হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

হেদায়াবিহীন তাকওয়া জান্নাত দেবে না

দীনুল ইসলামের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে বর্তমানে আমাদের আকিদা যেমন বিকৃত ও ভুল, তেমনি তাক্ওয়া ও হেদায়াহ সম্বন্ধেও আমাদের ধারণা ভুল। কোনো দুষ্ট প্রকৃতির গোনাহগার লোককে যদি উপদেশ দিয়ে মদ খাওয়া ছাড়ানো যায়, চুরি-ডাকাতি ছাড়ানো যায়, তাকে নামাজি বানানো যায়, রোজা রাখানো যায় তবে আমরা বলি- লোকটা হেদায়াত হয়েছে। ভুল বলি। কারণ আসলে সে হেদায়াত হয় নি, মুত্তাকী হয়েছে।

তাক্ওয়া এবং হেদায়াহ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তাক্ওয়া হচ্ছে সাবধানে, সতর্কভাবে জীবনের পথ চলা। খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থেকে ভালো কাজ করে যাওয়াই হচ্ছে তাক্ওয়া, পাপ, গোনাহ থেকে বেঁচে সওয়াব, পুণ্যের কাজ করে জীবনের পথ চলা হচ্ছে তাক্ওয়া। কোর’আনের ঐ শব্দকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে ‘খোদাভীতি’ দিয়ে এবং ইংরেজিতে ঋবধৎ ড়ভ এড়ফ দিয়ে। আল্লাহকে ভয় না করলে পাপ-পুণ্য বেছে চলার প্রশ্ন ওঠে না, কাজেই সে দিক দিয়ে এ শব্দ দু’টি চলে, কিন্তু তাক্ওয়ার পূর্ণ অর্থ প্রকাশ হয় না। কোর’আনের অন্যতম প্রখ্যাত ইংরেজি অনুবাদক মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল তাক্ওয়ার অনুবাদ করেছেন Mindful of duty to Allah অর্থাৎ; “আল্লাহর প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতনতা” বলে। এটাও আংশিকভাব প্রকাশ করে মাত্র। সংক্ষেপে, আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের, পাপ-পুণ্যের যে মাপকাঠি মানুষের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন সেই মাপকাঠি সম্বন্ধে সতর্কতা ও সচেতনতা নিয়ে জীবনের পথ চলার নাম তাক্ওয়া। আর হেদায়াহ হচ্ছে আল্লাহ-রসুল যে পথ প্রদর্শন করেছেন, যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই পথে, সেই দিকে চলা।

তফাৎটা লক্ষ করতে হবে- একটা হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানের দিকে পথ চলা (হেদায়াহ), অন্যটি হচ্ছে পথ চলার সময় সাবধানে, সতর্কতার সাথে পথ চলা, যাতে পা গর্তে না পড়ে, কাদায় পা না পিছলায়, কাঁটায়, ময়লায় পা না পড়ে (তাক্ওয়া) কিম্বা অসতর্ক, অসাবধানে পথ চলা। আল্লাহ যে পথে চলতে আদেশ দিচ্ছেন সেটা হলো সেরাতুল মুস্তাকিম- সহজ, সরল পথ, জীবনের সর্বস্তরে, সর্ব অঙ্গনে, সর্ব বিভাগে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন-কানুন, নীতি-নির্দেশ অস্বীকার করা এবং তাঁকে ছাড়া আর কারো উপাসনা না করা- এক কথায় তওহীদ; এই সহজ সোজা কথা। আর ঐ পথের, সেরাতুল মুস্তাকিমের লক্ষ্য হলো সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে ঐ তওহীদকে সমস্ত পৃথিবীতে মানব জীবনে প্রয়োগ ও কার্যকর করে সুবিচার ও শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করা।

কোর’আনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাক্ওয়া ও হেদায়েতের পার্থক্যও দেখিয়ে দিয়েছেন। কোর’আনের শুরুতেই তিনি বলেছেন, এই বই সন্দেহাতীত; এটা মুত্তাকীদের (সাবধানে, সতর্কতার সাথে পথ চলার পথিকদের) জন্য হেদায়াহ (সঠিক পথ প্রদর্শন, সঠিক দিক নির্দেশনা) (সুরা বাকারা ২)। পরিষ্কার দু’টো আলাদা বিষয় হয়ে গেল একটি তাক্ওয়া, অন্যটি হেদায়াহ, একটি সাবধানে পথ চলা, অন্যটি সঠিক পথে চলা। আল্লাহ তাঁর রসুলকে বলেছেন আমি তোমাকে সেরাতুল মুস্তাকিমে হেদায়াত করেছি (সুরা ফাতাহ ২)। অন্যত্র তিনি তাঁর নবীকে বলছেন- তিনি (আল্লাহ) কি তোমাকে হেদায়াত করেন নি (সুরা দোহা ৭)? বর্তমানের বিকৃত আকিদায় মুত্তাকী হওয়া মানেই যদি হেদায়াত হওয়া হয় তবে বিশ্বনবীকে আবার হেদায়াত করার প্রয়োজন কী? নবুয়্যত পাবার আগেও যার গোনাহ ছিল না, যার চেয়ে বড় মুত্তাকী আর কেউ নেই, তাঁকে হেদায়াত করার প্রয়োজন কী?

আল্লাহ রসুলের দেয়া দিক-নির্দেশনা (হেদায়াত) আজ এই জাতির সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, এই জাতি এখন ঐ দিক-নির্দেশনার ঠিক বিপরীত দিকে চলছে, তাই হেদায়াহ আর তাক্ওয়ার অর্থ আমাদের কাছে এক অর্থ হয়ে গেছে। আল্লাহর দেখানো পথে, সঠিক পথে অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকিমে দু’ভাবে চলা যায়। তাক্ওয়ার সাথেও চলা যায়, তাক্ওয়া বাদ দিয়েও চলা যায়। পথ যদি সঠিক থাকে, দিক-নির্দেশনা, গন্তব্যস্থান যদি ঠিক থাকে তবে তাক্ওয়াহীনভাবে চললেও মানুষ তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছবে, রাস্তায় পা পিছলে আছাড় খেয়ে গায়ে, কাপড়ে কাঁদামাটি মেখেও সে তার গন্তব্যস্থানে, জান্নাতে পৌঁছবে। কিন্তু ঐ সঠিক পথে যদি সে না থাকে তবে অতি সতর্র্কতার সাথে পথ চললেও, আছাড় না খেলেও, কাপড়ে, পায়ে কোনো ময়লা না লাগলেও সে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পারবে না, সে পৌঁছবে জাহান্নামে।

আল্লাহর রসুল যখন আবু যরকে (রা.) বলছেন- হে আবু যর! যে লোক মৃত্যু পর্যন্ত তওহীদে অটল থাকবে সে লোক ব্যভিচার করলেও, চুরি করলেও জান্নাতে যাবে (হাদিস- আবু যর (রা.) থেকে বোখারি, মুসলিম, মেশকাত), তখন তিনি ঠিক এই কথাই বুঝাচ্ছিলেন- ঐ ব্যভিচারী, চোর তাক্ওয়ায় নেই, কিন্তু হেদায়াতে অর্থাৎ সেরাতুল মুস্তাকিম- সহজ সোজা রাস্তায় অর্থাৎ তওহীদে আছে।

তারপর লক্ষ্য করুন সেই ঘটনাটির দিকে- একজন লোকের জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লোকজন সমবেত হলে রসুলাল্লাহ সেখানে এলেন। ওমর (রা.) বিন খাত্তাব বললেনÑ ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনি এর জানাজার নামাজ পড়াবেন না। কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, ঐ লোকটি অত্যন্ত খারাপ প্রকৃতির দুষ্কৃতিকারী লোক ছিলেন। শুনে বিশ্বনবী সমবেত জনতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- তোমাদের মধ্যে কেউ এই লোকটিকে কখনও ইসলামের কোনো কাজ করতে দেখেছ? একজন লোক বললেন- ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি একে একবার আল্লাহর রাস্তায় (জেহাদে) একরাত্রি (অন্য একটি হাদিসে অর্ধেক রাত্রি) পাহারা দিতে দেখেছি। এই কথা শুনে মহানবী ঐ মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়ালেন, তাকে দাফন করার পর, (তাকে উদ্দেশ্য করে) বললেন তোমার সঙ্গীরা মনে করছে তুমি আগুনের অধিবাসী (জাহান্নামী), কিন্তু আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি জান্নাতের অধিবাসী (হাদিস- ইবনে আয়াজ (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত)।

ইসলামের প্রকৃত আকিদা বুঝতে গেলে এই দুইটি হাদিস গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। ওমর (র.) যখন রসুলাল্লাহকে বললেন যে ঐ মৃত লোকটি অত্যন্ত খারাপ লোক ছিলেন তখন সমস্ত লোকজন থেকে কেউ ও কথার আপত্তি করলেন না, অর্থাৎ ওমরের (রা.) ঐ কথায় সবাই একমত। একমত হবার কথাই- কারণ হাদিসের ব্যাখ্যাকারীগণ বলেছেন ঐ মৃত লোকটি ডাকাত ছিলেন- বণিকদের কাফেলা আক্রমণ করে লুটপাট করতেন। তারপর মহানবী যখন সমবেত লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন তাদের মধ্যে কেউ ঐ মৃত লোকটিকে কোনোদিন ইসলামের কোনো কাজ করতে দেখেছেন কিনা তখন ঐ একমাত্র লোক ছাড়া আর কেউ বলতে পারলেন না যে তাকে কোনোদিন ইসলামের কোনো কাজ করতে দেখেছেন। বিশ্বনবী বলেছিলেন ইসলামের কোনো কাজ, শব্দ ব্যবহার করেছিলেন- আমলেল ইসলাম। ইসলামের আমল কী? অবশ্যই নামাজ, যাকাত, হজ্ব, রোজা ইত্যাদি আরও বহুবিধ ফরজ, ওয়াজেব, সুন্নত, নফল ইত্যাদি। কেউ তাকে কোনোদিন ইসলামের কোনো কাজ করতে দেখেন নি অর্থাৎ কেউ তাকে ওগুলির কিছুই করতে দেখেন নি। একটি দুশ্চরিত্র ঘৃণিত ডাকাত যাকে কেউ কোনোদিন কোনো এবাদত করতে দেখে নি, শুধুমাত্র জেহাদে যেয়ে অর্ধেক রাত্রি মুসলিম শিবির পাহারা দেয়ার জন্যই আল্লাহর রসুল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন যে ঐ লোক জান্নাতী এবং তিনি স্বয়ং সে ব্যাপারে সাক্ষী। কেন? এই জন্য যে, যারা পৃথিবীতে তওহীদ প্রতিষ্ঠা করে মানব জীবনের সমস্ত অন্যায় অবিচার মুছে ফেলে, আল্লাহকে এবলিসের চ্যালেঞ্জে জয়ী করাবার জন্য সংগ্রামে নেমেছিলেন, ঐ লোকটি তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং অর্ধেক রাত্রি ঐ যোদ্ধাদের শিবির পাহারা দেওয়ার মত সামান্য কাজ করেছিলেন।

আমি পেছনে বলে এসেছি- ইসলামের সর্বপ্রধান ভাগ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য দু’টি। একটি হলো সর্বব্যাপী তওহীদ, দ্বিতীয়টি হলো ঐ তওহীদ মানব জীবনে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কাজেই যারা ঐ দুইটি কাজ করেছেন তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে গেছে, জান্নাত নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। তাদের ব্যক্তিগত গোনাহ যতই থাকুক, এমন কি এই পৃথিবী পূর্ণ করে দেয়া যায় এত পাপ থাকলেও আল্লাহ বলেছেন তিনি তাকে জান্নাতে দেবেন (হাদিস- তিরমিজি)। এই আকিদা এবং বর্তমানে প্রচলিত ইসলামের আকিদা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আকিদা। তাই আজ আমরা একটি অভিশপ্ত (মালাউন) জাতির মত পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জাতি দিয়ে পরাজিত হচ্ছি, অপমানিত, লাঞ্ছিত হচ্ছি, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমাদের হাজারে হাজারে হত্যা করছে, আমাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আমাদের মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে, তাদের ধর্ষণ করে গর্ভবতী করছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না। সংখ্যায় একশ’ পঞ্চাশ কোটির বেশি হয়েও কিছুই করতে পারছি না, পড়ে পড়ে মার খাচ্ছি। আমাদের সাহায্যের জন্য কেউ নেই। আল্লাহও আমাদের সাহায্যের জন্য একটি আঙ্গুল তুলছেন না, কারণ আমরা তাঁর দেয়া দিক নির্দেশনার ঠিক বিপরীত দিকে চলেছি, তওহীদ ও জেহাদ ত্যাগ করেছি, তাঁর চোখে আমরা আর মো’মেনও নই, মুসলিমও নই, তাঁর রসুলের উম্মত তো দূরের কথা।

আর তার চেয়েও করুণ ও হাস্যকর হলো এই যে তবুও আমরা অতি নিষ্ঠার সাথে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ও তারাবি, তাহাজ্জুদ, দাড়ি, টুপি, মেছওয়াক নিয়ে ব্যস্ত আছি এবং ভাবছি আমরা অতি উৎকৃষ্ট মো’মেন তো বটেই, অতি উৎকৃষ্ট উম্মতে মোহাম্মদীও। আকিদা বিকৃত ও বিপরীত হয়ে যাবার ফলে এ কথা বুঝছি না যে এই সব এবাদতের পূর্বশর্ত (Pre-condition) হচ্ছে হেদায়াহ, তওহীদ; বুঝছি না যে ঐ হেদায়াতে নেই বলে, ঐ হেদায়াতের বিপরীত দিকে চলছি বলে আমাদের হাজারো এবাদত হাজারো তাক্ওয়া নিষ্ফল, তা কোনো কাজে আসবে না, আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। এই দুনিয়াতে আল্লাহ যেমন খ্রিষ্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধর (পৃথিবীর প্রধান সব ক’টি জাতি) হাতে আমাদের পরাজিত, অপমান, অপদস্থ, লাঞ্ছিত করছেন, ঠিক তেমনি আখেরাতেও তাঁর মালায়েকদের দিয়ে শাস্তি দেওয়াবেন এবং সে শাস্তি হবে এই দুনিয়ার শাস্তির চেয়ে বহুগুণ সাংঘাতিক, বহুগুণ ভয়ঙ্কর।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...