড়ে আসছে, আর আমেরিকার মুসলিমবিদ্বেষী প্রেসিডেন্ট নির্দেশ জারি করছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মুসলমানদের অধিকার নেই আমেরিকার মাটিতে পদস্পর্শ করার। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে পানিতে ডুবেই প্রাণ হারিয়েছে দশ হাজার মুসলিম শরণার্থী। ইহুদীদেরও আল্লাহ এমন শাস্তি দেন নাই। এই যদি লানত না হয় তবে লানত কাকে বলে?
এই জাতি যে আল্লাহর অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে তার একটি বড় প্রমাণ হচ্ছে বিশ্বময় অন্যান্য জাতিগুলো যখন আদাজল খেয়ে নেমেছে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তখন এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হবার বদলে নিজেদের মধ্যে বিভেদের নালাকেই প্রসারিত করে সাগরে পরিণত করছে এবং তার দ্বারা ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের কাজটাকে পানির মত সহজ করে দিচ্ছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নিরা জোট করেছে, আর ইরানের নেতৃত্বে শিয়ারা। এই সুন্নিরা শিয়াদেরকে যতটা ঘৃণা করে ততটা পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকেও করে না, একইরকম ঘৃণা শিয়ারাও লালন করে সুন্নিদের প্রতি। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো। তারা কেউ ‘শিয়াজুজু’র ভয় দেখিয়ে সুন্নি জোটের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, আর কেউ ‘সুন্নিজুজু’র ভয় দেখিয়ে শিয়াদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। গোপনে গোপনে উভয়পক্ষকেই কুমন্ত্রণা দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লাগিয়ে রাখছে, উভয়পক্ষের কাছেই অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং অস্ত্রব্যবসা করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। আর এই উম্মাহ বলির পাঁঠা হয়ে প্রভু সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা ধ্বংস হচ্ছে। আজকে তাদের শিয়া-সুন্নি বিরোধের খেসারত দিতে হচ্ছে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনের লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে বোমায় ল-ভ- হয়ে, ঘরবাড়ি হারিয়ে, অভুক্ত-অনাহারী থেকে। সিরিয়ায় গত ছয় বছরে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে যাদের সবাই মুসলিম, আর উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি হবে, অন্তত এক কোটি। ইরাকে চলছে মরার উপর খারার ঘা। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়েমেন সবচাইতে বড় দুর্ভিক্ষের মুখোমুখী হতে চলেছে কেবলই শিয়া-সুন্নি বিরোধ ও সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে। এই নেতারা কী জবাব দিবেন আল্লাহর কাছে তা একমাত্র তারাই জানেন। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মুসলিমের প্রাণ ঝরে যাওয়ার পেছনে নিজেদের দায় একজনও অস্বীকার করতে পারবেন না।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়া দেশটির উপর কী নির্যাতনটাই না চলছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, আঞ্চলিক শক্তিগুলো, এছাড়াও ছোট ছোট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সবাই সিরিয়ায় নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে মেতে আছে এবং তা করতে গিয়ে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের প্রাণ গেছে। কিন্তু এখন দেখি সিরিয়া কারো নয়, ঐ আসাদ সরকারেরও নয় ঐ বিদ্রোহীদেরও নয়, ঐ শিয়ারও নয় ঐ সুন্নিরও নয়, সিরিয়া এখন রাশিয়া আর আমেরিকার। সিরিয়া ভাগ হয়ে টুকরো টুকরো হবে নাকি অখ- থাকবে, যুদ্ধ বন্ধ হবে নাকি পরাশক্তিগুলোর ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা করবার স্থান হবে সেই সিদ্ধান্তও নেবার ক্ষমতা ঐ রাশিয়া আর আমেরিকার হাতে। তাহলে শিয়া-সুন্নি বিরোধ জাতিকে কী দিল? দিল সেই পরাজয়, অপমান, লাঞ্ছনা আর গোলামী যেটা তারা পৃথিবীময় কয়েক শতাব্দী ধরে ভোগ করে আসছে। একই অবস্থা লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য যুদ্ধবিধ্বস্ত মুসলিম দেশগুলোর। জাতির যে অংশটি এখনও এই বিভীষিকার বাইরে আছে এবং পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে নিজ জাতির দুর্বিসহ জীবনের চিত্র দেখেও নির্বিকারভাবে খাচ্ছে দাচ্ছে, বংশবিস্তার করছে, চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছে, আর ভাবছে এ সমস্যা তাদের নয়, তাদের এই আত্মতৃপ্তির বেলুনও একদিন ফুটো হবে। ইতোমধ্যেই প্রত্যেকটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করলে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে বোঝানো হচ্ছে ইসলামের প্রতি আঘাত হিসেবে। দেশে দেশে দানা বাঁধছে গণঅসন্তোষ। সরকার ও জনগণ দুই মেরুতে সরে যাচ্ছে। অস্থিতিশীলতা সর্বত্র। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের বলয়ে ইচ্ছে না থাকলেও জড়িয়ে পড়ছে সকল মুসলিমপ্রধান দেশ। আর সা¤্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ীরা তো বসেই আছে মুসলমানদের অন্যৈকের নালাকে সাগর বানিয়ে সেই সাগরে জাতিটিকে ডুবিয়ে মারতে। মনে রাখতে হবে, সিরিয়ার মুসলমানরাও একদিন ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের খবর পড়ে নির্বিকার থাকত, আজ তাদের শিশু সন্তানরা ‘শবযাত্রা শবযাত্রা’ খেলা করে। এই করুণ বাস্তবতা আজও যদি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে কবে উপলব্ধি করব? এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে আমাদের ভবিষ্যৎকে চালিত করব।
আমরা কি এভাবেই সমূলে বিনাশ হয়ে যাব নাকি পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...