হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

হেদায়াহ্হীন তাকওয়া অর্থহীন

মোফাজ্জল হোসাইন সর্দার

দীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদী বিষয় আকিদা ও ঈমানকে যেমন একই বিষয় করে ফেলা হয়েছে তেমনি হেদায়াহ ও তাকওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এ দু’টি বিষয়কেও এক করে ফেলা হয়েছে।
আমাদের বর্তমান বিকৃত আকিদায় আমরা ইসলামকে যে দৃষ্টিতে দেখি তাতে ‘ধর্মকর্ম’ করে না এমন একটি লোককে যদি উপদেশ দিয়ে নামাজ রোজা করানো যায়, যাকাত দেয়ানো যায়, মিথ্যা পরিহার করানো যায়, সত্য কথা বলানো যায়, এক কথায় সব রকম অন্যায়-মিথ্যাচার থেকে তাকে বাঁচিয়ে পবিত্র জীবন-যাপন করানো যায়, তবে বলা হয় লোকটি হেদায়েত হয়েছে। ভুল বলা হয়, সে হেদায়াত হয় নি, সে তাকওয়া অবলম্বন করেছে অর্থাৎ মুত্তাকী হয়েছে। হেদায়াত ও তাকওয়া দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হেদায়াত অর্থ সঠিক পথে চলা। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যে গন্তব্য স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সেই পথে চলা। সেটা কোন্ পথ? সেটা হলো ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’’ সহজ-সরল পথ। ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ কী তা তাকওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কারভাবে জেনে নেওয়া দরকার।
ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করল যে মাটি দিয়ে তৈরি তোমার খলিফা আদমকে (মানবজাতিকে) তোমার দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত করে তাকে তার নিজের তৈরি করা পথে নিয়ে যাবো যে পথে চলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে মানুষের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অশান্তি, অবিচার এবং যুদ্ধ ও রক্তপাত (ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা)। আল্লাহ ইবলিসের ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং তাকে বললেন, আমি মানুষ জাতির মধ্যে আমার নবী-রসুল পাঠিয়ে এমন পথ দেখাব- যে পথে চললে তারা তোমার ঐ অশান্তি-অবিচার, অত্যাচার ও রক্তপাতের মধ্যে যেয়ে পড়বে না। আমার নবী-রসুলদের দেখানো পথে চললে তারা সুবিচার ও শান্তির মধ্যে বাস করবে। এই পথের নাম দিলেন তিনি সিরাতুল মুস্তাকীম; সহজ সরল পথ। এই সহজ সরল পথ কী? এটা হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ, হুকুমদাতা, বিধানদাতা নেই; উপাস্য নেই, প্রভু নেই, কাজেই আর কারো আদেশ নিষেধ না মানা; জীবনের কোনো ক্ষেত্রে আর কারো আইন-কানুন না মানা অর্থাৎ প্রকৃত তওহীদ। আল্লাহ তার প্রদর্শিত পথ এত সহজ কেন করলেন? এই জন্য করলেন যে মানুষ যদি তার আইন, আদেশ নিষেধ ছাড়া অন্য কোনো আইন, জীবন-বিধান না মানে তবেই ইবলিস পরাজিত হবে। সে আর মানুষকে অন্য কোনো পথে পরিচালিত করতে পারবে না এবং মানুষও অশান্তি, অবিচার আর রক্তপাতের মধ্যে পতিত হবে না। কাজেই মানবজাতির মধ্যে যারা এই সিরাতুল মুস্তাকীমে চলবে তারা আল্লাহর দলে, আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোনো জীবন-বিধানকে স্বীকার করবে সেটা সম্পূর্ণই হোক বা আংশিকই হোক, তারা ইবলিসের দলে। বিকৃত আকিদায় তারা ব্যক্তি জীবনে সারারাত নামাজ পড়লেও সারা বছর রোজা থাকলেও সেই ইবলিসের দলে। এই সহজ সরলতাকে বোঝাবার জন্য রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন- মানুষের সাথে আল্লাহর চুক্তি হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বলে স্বীকার করবে না, আল্লাহর পক্ষ থেকে চুক্তি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন। এখানে নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদির কোনো শর্ত আল্লাহ রাখেন নি। এই হলো সহজ সরল পথ, সিরাতুল মুস্তাকীম। এই পথে চলা হলো হেদায়াতের পথে চলা, এই হলো আল্লাহর দেয়া দিক-নির্দেশনা।
এখন তাকওয়া অর্থ কী? তাকওয়ার অর্থ সাবধানে জীবনের পথ চলা। কোথায় পা ফেলছেন তা দেখে পথ চলা। অর্থাৎ জীবনের পথ চলায় ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-অঠিক দেখে চলা, অসৎ কাজ পরিহার করে সৎ কাজ করে চলা। কোর’আনের অনুবাদগুলিতে তাকওয়া শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে, ‘আল্লাহভীতি’ দিয়ে, ইংরেজিতে “Fear of God” দিয়ে। তাতে প্রকৃত অর্থ প্রকাশ পায় না। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এর মাপকাঠি আসবে কোথা থেকে? এর মাপকাঠি অবশ্যই আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের যে মাপকাঠি দিয়েছেন সেইটা, অন্য কোনো মাপকাঠি নয়। কাজেই সে হিসাবে আল্লাহভীতি এবং Fear of God শব্দগুলো চলে এবং সেই হিসাবেই তাকওয়া শব্দের অনুবাদে ওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে আল্লামা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন Fear of God বলে এবং মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল করেছেন Mindful of duty to Allah অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে চেতনা বলে। প্রকৃত পক্ষে তাকওয়া শব্দের মর্ম হলো আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের যে মাপকাঠি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, সেই মাপকাঠি মোতাবেক জীবনের পথে চলা। যারা অমন সাবধানতার সঙ্গে পথ চলেন তাদের বলা হয় মুত্তাকী। তাহলে দেখা যাচ্ছে তাকওয়া ও হেদায়াত দু’টো আলাদা বিষয়। তাকওয়া হচ্ছে সাবধানে পথ চলা আর হেদায়াত হচ্ছে সঠিক পথে চলা। আরও পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। আপনি আপনার গন্তব্য স্থানের দিকে দু’ভাবে যেতে পারেন। অতি সাবধানে পথের কাদা, নোংরা জিনিস এড়িয়ে, গর্ত থাকলে গর্তে পা না দিয়ে, কাঁটার উপর পা না ফেলে চলতে পারেন। ওভাবে চললে আপনার গায়ে ময়লা লাগবে না, আছড়ে পড়ে কাপড়ে কাদামাটি লাগবে না। আবার পথের ময়লা, গর্ত, কাঁটা ইত্যাদির কোনো পরওয়া না করে সোজা চলে যেতে পারেন। ওভাবে গেলে আপনি আছাড় খাবেন, গায়ে-কাপড়ে ময়লা কাদামাটি লাগবে। আর হেদায়াত হচ্ছে আপনি এ উভয়ভাবের যে কোনও ভাবে যে পথে চলছেন সে পথ সঠিক হওয়া, অর্থাৎ সে পথ আপনাকে আপনার প্রকৃত গন্তব্য স্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা। পথ যদি সঠিক না হয়ে থাকে অর্থাৎ হেদায়াত না থাকে তবে আপনার শত সাবধানে পথ চলা অর্থাৎ শত তাকওয়া সম্পূর্ণ বিফল, কারণ আপনি আপনার গন্তব্যস্থানে পৌঁছবেন না। আর যদি সঠিক পথে অর্থাৎ হেদায়াতে থাকেন ও চলেন তবে তাকওয়া না করেও গায়ের কাপড়ে কাঁদামাটি লাগিয়ে আপনি আপনার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবেন আপনি সফলকাম হবেন। অর্থাৎ তাকওয়া এবং হেদায়াতের মধ্যে বুনিয়াদেই পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে এটাও দেখা যাচ্ছে যে- হেদায়াহ না থাকলে তাকওয়া অর্থহীন এবং সেই হেদায়াত, সঠিক পথটি হলো সিরাতুল মুস্তাকীম, সহজ সরল পথ, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে এক আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান না মানা, তওহীদ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...