হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যা

Untitled-2
রিয়াদুল হাসান

এটি দুঃখজনক বিষয় যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কি ইসলামের চেতনার পক্ষে হয়েছে না বিপক্ষে হয়েছে– এ প্রশ্নের সমাধান আজও হয় নি। অধিকাংশ আলেম মনে করেন ইসলামের চেতনার বিরুদ্ধে হয়েছে, অন্যরা মনে করেন এর সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এ প্রশ্নটি নিয়ে ৪৪ বছর পরও রাজনীতি ও ধর্মব্যবসা দুটোই চলমান আছে। আমরা যতই একাত্তরের চেতনা নিয়ে আবেগ প্রদর্শন করি না কেন, ধর্মের প্রশ্নে এসে সেই আবেগ, জাতীয় ঐক্য দেশপ্রেম দ্বিধাবিভক্ত ও পরাজিত হতে বাধ্য। তাই এ প্রশ্নের সমাধান হওয়াটা জরুরি।
উত্তরবঙ্গের জনৈক পুলিশ সুপার হেযবুত তওহীদের একজন সদস্যকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা একাত্তর সাল (মুক্তিযুদ্ধ) স্বীকার করেন কিনা? আবার এক জায়গায় জিজ্ঞাসা করা হয়, একাত্তর সালে বাংলাদেশের কয়জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল বলে মনে করেন? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন আরও অনেক প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয়েছে আমাদের। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা নাম দিয়ে যে বিতর্ক ও বিভক্তি বছরের পর বছর জিইয়ে আছে, তা কারা কী উদ্দেশ্যে জিইয়ে রেখেছে সেটাই এক দুর্বোধ্য বিষয়।
এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন যারা অবিশ্রান্ত প্রচারণা চালিয়ে একটি মতবাদ প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন যে, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ধর্মের বিরুদ্ধে, বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে। অতঃপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইসলামপন্থীরা পরাজিত হয় আর ধর্মবিরোধীদের উত্থান ঘটে।’ যারা এই প্রচারণায় প্রভাবিত তারা যখন হেযবুত তওহীদকে ধর্মের কথা বলতে শোনেন, ইসলামের কথা বলতে শোনেন, তাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, হেযবুত তওহীদ মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে কিনা। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি ’৭১ এর যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে হয় নি, ধর্মের বিরুদ্ধে হয় নি, যুদ্ধ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়, অবিচার, যুলুম, বঞ্চনা, শোষণ ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে। এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন, তারা কেউই বলেন না যে, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। আসলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ন্যায়, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, নিজেদের অধিকার আদায় করতে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা ধর্মকে অপরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো, ধর্মের নাম করে অধর্ম করতো, বাঙালিরা লড়েছে সেই অধর্মের বিরুদ্ধে। সুতরাং ন্যায়, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইকে হেযবুত তওহীদ অস্বীকার করতে পারে না, কেননা হেযবুত তওহীদের সদস্যরা পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসলামের আলোকে স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে বিবেচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদেরকে দেখতে হবে এ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটটা কী। ইতিহাস যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে বর্তমানকে উপলব্ধি করতে পারব না, আমার ভবিষ্যৎ গন্তব্যও বিভ্রান্তিময় হবে।
এ উপমহাদেশ দু’শ বছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। পুরো ভারতবর্ষকে শোষণ করতে করতে তারা সমৃদ্ধ হয়েছে, আর আমাদেরকে নিঃস্ব ভিখারি বানিয়েছে। তারা এখানে হিন্দু-মুসলিম শত্র“তা ও দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। এভাবে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে দুটি মেরু সৃষ্টি করেছিল সেই ব্রিটিশরাই যারা নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষতার অবতার মনে করে। তারাই বানিয়েছিল কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। এভাবে উপমহাদেশে তারা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতেই তারা ভারতবর্ষের মানচিত্রে দেশবিভাগ ঘটিয়েছে- হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান। এ ছিল এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র যার ফলে এই উপমহাদেশে আজও বিরাজ করছে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় শত্রুতার সম্পর্ক।
দেশবিভাগের সময় পাকিস্তানের নেতারা দাবি করলেন যে, পাকিস্তান হবে ইসলামী রাষ্ট্র, নাম দিল Islamic Republic of Pakistan, কিন্তু বাস্তবে তারা কী করলেন? তারা আল্লাহর সাথে, ঈমানদার মানুষের সাথে ও মানবতার সাথে গাদ্দারি করে ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দিলেন পূর্বতন ভাইসরয়দের মতোই। পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ বানিয়ে ব্রিটিশদের মতই শোষণ করতে লাগলেন। এ দেশের মানুষকে তারা মানুষই মনে করলেন না, এদের ভাষাকেও তারা পরিবর্তন করে দিতে চাইলেন। এভাবে চব্বিশটি বছর বঞ্চনার শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকগণ, যাদের অধিকাংশই পাকিস্তানিদের মতই মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। এই বঞ্চিত মানুষগুলোর মনে ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। অত্যাচারিত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে সেখানে শক্তির বিস্ফোরণ হয় এটাই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। কাজেই পাকিস্তানি শাসকদের ধর্মের নামে প্রতারণা, সামরিক শাসন, অবিচার, অত্যাচারের চূড়ান্ত পরিণতিই একাত্তরের যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কোনো উপায় ছিল না। রাজনৈতিকভাবে বহু সমাধানের চেষ্টা করেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে থেকে কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায় নি। বঙ্গবন্ধু ’৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু সেই বিজয়কে অস্বীকার করা হয়েছিল। উপরন্তু ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিত হামলা করে নির্মমভাগে কথিত ‘মুসলিম’ ভাইদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সুতরাং আত্মরক্ষার প্রশ্নেও যুদ্ধ সর্ববিধানে বৈধতা পায়। আর অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে পড়ে পড়ে মার খাওয়াকে কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না।
তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান – হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত এই দুটি ভূখণ্ড কোনোভাবেই একসাথে চলতে পারত না। ভাষা, পোশাক, আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি সব দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান ছিল পৃথক। একটি মাত্র ঐক্যসূত্র হতে পারত ধর্ম। কিন্তু প্রকৃত ইসলাম তো হারিয়েই গেছে ১৩০০ বছর পূর্বেই। তথাপি যে ইসলামের ধুয়া তুলে তারা সাতচল্লিশে ভাগ হলো সেই চেতনাকেই কবর দিয়ে, একমাত্র ঐক্যসূত্রকে ছিঁড়ে ফেলে ব্রিটিশদের মতো ঔপনিবেশিক শাসননীতি চালিয়ে পাকিস্তান কী করে এই দেশকে নিজেদের আয়ত্ব রাখতে পারত? অধিকন্তু দেশটি যখন পাকিস্তানের বৈরী দেশ ভারতের পেটের ভেতরে, তখন এই বিচ্ছিন্নতা ৭১ সালে হোক আর তার পরেই হোক, সেটা হতোই। এটা বুঝেই তারা যতটুকু পেরেছে এদেশটিকে ধ্বংস করেছে, এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে।
এই বাস্তবতাকে যারা অস্বীকার করবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। মনে রাখতে হবে যারা অন্যায় করে, অন্যের অধিকার কেড়ে নেয়, যুলুম করে তারা কখনও মুসলিম হতে পারে না। তারা যতই নামাজ পড়–ক, রোজা রাখুক, হজ্ব করুক, কোনো মুসলিম তাদেরকে ভাই বলে গণ্য করতে পারে না। তাদের একটাই পরিচয় তারা ইসলামের শত্রু, আল্লাহর শত্রু, লেবাস-সুরত তাদের যেমনই হোক। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা এ দেশের মুসলিমদেরকেও যে ভাই মনে করতো না তার প্রমাণ তারা নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে দিয়েছে। ভাই কখনও ভাইয়ের বুকে গুলি চালাতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতেও যারা ধর্মের অজুহাতে মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তারা ধর্মান্ধ ছাড়া কিছু নয়। আবার যারা একাত্তরকে অবলম্বন করে ধর্মবিদ্বেষী চেতনার বিস্তার ঘটাচ্ছে নিঃসন্দেহে তারাও দেশবাসীর সাথে প্রতারণা করছে। আমরা এই ধর্মান্ধতা ও ধর্মবিদ্বেষ উভয়কেই পরিত্যাজ্য মনে করি।
একইভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে আমাদের মতামত জানতে চান তাদেরকে বুঝতে হবে যুদ্ধে তিরিশ লক্ষ নিহত হোক কিংবা তিনজন নিহত হোক, অন্যায়ভাবে একজন মানুষ হত্যা করাও ভয়াবহ অপরাধ। আল্লাহর দৃষ্টিতে একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করার সমান। অন্যায় অন্যায়ই, তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে বলে অন্যায়কারী হবে, একজন মানুষকে হত্যা করলে অন্যায়কারীর লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পাবে তেমনটা মনে করার কারণ নেই। সুতরাং মৃতের সংখ্যা নিয়ে অহেতুক বিতর্কে যেতে আমরা রাজি নই।
এখন আমাদের কথা হলো- আমাদের স্বাধীনতাকামী নেতৃবৃন্দ বহু কষ্ট করে, বহু ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে দেশকে শত্র“মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু কেন করেছিলেন সেটাই এখন মুখ্য বিষয়। তারা চেয়েছিলেন একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, বঞ্চনাহীন একটি শান্তিময় জীবন এ জাতিকে উপহার দিতে, সেটা আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারলাম। নাকি আজও আমরা সেই আগের মতোই কেঁদে চলেছি, নাকি অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ? এ প্রশ্নের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার সফলতা-ব্যর্থতার জবাব রয়েছে।
সত্য হচ্ছে স্বাধীনতার যুদ্ধ যে স্বপ্ন নিয়ে সেটার বাস্তবায়ন আমরা ৪৪ বছরেও দেখতে পাচ্ছি না। সেটা বাস্তবায়ন করাই আমাদের কাজ, শুধু স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে গলাবাজি, রাজনীতি আর ব্যবসা করে দিনপার করলে চলবে না। জাতি আজ বহুধাবিভক্ত, ক্ষয়িষ্ণু, শক্তিহীন, ভঙ্গুর। তাদেরকে কেউ ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে নি বিগত ৪৪ বছরে। ফলে উন্নয়ন অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক পা এগোলে আমরা দশ পা পিছিয়েছি, আগে গরিবের টাকা শোষণ করত পাকিস্তানী বুর্জোয়ারা, আর এখন করছে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদেরা, আমলা ও পুঁজিবাদী বুর্জোয়ারা। সুতরাং অন্যায়, অবিচার, শোষণের অবসান এখনো হয় নি। ’৭১ সলে সেই বুর্জোয় শোষকদের বিরুদ্ধে বঞ্চিত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করলেন বঙ্গবন্ধু। এখন বর্তমানের এই বঞ্চিত, নিপীড়িত জনতাকে ধান্ধাবাজ রাজনীতিক ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কে ঐক্যবদ্ধ করবে? সেই কাজটিই করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ।
এখন একটাই কাজ, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কীসে কীসে অতীতে ঐক্যভঙ্গ করেছে সেগুলোর খতিয়ান নিয়ে তা পরিহার করতে হবে। আমরা দেখেছি এ জাতি সবচেয়ে বেশি বিভক্ত হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে অপরাজনীতিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা, রাজনীতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই আজও এ জাতিকে পিষে যাচ্ছে। এগুলো দূর করতে প্রয়োজন জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, একাত্তর ছিল বাঙালির জন্য আশীর্বাদ ও শিক্ষা, কারণ একাত্তর আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সেই ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিয়ে আমরা যদি একাত্তরের আশীর্বাদকে কাজে লাগাতে না পারি তাহলে মুক্তিযুদ্ধ অপূর্ণাঙ্গ ও ব্যর্থ হয়ে যাবে। এখন আমাদের দেশকে আসন্ন সঙ্কট থেকে মুক্ত করতে হলে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্ত্বা গঠন করতে হবে। এমতাবস্থায়, ১৬ কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তেমন ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়নিষ্ঠ জাতিসত্ত্বা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই কাজ করছে হেযবুত তওহীদ। আমাদের অবস্থান মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করা না করা কিংবা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্কের অনেক ঊর্ধ্বে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...