হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রকৃত ইসলামে নারীদের স্বাধীনতা

মুস্তাফিজ শিহাব
ইসলাম নারীকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে সে স্বাধীনতা তৎকালীন আরবে চিন্তাও করা যেত না। তৎকালীন আরব, যেখানে কন্যা সন্তান জন্ম হলে পিতা-মাতার মুখ কালো হয়ে যেত, বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর মতামতের কোনো গুরুত্ব ছিল না, নারীর অধিকার নিয়ে কেউ চিন্তা করত না, পরিবারে নারী পরিণত হয়েছিল নিগৃহীত বস্তুতে। সমাজের জন্য নারী ছিল ভোগ বিলাসের উপকরণ বৈ আর কিছুই নয়। সে সমাজে এসে রসুল যে ইসলামের বাণী প্রচার করেছেন তা বর্তমানের চিন্তাশীলদের মগজে আঘাত হানতে যথেষ্ঠ। ইসলাম নারীকে শালীনতার চাদরে মুড়ে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করায়। ইসলাম নারীকে তার প্রকৃত সত্ত্বা চিনতে সহায়তা করে।
বর্তমানে নারীদের যে বেহাল দশা তার পিছনে অন্যতম কারণ হলো তারা ইসলামের সঠিক রূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। আমাদের সমাজের ধর্মব্যবসায়ী আলেম সমাজ তাদের ইসলামের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে, অজ্ঞতার কারণে বা নিজেদের স্বার্থের জন্য, ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা যে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় তা তাদের উপলব্ধিতে আসা অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায় তারা পাশ্চাত্যের অশ্লিলতায় নিমজ্জিত দাজ্জালীয় সভ্যতাকে অনুকরণের যে প্রচেষ্টা শুরু করেছে তাতে তারা স্বাধীনতা তো লাভ করবেই না বরং দাজ্জালীয় সভ্যতার স্বাধীনতা নামক অশ্লিতাকে গ্রহণ করে তারা তাদের প্রকৃত সম্মান নষ্ট করবে। তাই অবিলম্বে তাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত রূপ তুলে ধরতে হবে।
এখনও আমাদের সমাজে ধর্মীয় গোড়া একদল পাওয়া যায় যারা নারীকে বস্তাবন্দী করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ঐদিন আমার পরিচিত একজনের পোস্টে একটি কমেন্ট দেখলাম যেখানে এক লোক নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে মন্তব্য করেছে, ‘নারী স্বাধীনতা মানেই নারীর ধ্বংস’। বিষয়টি দেখে আমি যারপরনাই ব্যাথিত ও শঙ্কিত হলাম। ইসলামের ধারক বাহক হিসেবে যারা আমাদের সমাজে পরিচিত তারা যদি এ ধরনের ধারণা পোষণ করে ও এ ধরনের মন্তব্য করে তবে সেখানে আর কিইবা বলার থাকে। যে নারীকে ইসলাম স্বাধীনতা দিয়েছে তাদের সেই স্বাধীনতাই হরণ করছে আজকের এ সকল অতিপ-িত ধর্মব্যবসায়ী আলেম। কিন্তু আল্লাহর রসুলের জীবনী থেকে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় দেখি।
মদীনা তখন ইসলামের অভয়ারণ্য। আল্লাহর রসুল মদিনার একচ্ছত্র অধিপতি। মদিনার নারীরা তখন আল্লাহর রসুলের কাছে আসতেন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান জানার জন্য। রসুল ছাড়া তারা উম্মুল মুমিনিনদের কাছেও আসতেন তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে। তো একবার এক নারী এলেন উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) এর কাছে। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি তার বেদনার কথা কাঁদতে কাঁদতে আয়েশাকে (রা.) বলতে লাগলেন, ‘আমার স্বামী আমার সঙ্গে স্বামী সুলভ আচরণ করেন না, আাবার আমাকের তালাকও দেন না। আমি যেন তার কাছে একটি খেলনা ছাড়া আর কিছুই নই। তিনি যখন ইচ্ছা আমাকে তালাক দেন আবার ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই এসে বলেন তিনি তার মন পরিবর্তন করেছেন। আবার আমাকে নিয়ে ঘর সংসার শুরু করেন। কিন্তু তখনো তিনি আমার সঙ্গে স্বামী সুলভ আচরণ করেন না। কিছুদিন পর আবার তালাক দেন। এভাবে বার বার তিনি আমার ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।’ এ ঘটনা শুনার পর উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) রসুলের ঘরে আসার অপেক্ষা করলেন এবং রসুল যখন ঘরে এলো তখন তিনি রসুলের সামনে বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্ত তখন পর্যন্ত আরবে নিয়ম ছিল যে ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে যদি স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেন তবে তালাক হবে না। রসুল এ ঘটনা শুনে অপেক্ষা করলেন এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই তাঁর উপর ওহী নাযিল হল। সুরা বাকার ২২৯ নম্বর আয়াত নাযিল হলো এবং বিধান দেয়া হলো যে, তালাকে রজয়ি দুবার। তারপর হয় নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীকে রাখবে নয়ত সহৃদয়তার সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছেদ করবে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আল্লাহ নারীর অধিকারের ব্যাপারে বিধান দিয়েছেন। তিনি ভারসাম্য রেখে বিধান নাযিল করলেন যাতে নারীদের অধিকার বজায় থাকে। ইসলাম আগমনের পূর্বে একজন নারীর ক্ষেত্রে এ বিষয়ে কারো কাছে সমাধান চাওয়া যেমন ছিল অসম্ভব বিষয় তেমনি সমাধান পাবে এ আশাও ছিল দুস্কর। কিন্তু ইসলামের পরশে এসে নারী তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সে তার অধিকার আদায়েও সচেষ্ট হয়।
অপর আর একটি ঘটনা আমি এখানে উদ্বৃত করছি। একদিন এক তরুণী আম্মা আয়েশার কাছে এলেন। তার মন ভারাক্রান্ত, মুখে হাসি নেই। আম্মা আয়েশা তার কাছে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘তার পিতা তার মতের বিরুদ্ধে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। এ বিয়েতে আমার মত নেই।’ মনের দুঃখে বললেও তখনো আরবে বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হতো না। পিতা বা অভিভাবকের ইচ্ছায় তাকে বিবাহ করতে হতো। তরুণীর মন খারাপ দেখে আয়েশা (রা.) তাকে রসুল ঘরে ফিরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি তাকে অপেক্ষা করার মূল কারণই হচ্ছে রসুলের সাথে থেকে থেকে প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ঠ ধারণা হয়েছিল। ইসলাম যেহেতু কারো উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নয় সেহেতু এ ক্ষেত্রেও অবশ্যই যথাযথ কোন সমাধান থাকবে। কিছুক্ষণ পর রসুল যখন ফিরে আসলেন তখন তিনি রসুলকে বিষয়টি অবহিত করেন। ঘটনাটি শুনে আল্লাহর রসুল আর দেরি করলেন না। তিনি তখনই সেই তরণীর পিতাকে ডেকে পাঠালেন এবং সেই ঘটনা বর্ণনা করলে তরুণীর পিতা নিজের ভুল স্বীকার করলেন এবং তার মেয়ের অমতে তাকে বিয়ে দিবেন না এ কথাও বললেন। রসুল এরপর ঘোষণা করলেন, “বিয়ের ব্যাপারে কুমারী মেয়েদের কাছ থেকে মৌখিক সম্মতি নিতে হবে, আর বিয়ের কন্যা যদি বিধবা হয়, তবে তাদের মৌখিক স্বীকরোক্তি নেয়া অত্যাবশ্যক।” এ ঘোষণা শুনে আয়েশা (রা.) বললেন যে মুখ ফুটে একজন কুমারীর জন্য নিজের বিয়ের সম্মাতি জ্ঞাপন বেশ কঠিন কাজ। তখন আল্লাহর রসুল বললেন যে কুমারী কন্যার নিরবতাই তার সম্মাতি ধরে নেয়া হবে। বতর্মান সময়ে এ ঘটনা স্বাভাবিক মনে হলেও তৎকালীন আরবে এ এক যুগান্তকারী বিপ্লব। রসুল সেই তরুণীকে বিবাহের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করলেন। তরুণী এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলে এক অচিন্তনীয় কাজ করল। সে তার পিতার ঠিক করা পাত্রের সাথে বিবাহে রাজি হয়ে গেল। তরুণীটি রসুলের কাছে এসেছিলেন এই বিষয় নিশ্চিত করতে যাতে পরবর্তী সময়ে আর কোনো মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রেই তাদের পিতা বা অভিভাবক জোর করতে না পারে।
এই দুটো ঘটনার মতেই আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবদের জীবনীতে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেখান থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে ইসলাম নারীকে পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা দান করেছে। তাই আমাদের উচিত ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ বর্তমান সমাজের সামনে তুলে ধরা এবং এর ফলে আমাদের নারীরা ইসলাম কী তা বুঝতে পারবে ও তাদের হারানো সম্মান অর্জনে সচেষ্ট হবে।

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook /glasnikmira13)

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...