হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আইয়ুব আনসারী (রা.) এর বাসভবনে রসুলাল্লাহর ভাষণ

আদিবা ইসলাম
আইয়ুব আনসারী (রা.) এর বাসভবনে রসুলাল্লাহর ভাষণ। তারা যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে এলেন তখন তাদের অনেকেই নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন ছিলেন। শুধু আল্লাহর রসুলের আহ্বান পেয়েই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তারা পা বাড়ান। মদীনায় এসে তাদেরকে যথারীতি মদীনাবাসীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। এমতাবস্থায় মদীনাবাসীর আন্তরিক সাহায্য-সহযোগিতা তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন আল্লাহর রসুল তাঁর ভাষণে স্বচ্ছল মো’মেনদেরকে উৎসাহ দিতে থাকেন যেন তারা দরিদ্র ভাইদের পাশে দাঁড়ান।
আল্লাহর রসুল জানতেন সদ্য তওহীদ গ্রহণকারী গোত্রগুলো কিছুদিন পূর্বেও নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-সংঘাতে ডুবে ছিল। নিজ গোত্রের স্বার্থে অন্য গোত্রে হামলা, হত্যা, লুট, মারামারি, কাটাকাটি ছিল ঐ সময়ের স্বাভাবিক ঘটনা। এরকম একটি পরিবেশে রসুলাল্লাহ যখন জাতি, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলকে এক তওহীদের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করলেন তখন স্বভাবতই রসুলাল্লাহর সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়াল বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিরাজমান পূর্বশত্রæতা ও বিদ্বেষ দূর করে সবার মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির চেতনা জাগ্রত করা। ফলে আল্লাহর রসুল সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে এমন কিছু হৃদস্পর্ষী বক্তব্য উপস্থাপন করলেন যাতে করে শত্রুও ভাই হয়ে যায়, একজনের দুঃখ সবাইকে সমানভাবে ব্যথীত করে তোলে। এই চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে আল্লাহর রসুল আইয়ুব আনসারী (রা.) এর বাসভবনে যে ভাষণ দান করেন তা নিচে তুলে ধরা হলো-‘হে মানুষ! তোমাদের রব বলেন: নিজের সম্পদ নেক কাজে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না। অর্থাৎ দান-খয়রাত করে অন্যের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয়েছে এ কথা বলে দান বরবাদ কর না। মনে রেখো, যে মঙ্গলজনক কাজ তুমি করবে আল্লাহ তা জানেন। যে তার বিষয়-সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তার জন্য তার রবের কাছে মহান প্রতিদান রয়েছে। সে নেকী থেকে বঞ্চিত হবে না। তার জন্য কোন ভয়-ভীতি নেই এবং সে চিন্তিতও হবে না।
হে উপস্থিত জনমণ্ডলী! তোমরা কি মনে কর আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী? কখনও নয়। তিনি অভাবহীন এবং বে-নেয়ায । তোমরা যা উপার্জন কর তা তোমাদের ফায়দার জন্য। যে নিজের মাল অপরকে দেখানোর জন্য ব্যয় করে সে হতভাগ্য। সে কেয়ামতের দিনের উপর বিশ্বাসী নয়। আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, দানশীল এবং ত্যাগী মানুষ হক সুবানাহুতা’আলার নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী ও জাহান্নাম থেকে দূরে অবস্থান করছে। স্বার্থপর ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং জাহান্নামের নিকটবর্তী।
হে উপস্থিত জনতা! আমি যা জানি এবং দেখি, তোমরা তা দেখো না এবং জানো না। মনে রেখো, প্রত্যেকদিন ভোরবেলা দু’জন মালায়েক নাযিল হন। একজন বলেন, হে আল্লাহ! দানশীল এবং ত্যাগী মানুষের সম্পদে বরকত দান কর ও অপরজন বলেন, হে মহাপবিত্র আল্লাহ! স্বার্থপর এবং বখিলের সম্পত্তি বিনষ্ট কর। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, মানুষের জীবনের আমল এবং কর্তব্য-কাজের মধ্যে ত্যাগ ও সৎপথে ব্যয় উত্তম আমল। যে সত্ত¡ার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর নামে শপথ করছি যে, ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আমার কাছে থাকলেও তা তিন রাতের মধ্যে খরচ হয়ে গেলে আমি খুব খুশি হব এবং চাইব যে আমার হাতে কিছুই যেন অবশিষ্ট না থাকে। আমি জানি, ধন সম্পত্তি ব্যয় করা মানুষের জন্য লাভজনক এবং সঞ্চিত করে রাখা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু প্রয়োজনবোধে সঞ্চিত করে রাখা নিন্দনীয় নয়। আল্লাহর রাস্তায় তাদের জন্য প্রথম ব্যয় করা শুরু কর যাদের ভরণপোষণ তোমাদের কর্তব্য। আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যে অর্থ-সম্পদ ব্যয় কর তা কখনও বৃথা যায় না বরং তা তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে, যদিও তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না। দুনিয়ার ফায়দা ব্যতীত আখেরাতের সওয়াবও তাতে রয়েছে।
হে মানুষ! এ দুনিয়া পরীক্ষা ক্ষেত্র এবং কর্মস্থলও বটে। তোমরা যেরূপ কাজ করবে সেরূপ ফল লাভ করবে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের জন্য ইজ্জত ও শান্তি। যাদের আনুগত্যের মস্তক আল্লাহর হুযুরে অবনত, যাদের জীবনের অধিকাংশ সময় আল্লাহর এবাদতে নিয়োজিত এবং যারা নিজের প্রয়োজনের চেয়ে মো’মেন ভাইদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দান করে, তাদের মত নেক লোককে মহাপবিত্র আল্লাহ কঠিন অবস্থা ও ব্যর্থতার মধ্যেও খুশি ও আনন্দিত রাখেন। ধ্বংস ও দুর্যোগের মধ্যেও চিন্তিত ও নিরাশ হতে দেন না। যে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক, সে আসমানী বরকত থেকে বঞ্চিত। তার সুনিশ্চিত হওয়া দরকার যে তার ঈমান অসম্পূর্ণ এবং সে অনন্ত সৌভাগ্যের অধিকারী নয়।
হে উপস্থিত জনতা! যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিজের মাল খরচ করে বা নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে, সে কোন অবস্থাতেই লোকসানের মধ্যে থাকে না। সে প্রেমিকের স্থান হাসিল করে এবং তার মর্যাদা উন্নীত হয়। কেননা আল্লাহর মহব্বতে নিজেকে বিলীন করে দেয়া বা তাঁর কলেমাকে (সার্বভৌমত্ব) সমুন্নত করার জন্য নিজের প্রাণকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দেয়া সবচেয়ে উত্তম কাজ। এসব কিছু কঠিন কাজ নয়। দুনিয়াতে এমন লোক রয়েছে যারা প্রমাণ করেছে, মানুষ হিম্মত করলে কি না করতে পারে! আত্মত্যাগ ও করবানী করার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এ কষ্টের মধ্যে আরাম নিহিত। বিপদে পতিত হলে বা যে কোন রকম দুর্যোগের সম্মুখীন হলে মো’মেনদের ধৈর্য ধারণ করা উচিৎ। এটাও ত্যাগ। অতীতের সকল উম্মতকেই পরীক্ষা করা হয়েছে। আল্লাহর কানুন হল, তিনি মো’মেনদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন। কখনও ভয়ভীতি, কখনও উপবাস, কখনও মালের লোকসান, কখনও বা প্রাণের ক্ষতির দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন। যখন বান্দা এসব পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয় তখন তার মর্যাদা উন্নীত হয়। এটা সম্পূর্ণ সত্য যে, পরীক্ষায় তারাই কৃতকার্য হয় যারা ত্যাগী এবং তারাই ব্যর্থ হয় যারা স্বার্থবাদী এবং আল্লাহ তাদের জন্য আযাব তৈরি করে রেখেছেন। মুসাফিরদের সাহায্য করা, মিসকীন, এতিম ও অক্ষমদের সাহায্য করা এবং প্রয়োজনে প্রতিবেশীদের সাহায্য করাও আত্মত্যাগ ও সৎকার্য্যে ব্যয়ের অন্তর্গত।
হে মো’মেনগণ! আমি তোমাদেরকে হেদায়াত করছি যে, তোমরা ত্যাগের মনোভাব অর্জন কর এবং স্বার্থপরতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখো। স্বার্থপরতা পূর্ববর্তী কওমদের বরবাদ করেছে। একথা স্মরণ রাখো যে, ঈমান ও আত্মত্যাগ এ কওমের সর্বপ্রথম মঙ্গল এবং স্বার্থপরতা ও দয়াহীনতা সর্বপ্রথম অমঙ্গল।
[ভাষণটি ‘বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এর ভাষণ’ বই থেকে সংগৃহীত]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...