হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

বস্তুগত উন্নয়নের চাইতেও বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য

ডা. মো. মাকসুদে মওলা
মানুষের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার বাস্তবায়ন ও উন্নয়নের ধারণা থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। ভালো থাকার জন্য, একই পরিচয়ের মানুষগুলোর মতের মিলনে একটি ভৌগোলিক পরিচিতি এবং ভিনদেশী থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে নিজের শাসন নিজে করার প্রয়াসেই রাষ্ট্রের পথচলা শুরু হয়। আমাদের বাংলাদেশের জন্মও হয় এই বোধ থেকে। বৈষম্য ও অধিকার হননের বিরুদ্ধে তুমুল সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করে ঐক্যচেতনায় ভরপুর সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। পক্ষান্তরে যে মুষ্ঠিমেয় ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ দেশের অভ্যুদয়ের পথে বাঁধ দিতে চেয়েছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবল স্রোতের বিপরীতে তারা ক্ষণিকের জন্যও টিকতে পারেনি, শোলার মত ভেসে গেছে। ঐ যোদ্ধারা, ঐ সংগ্রামী দামাল ছেলেরা- যাদের পরনে যথেষ্ট কাপড় ছিল না, পেটে ভাত ছিল না, হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিল না, প্রশিক্ষণ ছিল না, তবু বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনল শুধুই জাতীয় ঐক্যের চেতনায়। কিন্তু এ কি দুর্ভাগ্য! সেই সোনার দেশটি এখন ‘বিভক্তি’ ‘বিচ্ছিন্নতা’ ‘হানাহানি’ ‘দলাদলি’ আর ‘কোন্দলে’ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে, আর তার জন্য অন্যতম দায়ী আমাদের বিভেদমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা। সুদীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসা গণতন্ত্রের নামে একটি যুক্তিহীন বিরক্তিকরণ প্রক্রিয়া আমাদের মধ্যে চলমান রয়েছে, যা এই জাতির প্রাণশক্তি অর্থাৎ ঐক্যের চেতনাকেই বিনাশ করে দিয়েছে।  আজ জাতিসত্তা কেবলই পতাকা আর মানচিত্রে সীমাবদ্ধ! দেশের উন্নতি হচ্ছে। সত্তরের দশকের সেই দুর্ভিক্ষপ্রবণ দেশটি আজ অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে- অর্থনীতির মানদণ্ডে আমরা নাকি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছি। সড়ক যোগাযোগ থেকে শুরু করে আইসিটি, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ খাতে দেশ বহুদূর এগিয়েছে। প্রত্যেক সরকারই উন্নয়ন করেছে, কম আর বেশি। চলছে তার ধারাবাহিকতা। কিন্তু এই উন্নয়নেরই অপরপিঠে দগদগে ‘ঘা’ এর মত বিভৎস একটি চিত্র ভেসে ওঠে, সেটা জাতির রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভক্তি। গণতন্ত্রের নামে হানাহানি, রক্তপাত ও সীমাহীন শত্রুতার চর্চা জাতির সমস্ত অর্জনকেই ম্লান করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।
গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ বুঝতে খুব পণ্ডিত হবার দরকার নেই। সরল কথায় বিষয়টা হচ্ছে, দেশের শাসনপ্রণালীতে যেন জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটে। শাসক তার ইচ্ছেমত শাসন করবে, আর জনগণ কেবল খাজনা দিয়ে যাবে- এমনটা না হয়ে জনগণও যেন শাসনব্যবস্থার সাথে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। সেজন্যই একটি শাসনব্যবস্থার জন্ম দেওয়া হয়েছে যেখানে জনগণ তাদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাবে এবং সরকারও নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ না করে জনগণের মর্জিমাফিক শাসনকার্য পরিচালনা করবে। এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা, মূল শক্তি। মানুষের সম্মান ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেন আজ ‘কেতাবে আছে গোয়ালে নাই’!
একটি তত্ত্ব যত সুন্দরই হোক, একটি ব্যবস্থা কাগজে-কলমে যত নিখুঁতই হোক, প্রয়োগের পর যদি দেখা যায় তা কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণের কারণ হচ্ছে, জাতিসত্ত্বার প্রাণশক্তি ‘ঐক্য’ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, জাতিটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে এবং প্রত্যেক খণ্ড একে অপরের সাথে রক্তক্ষয়ী কোন্দলে লিপ্ত হয়ে পড়ছে তাহলে সেই ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যুক্তিসঙ্গত হয়ে পড়ে। অনেকে হয়ত বলবেন এই ব্যবস্থা দিয়েই তো আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পেরেছি। হ্যাঁ, পেরেছি, তবে জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন যা হয়েছে তা আরও বহুগুণ বেশি হতে পারত যদি জাতির মধ্যে কোনো অনৈক্য-রক্তারক্তি না থাকত, জাতি বহুখণ্ডে বিভক্ত হয়ে একে অপরের ক্ষতির প্রয়াসে লিপ্ত না থেকে সবাই মিলে ‘এক জাতি এক দেশ- ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ’ এই চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারত। সেই ঐক্যচেতনা জাগ্রত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন এখন আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...