হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মণি-মাণিক্য পিঠে গাধার!

ডা. মাকসুদে মওলা

আমি শিয়া না সুন্নী জানতে পারলাম যখন আমি এইচ.এস.সি পড়তে ঢাকা আসি। জানলাম আমি সুন্নী ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। আর এটাই একমাত্র পথ জান্নাতে যাবার। সৌভাগ্য আমার আমার জন্মই হয়েছে মুক্তির পথে। তবে বুঝলাম না যে শিয়া কী জিনিস সুন্নী কী জিনিস। শুধু বুঝলাম শিয়া জিনিসটা কেমন নাপাক নাপাক, দাড়ি টুপি পাগড়ী সব আছে, তবু অশুচি। নামাজও পড়ে ৫ ওয়াক্ত তবু মুসলিম না। এমন ঘৃণা নিয়েই বেড়ে ওঠা আমার ও আমাদের। নিজের বিশ্বাসের অনুসারী ছাড়া কেউ জাতের না। ওদের যত দুর্ণাম গালমন্দ করা যায় তত ভাল, আর দুই এক ঘা দিতে পারলে তো বিরাট পুণ্যের কাজ।

তার পরেও কথা আছে। এই সুন্নীরা যে জান্নাতে যাবে, তাদের মধ্যে কোন ভাগ জান্নাতে যাবে? সুন্নীদের মধ্যেও তো দলাদলির শেষ নেই। জঙ্গি দলগুলোও নিজেদেরকে সুন্নী বলেই দাবি করে, হানাফি, হাম্বলি, মালেকি, শাফেয়ী সব মাজহাবের লোকেরাও সুন্নী বলে দাবি করে। আল্লাহ রসুল তো বলেছেন যে তাঁর জাতি অসংখ্য ভাবে বিভক্ত হবে যার একটি মাত্র ফেরকা জান্নাতে যাবে। সুন্নী হয়েও তাহলে কী লাভ হলো, আমি যে সেই জান্নাতী ফেরকার অনুসারী তা কীভাবে নিশ্চিত হলাম?
এতো গেলো দীনের সহীহ শুদ্ধতা নিয়ে নিজের ঈমানের ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। তার উপর আবার জমি জমা, দেনা পাওনা, চুরি ডাকাতি নানান দুনিয়াবী বিষয়ের মারামারি কাটাকাটি খুনাখুনি রক্তারক্তি সব চালু। এটা সব ধরনের, সব ধর্মের বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এক। আরো আছে রাজনীতিক মতবাদের ভিত্তিতে দলাদলি। মসজিদে গেলে সরকারী বিরোধী দলের সবাই একই ইমামের পিছনে নামাজ পড়ছে আর বাইরে এসেই একে অপরকে আক্রমণ করছে। তাহলে ধর্ম আমাদের কি শিক্ষা দিয়েছে?
আজ শিয়া-সুন্নির এই ভ্রাতৃঘাতী লড়াই পৃথিবীর মুসলিমদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। ইরাক ইরানের যুদ্ধ, কুর্দি আল কায়েদা যুদ্ধ, আইএসের নৃশংসতা, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ সর্বত্র এই অভিশাপ। নিজের বাঁচার জন্য শাপ বেজিতে বন্ধুত্ব হয়, মানুষে মানুষে হবে না?
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে শিয়াদের সংখ্যা খুবই নগণ্য, মাত্র ১০ লাখ। এখানে শিয়া সুন্নীদের মধ্যে আকিদাগত বিভেদ থাকলেও তা কখনো সহিংসতার রূপ নেয় নি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সেই দাঙ্গা বাংলাদেশেও ছড়িয়ে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র সম্প্রতি শুরু হয়েছে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোর এখন বড় ভূমিকা আছে যে তারা কি এই দাঙ্গাকে উসকে দেবে নাকি এর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে। শিয়াদের উপরে দুজায়গায় আক্রমণ হয়েছে, দু’জন খুন ও কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। এই হামলায় দায়ী করা হচ্ছে জে.এম.বি-কে যারা নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বলে মনে করে। অর্থাৎ সুন্নীরা শিয়াদেরকে হত্যা করছে এমন একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এদেশে শিয়ারা সংখ্যালঘু বিধায় প্রত্যাঘাত করার অবস্থানে নেই। যদি কোনোভাবে প্রত্যাঘাতের ঘটনা ঘটে তাহলে পানি ঘোলা হতে সময় লাগবে না, আর সেখানে মাছ শিকার করতে পরাশক্তিগুলোও বড়শি নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত।
ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে শিয়া সুন্নীর মধ্যে তেমন বৈপরীত্য নেই যেমন আল্লাহ, রসুল, কোর’আনে তারা উভয়েই বিশ্বাসী। কিছু দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসকে কেন্দ্র করে হাজার বছর ধরে এই বিভক্তিকে লালন করে যাচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা উভয়েই ভুলে গেছে যে ইসলামের লক্ষ্য কী, তাদের প্রকৃত এবাদত কী, উম্মতে মোহাম্মদী জাতিকে রসুলাল্লাহ কেন সৃষ্টি করেছিলেন, তার মানবজন্মের সার্থকতা কিসে? এখনও যদি তারা এই বোধ ফিরে পায় তাহলে তারা চূড়ান্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই হয়তো ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে। আরব বিশ্বের যাবতীয় সংঘাতের মূলে রয়েছে এই অন্তর্কলহ।
শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের উদ্দেশ্য। আর শান্তি থাকে ঐক্যের মধ্যে। সুতরাং ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন মতের মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা কোনো ধর্মের লক্ষ্য নয় বরং সকল মানুষকে এক পরিবারে পরিণত করার মধ্যেই ধর্ম নিহিত। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কোনো মতবাদেই তাত্ত্বিক অবস্থায় পূর্ণ আস্থা পোষণ করতে পারবে না, তারা ফল দেখেই আস্থা আনবে। মক্কায় এত প্রচারের পরও ঈমান আনে অল্প কজন। কিন্তু রসুলাল্লাহ ক্ষিপ্ত হন নি। কিন্তু মাদীনায় যখন তাঁর বক্তব্যের বাস্তবায়ন করে দেখালেন তখন মক্কার একদা শত্রুরা পর্যন্ত মদীনায় গিয়ে তাঁর জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মানুষ আসলে শান্তি চায় – যারা শান্তির উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে তারাই মানুষের হৃদয় জয় করতে পারবে। এ কারণেই ইসলাম কেবল তার ভৌগোলিক এলাকাই প্রসারিত করে নি, তার প্রতি ভালোবাসা মানুষের হৃদয়ে সহস্র বছর যাবৎ দৃঢ়মূল হয়ে আছে।
শর্ত পূরণ করুন। মানুষের মুক্তির কারণ হন। মানুষ আপনাকে মেনে নিবে। যারা পানিতে ডুবে মরছে তাদের কাছে বাঁচতে পারাটাই মুখ্য, কে বাঁচালো, তার ধর্ম পরিচয় কী, ফেরকা কী, মাজহাব কী তা বিচার্য হয় না। আজ পৃথিবীর করুণ হালে শেষ নবীর উম্মতের মধ্যে যাদের মগজ এখনো মলে পরিণত হয় নি, তাদের উচিত শিয়া সুন্নী বিভেদ ভুলে, হাত কোথায় বাঁধতে হবে তা নিয়ে বিতর্ক না করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তাদের কাছে মানবজাতির দাবি আছে, তারাও মানবজাতির কাছে দায়বদ্ধ। তারা যদি এগিয়ে না আসেন তো ধ্বংস তাদেরকেও ক্ষমা করবে না। আর পরকালীন মুক্তির আশা তো নিতান্তই হাস্যকর। নজরুল বলেছেন,

জীবন থাকিতে বাঁচিলি না তোরা,
মৃত্যুর পরে রবি বেঁচে
বেহেশতে গিয়ে বাদশার হালে,
আছিস দিব্যি মনে এঁচে।
হাসি আর শুনি!-ওরে দুর্ব্বল,
পৃথিবীতে যারা বাঁচিল না,
এই দুনিয়ার নেয়ামত হতে
নিজেরে করিল বঞ্চনা,
কেয়ামতে তারা ফল পাবে গিয়ে?
ঝুড়ি ঝুড়ি পাবে হুর-পরী?
পরীর ভোগের শরীরই ওদের!
দেখি শুনি আর হেসে মরি!
জুতো গুতো লাথি ঝাঁটা খেয়ে খেয়ে
আরামসে যার কাটিল দিন,
পৃষ্ঠ যাদের বারোয়ারী ঢাক
যে চাহে বাজায় তাধিন ধিন,
আপনারে সয়ে অপমান যারা
করে অপমান মানবতার,
অমূল্য প্রাণ বহিয়াই মলো
মণি-মাণিক্য পিঠে গাধার!
তারা যদি ম’রে বেহেশতে যায়,
সেই বেহেশত মজার ঠাঁই,
এই সব পশু রহিবে যথা, সে
চিড়িয়াখানার তুলনা নাই।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...