আল্লাহ কোর’আনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছেন

একটি শ্রেণি মাতৃভাষায় কোর’আন হাদিস পড়াকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- ইসলাম নিয়ে কথা বলতে চাইলে সর্বপ্রথম আরবি জানতে হবে। কারণ কোর’আন হাদিস আরবি ভাষার গ্রন্থ। আরবি জানলে তবেই কেউ কোর’আন হাদিসের সঠিক বুঝ লাভ করবে, সেই সাথে ইসলামের বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করবে। পক্ষান্তরে আরবি না জেনে কেবল ভাবানুবাদ পড়ে সঠিক মর্ম বোঝা যায় না, ইসলাম নিয়ে কথা বলার যোগ্যতাও অর্জিত হয় না। তেমন কেউ ইসলাম নিয়ে কথা বললে, লেখালেখি করলে, বক্তব্য প্রদান করলে তারা ওই ব্যক্তিকে নিয়ে রীতিমত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও করেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়- ‘দুই পাতা বাংলা অনুবাদ পড়েই আপনি ইসলাম বুঝে গেছেন? ইসলাম এত সহজ নয়!’

মাতৃভাষায় কোর’আন-হাদিস পড়ার বিরুদ্ধে এমন খোঁড়া যুক্তি আমি যতবার শুনেছি বিস্মিত ও লজ্জিত হয়েছি। ধর্মের নামে অজ্ঞতাকে বৈধতা দেওয়ার কী নিদারুণ প্রচেষ্টা তাদের। মাতৃভাষায় পড়ালেখা করেই মানুষ বিজ্ঞান শিখছে, ইতিহাস শিখছে, অংক শিখছে- কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু কোর’আন হাদিস শিখতে গেলেই হাজারো বিপত্তি। যেন কোর’আন হাদিসের ভাষ্য বোঝার ক্ষমতা মানুষের নেই। যেন আল্লাহ এমন জটিল পদ্ধতিতে কোর’আন রচনা করেছেন এবং আল্লাহর রসুল সারাজীবন এমন জটিল জটিল কথা বলেছেন যেগুলোর পাঠোদ্ধার করা কোনো সাধারণ মানুষের কর্ম নয়, কেবল মৌলভী-মাওলানাদের পক্ষেই তা সম্ভব। সাধারণ মানুষ ওসব পড়লে ঈমান হারাবার ভয় আছে! কোর’আনের কোনো আয়াত যতই সহজ-সরল মনে হোক, আল্লাহ যতই বলুন ‘কোর’আনকে তিনি বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছেন’ আসলে তা নয়! (নাউজুবিল্লাহ) যেন সত্যিকার অর্থে কোর’আন অত্যন্ত দুর্বোধ্য। এতই দুর্বোধ্য যে, ভাবানুবাদ পড়ে বোঝার উপায় নেই। মূল আরবি জানতে হয়, তার একাধিক অর্থ জানতে হয় এবং বিভিন্ন তাফসিরের পাতা খুঁজে খুঁজে গুপ্ত অর্থও জেনে নিতে হয়। একমাত্র মাওলানা মোফাসসিরদের পক্ষেই তা সম্ভব। কাজেই তারা যেটা বলবেন সেটাই নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে হবে এবং এখানে আর কোনো কথা চলবে না। কথা বলতে চাইলে অবশ্যই আরবির মহাপণ্ডিত হয়ে তারপর আসতে হবে!

আমরা বুঝি এই শ্রেণিটির আসল উদ্দেশ্য কী। মাতৃভাষার প্রতি তাদের অবহেলা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপসহ সমস্ত প্রচার-প্রচারণার আড়ালে মূল কথাটা হচ্ছে, ‘যেভাবেই হোক মানুষকে অজ্ঞ বানিয়ে রাখতে হবে।’ তারা চায় ধর্মকে মুঠোবন্দী করে রাখতে। সেজন্য কোনোভাবেই মানুষকে পড়তে দেওয়া চলবে না, জানতে দেওয়া চলবে না। সাধারণ মানুষ ধর্ম শিখবে কেন? তারা কেবল অনুসরণ করবে, আদেশ পালন করবে। ধর্ম সাধারণ মানুষের শেখার বিষয় নয়, ধর্ম মুফতি-মাওলানাদের শেখার বিষয়। সাধারণ মানুষ কেবল ওই শ্রেণিটির দিকে বোয়াল মাছের মত হা করে তাকিয়ে থাকবে আর তাদের প্রতিটি আদেশকে শিরোধার্য করবে- এই তাদের চাওয়া।

ওই ধর্মীয় নেতারা আরবি ভাষায় শুদ্ধ মাখরাজে কিছু একটা পড়ার পর বলবেন- সুতরাং বোঝা গেল অমুক সরকার কাফের, ওই সরকারের পতন ঘটাতে হবে, অমুক দল ইহুদির দালাল, ওদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে হামলা করতে হবে, অমুক ব্যক্তি মুরতাদ, তাকে কতল করা ওয়াজিব ইত্যাদি- আর সাধারণ মানুষ কিছু না পড়ে, কিছু না জেনে, কিছু না যাচাই করেই তাদের আদেশ পালন করবে। তারা বলবেন, আমার হাতে বাইয়াত নাও, আমায় নজরানা দাও, আমি জান্নাতের সুপারিশকারী হব; অমুক মার্কায় ভোট দাও, সেই ব্যালট পেপার তোমার জান্নাতের অসিলা হবে; অমুক জায়গায় আত্মঘাতী হও, তুমি শহীদের মর্যাদা পাবে। সাধারণ মানুষ মনে করবে এটাই কোর’আনের হুকুম, রসুলের সুন্নাহ। এগুলোই বুঝি কোর’আনের পাতায় পাতায় আরবি হরফে লেখা আছে! তারা দ্বিধাহীনচিত্তে হুকুম তামিল করবে। এখন এই অজ্ঞ-মূর্খ মানুষগুলো যদি নিজেরাই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা শুরু করে, মতামত দেওয়া শুরু করে, তাহলে তো ইচ্ছেমত তাদের ঈমানকে ব্যবহার করা যাবে না। পৌরহিত্যের ব্যবসায় জ্বলবে লালবাতি।

তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে- এতদিন এই ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি যেই আদেশ নিষেধগুলো গোপন করে এসেছে সেগুলো আর গোপন থাকবে না। মানুষ জেনে যাবে কোর’আনের সেই আয়াতগুলো- যেখানে আল্লাহ সু¯পষ্টাক্ষরে বলে দিয়েছেন দ্বীনের বিনিময় নেওয়া হচ্ছে আগুন খাওয়ার সমান। সেই হাদিসগুলো মানুষ জেনে যাবে যেগুলোকে তারা এতদিন ধর্মব্যবসার স্বার্থে গোপন করে এসেছে। মানুষ বুঝবে যাদেরকে তারা ইসলামের কর্তৃপক্ষ মনে করত, যাদের প্রতিটি আদেশকে আল্লাহর আদেশ মনে করে পালন করত তারা কী প্রতারণাটাই না করে এসেছে!
এই ভয়েই কি তারা মানুষকে কোর’আন-হদিস থেকে দূরে রাখতে চান?

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
জনপ্রিয় পোস্টসমূহ