হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কোরবানি? নাকি ভোগের লালসা!

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম

সমগ্র মুসলিম বিশ্বে পালিত হচ্ছে ঈদুল আজহা যার অপর নাম কোরবানির ঈদ। আমরা বাংলায় একটা কথা বলে থাকে, ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। কোরবানির ঈদের প্রকৃত আনন্দ তাই ত্যাগের মধ্যে। কী সেই ত্যাগ? না, নিশ্চয়ই গরু-ছাগল ত্যাগ নয়। বিশ্ব-মুসলিমের জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.) কে আল্লাহ বলেছিলেন প্রিয়বস্তু কোরবানি করতে। সেই প্রিয় বস্তু ছিল তাঁর বৃদ্ধ বয়সের প্রাপ্তি প্রিয় সন্তান ইসমাইল। সন্তানের চেয়ে প্রিয় তো ইব্রাহিম (আ.) এর নিজ সত্ত্বাও নয়। তিনি নিজ হাতে সেই সন্তানকেই কোরবানি করতে উদ্যত হলেন। তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। আজ যারা গরু কোরবানি দিচ্ছেন তারা কি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কল্পনাও করতে পারেন?

না। কোরবানি শব্দের অর্থ যদিও ত্যাগ, তা কালের বিবর্তনে বিকৃত হয়ে কার্যত ভোগে পরিণত হয়েছে। দুর্মূল্যের বাজারে ধার করে হলেও আমরা অনেকেই গরু কিনে প্রতিবেশীকে দেখাচ্ছি যে আমরা স্বচ্ছল, ধনশালী। সমগ্র বিশ্ব আজ মুসলমানের রক্তে রঙিন। বিশ্বে সাত কোটি উদ্বাস্তু মুসলমান। দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত মুসলমান, পানিতে ডুবে বোমার আঘাতে মরছে মুসলমান। সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই, সেই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ন্যূনতম প্রচেষ্টাও নেই। সেজন্য নিজের জান ও মালের ন্যূনতম কোরবানি দিতেও আমরা প্রস্তুত নই। পূর্বের উম্মাহগুলোর জন্য কোরবানিকৃত পশুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এই জাতির জন্যও যদি তা হতো তাহলে এত গরুর হাট বসত কিনা, ফেসবুক খুললে গরুর ছবি দেখা যেত কিনা সন্দেহ। আজকের এই পশু জবাই আসলে ভোগের জন্য। এখানে হাজারো কণ্ঠে ত্যাগের মহিমা বর্ণনা করা হলেও বাস্তবে তা নয়। আমরা চাই কোরবানি হোক প্রকৃত কোরবানি। সেই কোরবানি হবে মো’মেনের জানের কোরবানি, মালের কোরবানি।

মো’মেনদের ক্ষেত্রে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, মো’মেনরা ভাই ভাই (সুরা হুজরাত- ১০)। প্রথমে তারা আল্লাহর দেওয়া দীন অনুসরণ করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। তারা সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হবেন (সুরা সফ- ৪)। তারা নিজেরা যেমন এই ঐক্যের মধ্যে থাকবেন তেমনি তারা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিও গড়ে তুলবেন। তারা যে আল্লাহর প্রতিনিধি, খলিফা তারা এর প্রমাণ দিবেন। ঐক্যের মধ্যে শান্তি ও সুখ নিহিত। তাই তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ফলে সমগ্র পৃথিবীতে অনাবিল শান্তি-সুখ প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদেরকে আজ এ বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে। আমরা মুসলিম দাবিদারগণ আজ পৃথিবীতে সংখ্যায় ১৬০ কোটি। এই ১৬০ কোটির মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি কেবল উদ্বাস্তু। গত দুই দশকে এই জাতির অন্তত্ব পঁচিশ লক্ষ মানুষ বৈদেশিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে তাদের বোমা ও বুলেটের আঘাতে, তাদের রাসায়নিক অস্ত্রের বিষক্রিয়ায় নির্মম মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের দেশগুলোয় আক্রমণ করে দেশবাসীকে বিতাড়িত ও হত্যা করে দখল করে নিচ্ছে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীরা। নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র ‘উদ্বোধন’ করা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে। ছোট ছোট সুন্দর ফুটফুটে মাসুম বাচ্চাগুলো করুণ মৃত্যু দেখে হৃদয় খান খান হয়ে যায়। নারীর ইজ্জত হরণ দেখে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়, প্রতিবাদে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়। মুসলিমদের এই যে দুর্দশা এটা যে কেবল বৈদেশিক শত্রুর আগ্রাসনের ফল তা কিন্তু নয়। শত শত বছর থেকে চলে আসা শিয়া-সুন্নী ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতও এর জন্য দায়ী। হাজার হাজার ফেরকা, তরিকা, মাহজাবে বিভক্ত হয়ে এ জাতিটি আজ বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খল জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে বিরাজিত এই বিভক্তির প্রাচীর দিনকে দিন আরো পুরু হয়ে উঠছে। প্রতিটা সমাজে অন্যায়, অবিচার, ধর্ষণ, দ্বন্দ্ব, খুন, সন্ত্রাসবাদ এমনভাবে ভাইরাসের মতো বিস্তার লাভ করেছে যে, এখন পুরো জাতি দিশেহারা।

এ অবস্থায় আমাদের সবার জন্য জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতিকে আবারো সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ করা। আমরা হেযবুত তওহীদ একজন মহান ব্যক্তির অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে তওহীদের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হয়েছি। তিনি হলেন এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী, যিনি এই মাটিরই সন্তান টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের একজন সদস্য। আমরা ইতিহাস থেকে জানি, আল্লাহর রসুলও (সা.) সেই আরবের বিশৃঙ্খল অসভ্য জাতিটিকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আমরা সেই সত্যটি লাভ করেছি যে মহাসত্য দিয়ে এই সমগ্র মানবজাতির জীবন থেকে অশান্তির আগুনকে নির্বাপিত করা যায়, পৃথিবীকে একটি শান্তির বাগিচায় পরিণত করা যায়। এ সত্য লাভের পর আমরা আর অন্যদের মত অলস নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকতে পারি না। আমরাও পারতাম অন্যদের মতো সুখ-আহ্লাদে মেতে থাকতে, টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আর খেলা দেখতে। কিন্তু আমরা তা পারি না, কারণ বিবেক আমাদেরকে স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হতে বাধা দিচ্ছে। যারাই একটু দৃষ্টি প্রসারিত করবেন, একটু তাকাবেন নিজের সমাজের দিকে, তাকাবেন এর রক্তস্নাত দুনিয়ার দিকে তারাই উপলব্ধি করবেন যে, এই মুসলমান জাতির এখন ঈদ করা সাজে না। প্রকৃতপক্ষে তারা তো একটি ঘৃণিত দাস জাতি। এই দাসত্বের জীবনে মানুষ কী করে আনন্দ পেতে পারে। তারা দেখতে পাবে আজ উদ্বাস্তু শিবিরে ঈদ নেই, সন্তানহারা মায়ের ঈদ নেই, এতিম রোহিঙ্গা শিশুটির ঈদ নেই, ধর্ষিতা নারীদের ঈদ নেই। তাদের কাছে এই দিনটি ভীষণরকম বিবর্ণ। অথচ আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হজ করতে যাই, পশু জবাই করি। এসব যে আল্লাহর কাছে অর্থহীন সেটা বোঝার জন্য যতটুকু সাধারণ জ্ঞান দরকার তাও আমাদের হারিয়ে গেছে। এই জন্যই বুঝি মহানবী (সা.) বলেছিলেন, সময় আসবে যখন রোজা রাখা হবে না খেয়ে থাকা আর তাহাজ্জুদ পড়া হবে ঘুম নষ্ট করা (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)।

আমরা চাই মুসলিম জাতির জীবনে প্রকৃত ঈদ ফিরে আসুক। ঈদের দিনে যেন আমাদেরকে কোনো ক্রন্দনশীলা মায়ের আহাজারি শুনতে না হয়, কোনো ত্রাণপ্রত্যাশী শিশুর জীর্ণ মুখ আমাদের হৃদয়কে দীর্ণ না করে দেয়। আমাদের ঈদের আনন্দ যেন হয় অমলিন মাধুর্যে পূর্ণ। এই ঈদ তো এমনি এমনি আসবে না, সেজন্য আমাদেরকে বহু অশ্রু, রক্ত ও ঘামের নদী পাড়ি দিতে হবে, আমাদেরকে ধর্মব্যবসায়ীদের কায়েম করে রাখা বিকৃত ইসলামের শেকল থেকে প্রকৃত ইসলামকে মুক্ত করতে হবে, মানবজাতিকে মুক্ত করতে হবে দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টান ভোগবাদী বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র কারাগার থেকে। আমরা সেই সংগ্রামে নেমেছি। কিন্তু আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ধর্মজীবী গোষ্ঠী, কারণ প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা মানুষ জেনে ফেললে তাদের ধর্মব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা নানাভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বাংলার ষোলো কোটি মানুষের প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ থাকবে, আপনারা আমাদের বক্তব্য কী, আমরা কী চাই তারা জানবেন ও বুঝবেন। আমাদের লেখাগুলি পড়বেন। যদি আমরা অযৌক্তিক কোন কথা বলে থাকি সেটা আমাদের কথা শুনলেই জানতে পারবেন। আপনারা আমাদের বক্তব্য শুনলেই বুঝবেন আমাদের এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য কী। আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, একটি সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে, শক্তি প্রয়োগ করে সম্ভব হয় না। মানুষ যেমন দেহধারী তেমনি তার আত্মাও রয়েছে। মানুষ যেন অন্যায়কে ঘৃণা ও প্রতিরোধ করে, নিজে থেকেই অন্যায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে সেজন্য তাদের বিবেক ও চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য একটি সঠিক ও নিখুঁত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ করতে হয়। সেই সঠিক ও নিখুঁত আদর্শটি আমাদের কাছে আছে। সেটাই আমরা সর্বাত্মক উপায়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের বক্তব্য খুব সরল, আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ একজন, আমাদের রসুল একজন, আমাদের কেতাব একটি, আমাদের দীন একটি, আমাদের কেবলাহ একটি, আমাদের জাতিও হবে একটি, সেই জাতির নেতাও থাকবেন একজন, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে এক ও অভিন্ন, আমাদের পথ হবে একটি, সর্ববিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে একটি। ফলে আমাদের সমাজে থাকবে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা এক কথায় শান্তি। এটাই রসুলাল্লাহ করে গিয়েছিলেন কিন্তু আজ এ জাতির মধ্যে হাজার হাজার মত, পথ, তরিকা। এদের একক কোন নেতৃত্ব নেই, উম্মতে মোহাম্মদীর সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তারা অনবহিত। পৃথিবীর একটা ইঞ্চি জায়গা নেই যেখানে আল্লাহর হুকুম চলে, উল্টো আমরা সকল জাতির কাছে লাথি খাচ্ছি, তাদের গোলামী করে জিন্দেগী পার করে দিচ্ছি। এ পরিস্থিতিতে জাতি যে মো’মেনই থাকে না সেটা আপনারা একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করতে পারবেন। আর পরকালে জান্নাতের আশায় যে হাজারো প্রকার আমল করে যাচ্ছি সেই আমলও আমাদেরকে জান্নাতে নিতে পারবে না, যদি না আমরা মানবজাতিকে এই অন্যায় অশান্তি থেকে উদ্ধার করতে না পারি।

পরিশেষে বলব, আসুন আমরা নিজেদেরকে স্বার্থপাশ থেকে মুক্ত করে নিজেদের এই নশ্বর জীবনকে আল্লাহর রাস্তায়, মানবতার কল্যাণে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য শপথ নেই। মানুষের ঈমানকে শত শত বছর থেকে হাইজ্যাক করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয়েছে, স্বার্থসিদ্ধি করা হয়েছে। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই এবং এক আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানবো না, আমরা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে হবো বজ্রকঠিন ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার জাতি- এটাই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আমরা মো’মেন হতে পারি, আমরা যেন কোনোপ্রকার অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করি। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, মাদক, অপরাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতাসহ সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মানবতার কল্যাণে আমাদের জীবন ও সম্পদকে উৎসর্গ করতে পারি, সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর অস্ত্রব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসন থেকে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলার মাটিকে হেফাজত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারি। এটাই হোক আসল কোরবানি, আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হোক বছরের প্রতিটি দিন। আল্লাহুম্মা আমীন।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...