হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

অর্থনীতির তালগোল, এক কাপ চা ১২০ রুপি!

মোহাম্মদ আসাদ আলী

অর্থনীতির তালগোল, এক কাপ চা ১২০ রুপি!

শ্রীলঙ্কায় এক কাপ দুধ চায়ের দাম এখন ১২০ রুপি! এর আগে জিম্বাবুয়ে, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদি দেশেও ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির উদাহরণ দেখেছি। এখন ওই দেশগুলোর অবস্থা কী জানি না। এই যে হঠাৎ হঠাৎ একেকটা দেশের অর্থব্যবস্থা ধ্বসে পড়া, মুদ্রাস্ফীতি চরম মাত্রায় চলে যাওয়া- এটা কীভাবে ঘটে? কেন ঘটে? এমন তো না শ্রীলঙ্কার মানুষ হঠাৎ করে কাজকর্ম করা বাদ দিয়েছে তাই অর্থনীতি ধ্বসে পড়েছে! জনগণ আগের মতোই কাজ করছে, আগে যে জমিতে যত মন ফসল ফলত এখনও তা-ই ফলছে, আগে যেই কাজের যত টাকা মজুরি পাওয়া যেত এখনও তা-ই পাওয়া যাচ্ছে, শুধু বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে দাম ২০গুণ বেড়ে গেছে। এ কেমন অদ্ভূতুড়ে কাণ্ড!

এই ঘটনাগুলো দেখলে বোঝা যায় বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা কতটা ঠুনকো কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমরা তার ঝুঁকিটা বুঝতে পারি না বলে নির্বিকার জীবনযাপন করতে পারি! বোধহয় সেজন্যই ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন- “এটা স্বস্তির বিষয় যে মানুষ ব্যাংকিং এবং মুদ্রাব্যবস্থা বোঝে না। কারণ যদি তারা বুঝত, তাহলে রাত পোহাবার আগেই বিপ্লব শুরু হয়ে যেত!“

সত্যিই অবাক হতে হয়। মানুষ অর্থ-সম্পদের পেছনেই নিরন্তর ছুটে চলেছে, অথচ জানে না অর্থনীতি চলছে কীভাবে। অবশ্য জানতে চাইলেও খুব একটা লাভ হবে না। অর্থনীতির জটিলতা নিয়ে খোদ আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভের সিনিয়র উপদেষ্টা জেরেমি রুড বলেছেন- “এই ব্যবস্থা যে কীভাবে কাজ করে, সেটা পরিপূর্ণভাবে বোঝা এখন আর মানুষের পক্ষে সম্ভব না।”

খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের উপদেষ্টাই যদি বলে এই ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে তা আর মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না- তাহলে আপনি কীভাবে আশা করেন বুঝতে পারবেন! আসলে সম্ভব না। সম্ভব না বলেই আমরা জানতেও পারি না কীভাবে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও আমাদের অনেকের ঘরে ছেলেমেয়েরা উপোস থাকে, আরেকদিকে পায়ের উপর পা তুলে বসে থেকেই আরেকদল লোক মিলিয়নার বিলিয়নার হয়ে যায়।

তবে আরেকটা কথা আছে। আমাদের অনেকের পক্ষে অর্থনীতির আদ্যোপান্ত বুঝে কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে সেটা হয়ত বের করা সম্ভব হবে না, তাই বলে চোখের সামনে আমাদের টাকা যে চুরি হয়ে যাচ্ছে, দেশের সম্পদ কোথায় যেন চলে যাচ্ছে তা বোঝা কিন্তু মোটেও কঠিন কাজ না। শুধু পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেও তো কতকিছু জানা যায়।

যেমন ধরুন- কয়েক বছর আগে একটি গবেষণা রিপোর্টে জানতে পেরেছিলাম বিশ্বের অর্ধেক মানুষের কাছে যত সম্পদ আছে, তার সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ৬২ জন ধনকুবের! এই খবর পুরোপুরি হজম না হতেই পরের বছর শুনি ৬২ জন নয় বরং অর্ধেক মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ জমা হয়েছে মাত্র ৮ জন ব্যক্তির হাতে। কত দ্রুত সময়ে সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ ঘটছে ভাবা যায়? আপনার আমার মতো ৪০০ কোটি মানুষ যে পরিমাণ সম্পদ ভোগ করছে, এরা মাত্র ৮জন ব্যক্তি সেই পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে বসে আছে। এত সম্পদ এরা পেল কীভাবে? এরা কি গবেষণাগারে সম্পদ বানাচ্ছে? না বানাচ্ছে না। সম্পদ বানাচ্ছে ৮০০ কোটি মানুষ! আর তা কীভাবে কীভাবে যেন পৌঁছে যাচ্ছে ওই মহাজনদের ভা-ারে! আমরা সেই সম্পদের প্রবাহ দেখতেও পাচ্ছি না, বুঝতেও পারছি না!

আগেকার দিনে অর্থব্যবস্থা যখন তুলনামূলক সহজ ছিল, শোষণটা চোখে দেখা যেত। আমরা দেখতে পেতাম আমাদের কৃষকের ফলানো সোনার ফসল জমিদারের গোলায় জমা হচ্ছে। সেখান থেকে চলে যাচ্ছে বন্দরে। তারপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে বিলেতে। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা জমিদারের গোলার সামনে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে! এখন দিন বদলেছে। ধান-চাল-গম-আলু এখন আর প্রধান সম্পদ নয়। এরচেয়েও দামী সম্পদের আবির্ভাব হয়েছে। তৈরি হয়েছে কাগজের মুদ্রা। তৈরি হয়েছে ডলার। জীবনে যেই ডলার হাত দিয়েও স্পর্ষ করি নাই, সেই ডলারই নাকি নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের অর্থব্যবস্থা! তবে কি সেই ডলারে ডলা দিলেই বেরিয়ে আসছে আলাদিনের দৈত্য? তারপর যা চাইছে তাই পেয়ে যাচ্ছে ধনকুবেররা! আর ডলার নেই বলে মলিন বদনে ঘরে ফিরে দু’মুঠো ভাত খেতে পাচ্ছে না কুলি-মজুরের সন্তান!

তালগোলটা খেয়াল করুন। একজন কৃষক নিজের জমিতে ফলানো ধান বাজারে বিক্রি করে কিছু কাগজের টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। সেই কাগজের টাকার নির্ধারিত মূল্যমান নেই। কে বা কাহারা কোথায় বসে সেই টাকার মান বাড়াচ্ছে কমাচ্ছে তা ঘুনাক্ষরেও টের পাচ্ছে না কৃষক! সে এক মন ধান বিক্রি করে টাকা বালিশের নিচে রেখে দিয়েছে। এক বছর পর সেই কৃষক দেখল তার ঘরে ধান নাই, ধান কেনা দরকার। বালিশের নিচ থেকে টাকাটা বের করে কৃষক ধান কিনতে বাজারে গেল এবং শুনল- ধানের দাম বেড়ে গেছে। ওই টাকা দিয়ে সে আর এক মন ধান কিনতে পারবে না। দশ কেজি কম কিনতে হবে। এবার একমন ধানের টাকা দিয়ে তিরিশ কেজি ধান কিনে কৃষক বাড়ি ফিরছে আর ভাবছে- বাকি দশ কেজি ধান কই গেল? একইভাবে যেই শ্রমিক কল-কারখানায় শ্রম দিচ্ছে, যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসা বাণিজ্য করছে, সবার মাথাতেই প্রশ্নের জট দিনদিন বেড়েই চলেছে! টাকা আছে, কিন্তু টাকার উল্টো পিঠে যে সম্পদটা থাকার কথা, সেটা কমে যাচ্ছে! ঘটনাটা কী? আবার কমতে কমতে হঠাৎ একদিন দেখা গেল একেবারেই কমে গেছে! একটা মুরগি কিনতেই লাগছে এক বস্তা টাকা!

এই ভুতুড়ে অর্থব্যবস্থার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...