হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আইএস এর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস কি ইসলাম সমর্থিত?

রিয়াদুল হাসান:
খবরে প্রকাশ- ইরাকের ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্যগুলো একের পর এক গুড়িয়ে দিচ্ছে ইরাক ও সিরিয়ায় কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিদার আইএস জঙ্গিরা। ইরাকের ঐতিহ্যবাহী শহর মসুল, নিমরুদসহ আইএস এর দখলকৃত এলাকাগুলোয় অবস্থিত শত শত ভাস্কর্য বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আইএস জঙ্গিদের এ ধ্বংসযজ্ঞকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থী মিডিয়াগুলো। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনস্কো ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করে বিবৃতি দিয়েছে। এমতাবস্থায় অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখলে এ সিদ্ধান্তে আসা কঠিন হয় না যে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের এই ধ্বংসযজ্ঞকে পরোক্ষভাবে মুসলিম বিশ্বাস ও ভাস্কর্যনীতিরই প্রতিফলন হিসেবে প্রচার করা হবে। ফলে বিশ্বজুড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যে প্রগতিবিরোধী তকমা এঁটে দেওয়া হয়েছে সেটা আরও শক্তপোক্ত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রকৃতপক্ষেই কি ইসলামে ভাস্কর্য নির্মাণ অবৈধ? যারা ইসলামের দোহাই দিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করেন তারা আসলে প্রতিমা ও ভাস্কর্যের পার্থক্য খতিয়ে দেখেন না। এ বিষয়ে আসুন বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক।
আমাদের সমাজে একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা আছে যে, মূর্তি বানানো ইসলামের দৃষ্টিতে না-জায়েজ। আল্লাহ রসুল যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তারা অধিকাংশই ছিল মূর্তিপূজারী। বর্তমানে সারা দুনিয়াতে যে বিকৃত ইসলামটি প্রতিষ্ঠিত আছে তার আলেম ওলামারাও একচেটিয়াভাবে মূর্তি, ভাস্কর্য নির্মাণের ঘোর বিরোধী। তাদের কেউ কেউ এতটাই চরমপন্থী যে ছবি তোলাকেও হারাম বলে ফতোয়া দেন। স্বভাবতই তারা মানুষের বা প্রাণীর ছবি অঙ্কনেরও বিরোধিতা করেন পাছে কেউ আবার সেগুলির পূজা না শুরু করে দেয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নিয়ে একটি বড় ঘটনাও ঘটে। ভাস্কর্য নির্মাণের আগেই ০৬ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখে ভাস্কর্য নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখিত বিবৃতি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ জন শিক্ষক। তারা বলেন, “ইসলামের মহান সাধক হযরত শাহজালাল (র:) এর নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মূর্তি স্থাপনের চেষ্টা শাহজালাল (র:) তথা গোটা বৃহত্তর সিলেটবাসীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার শামিল।”
এতে বোঝা যায় ধর্মান্ধ শ্রেণি নয় কেবল, উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অনেকের মধ্যেও এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল যে মূর্তি নির্মাণ ইসলাম বিরোধী কাজ। বাস্তবেও তাই ঘটে, ভাস্কর্যটি নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই একটি ধর্মান্ধ শ্রেণি সেখানে হামলা চালায় এবং নামফলক ভেঙে ফেলে। এমন ঘটনা আরও বহু ঘটেছে। আফগানিস্তানে তালেবানরা মহামতি বুদ্ধের বিশাল মূর্তিগুলি গুড়িয়ে দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ইসলাম যুক্তিময়। যুক্তিহীন কোন নির্দেশ আল্লাহ বা রসুল দেন নি, দিতেও পারেন না। তাই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, ছবি অঙ্কন ইত্যাদিকে আল্লাহ কেন নিষেধ করেছেন? যুক্তিটা কি?
আল্লাহ তাঁর দীন মানবজাতির প্রতি নাযেল করেছেন একটি মাত্র কারণে, আর তা হলো- মানবজাতি যেন অন্যায় অবিচার থেকে বেঁচে একটি শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল সমাজে জীবনযাপন করতে পারে। তাই এই দীনের প্রতিটি আদেশ মানুষের সুখের জন্য এবং প্রতিটি নিষেধ মানুষকে ক্ষতি থেকে, অশান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য। এমন কোন আদেশ বা নিষেধ ইসলামে থাকা সম্ভব নয়, যেটার সঙ্গে মানুষের ভালো মন্দের কোন সম্পর্ক নেই। যে জিনিষ বা যে কাজ মানুষের জন্য অপকারী তাই আল্লাহ নিষেধ করেছেন। এই আলোকে আমাদের জানা দরকার, চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর কি না। কোন জিনিস ভালো কি মন্দ তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই জিনিসের ব্যবহারের ওপর। একটা অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি বা খুন করা যায়, সেই অস্ত্র দিয়েই আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা যায়, খুনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে অসহায়কে রক্ষা করা যায়। অস্ত্র নিজে দায়ী নয়, যে সেটাকে ব্যবহার করবে দায়ী সে। রেডিও টেলিভিশন মানুষকে ভালো অনেক কিছু শিক্ষা দেবার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা, সহিংসতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অপরাধ, নগ্ন যৌনতা ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে তাকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এজন্য কি রেডিও টেলিভিশন খারাপ জিনিস। না, খারাপ হচ্ছে এগুলির অপব্যবহার।
ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়, নিষিদ্ধ প্রতিমাপূজা
আল্লাহ বলেন, অবশ্যই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা এবং লটারি অপবিত্র ও শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা তা থেকে দূরে থাকবে, যাতে সফলকাম হতে পার (সুরা আল মায়িদাহ : ৯০)। এই আয়াতে আল্লাহ মূর্তিপূজা নিষেধ করেছেন, পূজা ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে মূর্তির ব্যবহার নিষেধ করেন নি। মূর্তিকে উপাস্য হিসাবে বিশ্বাস করাও শেরক, অর্থাৎ অংশীবাদ। মহানবী মক্কা বিজয়ের দিন পবিত্র কাবাঘরে যে মূর্তিগুলো ভেঙ্গেছিলেন সেগুলি কী ছিলো? সেগুলি ছিলো লাত, মানাত, উজ্জা, হোবল ইত্যাদির মূর্তি। এই মূর্তিগুলিকে তারা দেবতার আসনে বসিয়েছিল এবং এই বিশ্বাস স্থাপন করেছিল যে, এই মূর্তিগুলি তাদেরকে স্রষ্টার সান্নিধ্য এনে দেবে, স্রষ্টার কাছে সুপারিশ করবে এবং ভাগ্য বদলে দেবে (সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার- ৩)। কোনোটা ধন-দৌলত এনে দেবে, কোনোটা যুদ্ধে জয়লাভ করাবে, কোনোটা সন্তান লাভ বা বিবাহের পথ সুগম করবে ইত্যাদি। আরবের গোত্রগুলি পরিচালিত হতো এই মূর্তিগুলির পুরোহিতদের সিদ্ধান্ত বা ফতোয়া দ্বারা। পুরোহিতদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ধর্মের বিধান বলেই স্বীকৃত হতো। এই মূর্তিগুলিকে কেন্দ্র করে তাদের নিজস্ব আইন কনুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রয়োগ করত। অর্থাৎ এক কথায় ঐ মূর্তিগুলিকে তারা বিধাতার আসনে এবং সমাজ পরিচালক বা এলাহের আসনে বসিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ মানুষের ভাগ্য (কদর), রেযেকের সব ব্যবস্থা করেন। মানুষ কিভাবে চলবে সেজন্য তিনি বিধান দিয়েছেন, সুতরাং তিনিই বিধাতা এবং তাঁর (আল্লাহর) হুকুমেই বনি আদম পৃথিবীতে খেলাফত করবে অর্থাৎ এলাহ বা হুকুমদাতাও তিনি। উপাসনা, পূজা, প্রশংসা বা এবাদত পাওয়ার একমাত্র অধিকারী, হকদার আল্লাহ। কিন্তু মক্কার কাফের মোশরেকরা পবিত্র কাবা কেন্দ্রিক যে মূর্তি স্থাপন করেছে সেগুলি কার্যতঃ এলাহ, রব, সুপারিশকারী, ভাগ্যবদলকারীর আসনে বসিয়েছিল; কাজেই মহানবী (দ:) এ সমস্ত গুড়িয়ে দিয়েছেন। তবে তারা এসব মূর্তিকে আল্লাহ বা স্রষ্টা বলে মানতো না। তারা আল্লাহকেই তাদের স্রষ্টা, পালনকর্তা, প্রভু, রেযেকদাতা, জীবন-মৃত্যুদাতা বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যার ভুরি ভুরি প্রমাণ কোর’আন, হাদিস ও ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। আরবের মোশরেকরা যে আমাদের মতোই আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিলো এ কথায় সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (কোর’আন- সুরা যুখরুফ- ৯)। সেই আল্লাহর হুকুম না মানার কারণেই সেই আরবরা কাফের ও মোশরেকে পরিণত হয়েছিল।
ইসলামে বৈধ এবং অবৈধ নিরূপণ
কেবল মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ নয়, নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড ও শিল্পকলা আল্লাহ কোর’আনে কোথাও নিষেধ করেন নি। তাই গান গাওয়া, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কাজকে অবৈধ ফতোয়া দেওয়ার কোন যুক্তি নেই। একটি সরল সত্য হলো, ইসলামের বৈধ-অবৈধ নির্দ্ধারণের বেলায় মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহর আদেশ এবং নিষেধ অর্থাৎ আল-কোর’আন। রসুলাল্লাহ জানতেন যে, তাঁর বাণীকে ভবিষ্যতে বিকৃত করা হবে, অনেক বৈধ বিষয়কে অবৈধ ঘোষণার জন্য সেটিকে তাঁর উক্তি বলে চালিয়ে দেওয়া হবে, তাই তিনি বলে গেছেন, আমি তোমাদের জন্য সেটাই হালাল করেছি যেটা আল্লাহ হালাল করেছেন, সেটাই হারাম করেছি যেটা আল্লাহ হারাম করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার কোন কথা কোর’আনের বিধানকে রদ করবে না, তবে কোর’আনের বিধান আমার কথাকে রদ করবে (হাদিস)। সুতরাং যে কোন জিনিস হারাম কিনা তা জানার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কেতাব দেখতে হবে। কোর’আনে যা কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি ছাড়া আর সবই বৈধ। এখন কোর’আন খুলে দেখুন গান, বাদ্যযন্ত্র, কবিতা, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাষ্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন কিনা? যদি না করে থাকেন তাহলে এগুলি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আল্লাহ যেটিকে বৈধ করেছেন, সেটিকে কোন আলেম, মুফতি, ফকীহ, মোফাসসের হারাম করার অধিকার রাখেন না।
মূর্তিপূজার প্রবণতা
অতীতকালে মানুষের মধ্যে জড় বস্তুর উপাসনা করার প্রবণতা ছিলো। তাই অতীতের নবী-রসুলগণ মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেছেন। এব্রাহীম (আ:) তাঁর কিশোর বয়সেই রাজার মন্দিরের মূর্তি ভেঙেছিলেন এ ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু সেই নবীরও মূর্তি তৈরি করেছিল কোরায়েশরা। শেষ নবী আল্লাহর ঘর ক্বাবা থেকে সমুদয় মূর্তি ধ্বংস ও অপসারণ করেন, সেই মূর্তিগুলির মধ্যে ইব্রাহীম (আ.) এর মূর্তিও ছিলো। রসুলাল্লাহ আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন শেরকের বিরুদ্ধে। সে সময়ে আরবের শেরক ছিলো মূর্তিপূজা, তাই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কোর’আনে ও হাদিসের বহু স্থানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেমন: রসুলাল্লাহ বলেন, বিচারের দিন ঐ সকল লোক সর্বাপেক্ষা কঠোর শাস্তিভোগ করবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির অনুসরণে জীবজন্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা নির্মাণ করে।” (আয়েশা রা. থেকে সহীহ বুখারী)। আবার যে গৃহে কুকুর অথবা কোনো প্রাণীর ছবি থাকে, সেখানে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেন না। (আবু তালহা রা:. থেকে বোখারী, খ.২/পৃ. ৮৮০)। রসুলাল্লাহ এই কথাগুলি বলেছেন আরবদের মধ্যে মূর্তিপূজার যে প্রবণতা ছিলো সেটাকে নির্মূল করার লক্ষ্যেই। যে মূর্তিতে বা চিত্রের সঙ্গে পূজার সম্পর্ক নেই, শেরকের সম্পর্ক নেই সেগুলি ধ্বংস করার পক্ষপাতি আল্লাহর রসুল ছিলেন না। তার প্রমাণ নিচের ঘটনাটি।
আল্লাহর রসুল মক্কা বিজয়ের দিন যখন ক্বাবায় স্থাপিত মূর্তিগুলি ভেঙ্গে ফেললেন তখন ক্বাবার দেওয়ালেও বহু ছবি অঙ্কিত ছিলো। একটি ছবি ছিলো এব্রাহীম (আ:) এর যেটিতে তিনি হাতে কতগুলি ভাগ্যগণনার তীর নিয়ে বসে আছেন। দেখে রসুলাল্লাহ বলে উঠলেন, “আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন! তারা তাঁকে দিয়ে তীরের সাহায্যে ভাগ্যনির্ণয় করাচ্ছে। এব্রাহীম (আ.) তীর নিয়ে কী করছেন?” (al-Azraqi 1858, p. 111) (Peters, Muhammad and the Religion of Islam, pp. 140-141)
ঐ দেওয়ালে আরো দু’টি ছবি অঙ্কিত ছিলো। একটি ঈসা (আ.) এর, অপরটি মা মরিয়মের। আল্লাহর রসুল ঈসা (আ.) আর মা মরিয়মের ছবি দু’টি বাদ দিয়ে সকল ছবি যমযমের পবিত্র পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলেন (The Life of Muhammad by A. Guillaume, p. 552)।
তাঁর দীর্ঘ তেইশ বছরের প্রচারে ও শিক্ষার ফল কি? অন্যতম ফল হচ্ছে, আরবের পৌত্তলিক ও মোশরেকরা যখন ইসলামের আলোয় আলোকিত হলো, তাদের হৃদয় থেকে দেবদেবীর মূর্তি, পৌত্তলিকতা, মূর্তিপূজার প্রবণতা একেবারে তিরোহিত হয়ে গেল। এমনভাবে বিলীন হলো যে কেয়ামত পর্যন্তও কোন মোসলেম দাবিদার কোন মূর্তির সামনে মস্তক অবনত করবে এমন দূরতম সম্ভাবনাও রইল না। রসুলাল্লাহ ওফাতবরণের একমাস আগে ১২ সফর ওহুদ উপত্যকায় শহীদদের কবর যেয়ারতের পর আসহাবদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমার অবর্তমানে তোমরা মূর্তিপূজারী হয়ে যাবে এ ভয় আমি কোরি না। কিন্তু আশঙ্কা কোরছি তোমরা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করবে।” বাস্তবেও দেখা গেলো ইসলাম বিকৃত হয়ে যাওয়ার পর থেকে এ যাবত পর্যন্ত মোসলেম নামক এই জনসংখ্যার ইতিহাস কেবল অন্তর্কলহ, ভ্রাতৃঘাতী, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সংঘাতে পূর্ণ। বিদায় হজ্বের ভাষণেও তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে এইসব জমিনে শয়তানকে কেউ পূজা করবে, শয়তান এই আশা চিরতরে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু যে সকল কাজকে তোমরা অতি হালকা বলে মনে করো এ রূপ কাজে তোমরা শয়তানের আনুগত্য করবে এবং এতে সে সন্তুষ্ট হবে”। (তিরমিযী, মেশকাত)। রসুলাল্লাহর এ সকল কথায় বোঝা যায় যে, মোসলেম জাতির পক্ষে আর পূজা অর্চনা, দেব-দেবীর উপাসনার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে শয়তানের আনুগত্য করা হবে অন্য পদ্ধতিতে। বর্তমানে যে পাশ্চাত্য প্রবর্তিত তন্ত্র-মন্ত্রের আনুগত্য আমরা করে যাচ্ছি সেটাই হচ্ছে সমসাময়িক কালে শয়তানের আনুগত্য, যাকে আমরা “অতি হালকা ” বলে মনে কোরি।
সাহাবারা কেন মূর্তি ধ্বংস করেন নি?
সাহাবায়ে কেরাম যখন সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়ার বুকে বেরিয়ে পড়েছেন তখন যে সমস্ত এলাকা বিজীত হয়েছিল, ঐ সমস্ত স্থানে অন্যধর্মের লোকদের উপাস্য মূর্তি, ধর্ম উপাসনালয় ধ্বংস করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যদি বিধর্মীদের কোন মূর্তির অঙ্গহানীও হয়ে থাকে, সাহাবীরা সেগুলিও মেরামত করে দিয়েছেন। ঐ সমস্ত এলাকার মূর্তিগুলি আর জাতীয় পর্যায়ে বিধাতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলো না কাজেই ঐগুলি ভাঙ্গার প্রয়োজন পড়ে নি। একদিকে ইসলামের নীতি জাতীয়ভাবে চলবে আল্লাহর হুকুম ব্যক্তিগতভাবে যে যার বিশ্বাস স্থাপন কোরুক তাতে কোনো আপত্তি নেই। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তনে কোনরূপ জোরাজুরি চলবে না। এক কথায় ইসলামের নীতি হলো- রাষ্ট্র চলবে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে, কিন্তু ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার উপর (ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে) ছেড়ে দিতে হবে। আজ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় জাতীয়ভাবে পশ্চিমা সভ্যতার তৈরি তন্ত্র মন্ত্রের মূর্তির অধীনে বসবাস করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে, এই সব তন্ত্রের মূর্তিকে চুরমার করে সত্যকে প্রতিস্থাপন করার সংগ্রাম না করে রাস্তায় নির্মিত স্থাপনার বিরুদ্ধে মিছিল, ওয়াজ-নসীহত, বিক্ষোভ ইত্যাদি কত বড় মূর্খতা, কত বড় অজ্ঞতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্যই এই বিকৃত ইসলামের আলেমদের প্রচারের ফলে সাধারণ মানুষকে বোঝান মুশকিল যে তোমরা শিরক কোরছ, কুফর কোরছ। এটা বললে তারা বলে, “কিভাবে আমরা মোশরেক, কিভাবে আমরা কাফের, আমরা কি মূর্তিপূজা করি?”
অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে মূর্তিপূজা
মূর্তিপূজার ইতিহাস অন্বেষণ করলে দেখা যায় মানব ইতিহাসের আদিলগ্নেই এর সূচনা। আল্লাহর বহু নবীকে এই মূতিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। কোন ধর্মই মূর্তিপূজার বৈধতা দেয় না। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস এই যে, সেই সব নবীদের ওফাতের পর তাদের অনুসারীরা সেই নবীদেরই মূর্তি বানিয়ে তাঁর উপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করে মূর্তিপূজা আরম্ভ করে দিয়েছে। আল্লাহ মুসা (আ:)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “You shall not make for yourself a carved image, or any likeness of anything that is in heaven above, or that is in the earth beneath, or that is in the water under the earth. You shall not bow down to them or serve them, for I the Lord your God am fa jealous God. (Old Testament, Exodus 20:4-5) অর্থাৎ- তুমি তোমার জন্য কোন খোদাই করা প্রতিমূর্তি তৈরি করবে না, উপরে সেই আকাশ, নিচে এই পৃথিবীতে ও পৃথিবীর নিচে জলরাশির মধ্যে যা কিছু রোয়েছে তার সাদৃশ্যেও কোন কিছুই তৈরি করবে না। তুমি তেমন বস্তুগুলির প্রতি প্রণিপাত করবে না, সেগুলির এবাদতও করবে না, কেননা আমি তোমাদের পরমেশ্বর প্রভু, আমি এমন ঈশ্বর যিনি কোন প্রতিপক্ষকে সহ্য করেন না। বনী এসরাঈল আল্লাহর এই হুকুম বার বার অমান্য করেছে। পরে আল্লাহ আবার নবী পাঠিয়ে তাদেরকে মূর্তিপূজা থেকে ফিরিয়েছেন। তওরাতে উল্লিখিত আল্লাহর এই নির্দেশে পরিষ্কার বোঝা গেল যে, আল্লাহ ঈশ্বরত্ব আরোপ করার উদ্দেশ্যে, উপাসনা করার উদ্দেশ্যে যে কোন মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞাগুলির কারণে মানুষ ধোরে নিয়েছে যে, মূর্তি তৈরি করাই নিষিদ্ধ, ছবি আঁকাই নিষিদ্ধ। খ্রিস্টধর্মেও বলা হয়েছে, “আমরা যখন ঈশ্বরের সন্তান তখন ঈশ্বরকে মানুষের শিল্পকলা বা কল্পনা অনুসারে সোনা, রূপা বা পাথরের তৈরি কোনো মূর্তির সঙ্গে তুলনা করা আমাদের উচিৎ নয়। (অ্যাক্টস ১৭:২৯)। সেই খ্রিস্টানরাও ঈসার (আ:) ঊর্দ্ধগমনের পর তাঁকে ঈশ্বরের স্থানে বসিয়েছে এবং তাঁর মূর্তি নির্মাণ করে তার সামনে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করা এবং গলায় ক্রুশ ঝোলানোর পদ্ধতি চালু করেছে। এগুলিও প্রকারান্তরে পৌত্তলিকতা।
প্রাচীন ধর্মগুলির মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন রোয়েছে যদিও তাদের ধর্মগ্রন্থগুলিতে মূর্তিপূজা নিন্দনীয় কাজ হিসাবেই উল্লিখিত। যেমন সনাতন ধর্মের মূলগ্রন্থ বেদ প্রচলিত মূর্তিপূজাকে কখনও সমর্থন করে নি বরং বিরোধিতা করেছে। ভগবত গীতায় (৬/৩১) শ্রীকৃষ্ণ (আ:) সখা অর্জুনকে বলছেন, “সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিত” – অর্থ: যে সর্ব ভূতে অবস্থিত নারায়ণকে উপেক্ষা করে মূর্তিতে নারায়ণের অর্চনা করে, সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয়। সুতরাং প্রতিমাপূজা হিন্দু ধর্মে ছিলো না, পরবর্তীতে মানুষই এর প্রবর্তন করেছে। বেদে, মনুসংসিহতায় মূর্তিপূজার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে যজ্ঞানুষ্ঠানের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। যজ্ঞ আর মূর্তিপূজা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
সিদ্ধান্ত: উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ নয়, মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়, প্রতিমা নিষিদ্ধ। ইসলামে মানুষ, জীবজন্তু, প্রাকৃতিক উপাদান কোনকিছুরই চিত্র বা মূর্তি (পোশাকি ভাষায় ভাস্কর্য) নির্মাণ অবৈধ নয়। তবে কেবলমাত্র সেই মূর্তি বা চিত্রকলা যদি অশ্লীল হয়, যদি মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়, যদি সেগুলি সম্মানিত কাউকে অসম্মান করার লক্ষ্যে সৃষ্ট হয় তবে সেটা ঐ কারণে অবৈধ হবে। আর উপাসনা বা পূজা করার জন্য মূর্তি, চিত্র যা কিছুই বানানো হোক না কেন সবই নিষিদ্ধ। সুতরাং বর্তমানে ইসলামের দোহাই দিয়ে যেভাবে হাজার হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করা হচ্ছে সেটাকে ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এ ধরনের কর্মকাণ্ড ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির শামিল, যা জাতি ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
লেখক: হেযবুত তওহীদের
কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...