হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মের অপব্যবহার প্রগতির অন্তরায়

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
ধর্ম। এই একটি শব্দ আজকে সমগ্র বিশ্বপরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আজকে এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি যখন পৃথিবীময় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। এই মুহূর্তে ষোলো হাজার এটমবোম প্রস্তুত। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলি অস্ত্রের বাজার সৃষ্টি করার জন্য একটার পর একটা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা মানবসভ্যতাকে নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছে। এই আগ্রাসন ও ধ্বংসলীলার বাহন হিসাবে তারা নিয়েছে ধর্মকে। যার ফলে মানবজাতি আজ একটি কঠিন সংকটের মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তে সীমান্তে সংঘর্ষ রক্তপাত, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ লাগার উপক্রম হয়েছে। পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের পরিচালকগণ একে অপরের বিরুদ্ধে হুমকির ভাষায়, অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছেন। কেউ কাউকে সম্মান বা সমীহ করে কথা বলছেন না। বর্তমান বিশ্বের প্রধান বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী সচেতন মানুষেরা সকলেই আশঙ্কা করছেন যে এইবার পারমাণবিক মারণাস্ত্রের যুগে যদি বিশ্বযুদ্ধ লাগে তাহলে বিনাশ হয়ে যেতে পারে গোটা মানবজাতি। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত এটমবোমের ক্ষত এখনও শুকায় নাই। এইবার যদি যুদ্ধ লাগে, পুরো মানবজাতি বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে এই বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশ সম্পৃক্ত কীভাবে। বস্তুত সারা পৃথিবী এখন একটি গ্রামের মত, পৃথিবীকে বলা হচ্ছে গেøাবাল ভিলেজ। বিভিন্নভাবে একটি দেশ আরেকটি দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমার এই জন্মভূমি বাংলাদেশ- যে বাংলার মাটিতে আমি সেজদা করি, যে বাংলার মাটিতে আমার পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, যে বাংলার আলোবাতাসে আমি বড় হয়েছি, সেই বাংলাদেশকে নিয়েও ষড়যন্ত্রও চলছে। এখানে গত ৪৬ বছর ধরে ধর্মকে অপব্যবহার করে একদল লোক স্বার্থ উদ্ধার করেছে, ধর্ম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছে, অথচ ইসলামের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ আল্লাহ হারাম করেছেন। আরেক দল অপরাজনীতি করেছেন, জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন। আরেকদল লোক সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটিয়ে আল্লাহ, রসুলের নামে, কেতাবের নামে চালিয়ে দিয়েছে। মাঝখানে বদনাম হয়েছে ধর্মের, বদনাম হয়েছে মুসলমানের, বদনাম হয়েছে কেতাবের এবং আল্লাহ রসুলের। এখন এই ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যদি পুরো ষোলো কোটি বাঙ্গালী যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি তাহলে আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও ইরাক সিরিয়া আফগানিস্তানের মত হতে পারে। এখন জোরেসোরে সেই পায়তারা চলছে। এজন্যই আমরা হেযবুত তওহীদের সদস্যরা সারা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছি। আমরা ঐ ধর্মান্ধদের, ঐ কূপমণ্ডূকদের, ঐ বিজ্ঞান বিরোধীদের যারা ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যবসা করে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করতে চায় আমরা বার বার তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, তাদের রোষানলে পড়েছি। আমার বাড়িতেই হামলা হয়েছে এ পর্যন্ত চারবার, আমাকে হত্যার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু আমরা বলেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের এ সংগ্রাম চলছে-চলবে। আমাদের দেশের সরকার শক্তি প্রয়োগ করে সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা সেই ২০০৯ সন থেকে লিখিত মৌখিক সর্ব উপায়ে প্রস্তাব দিয়ে আসছি যে, শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে হবে না, একটি মতবাদগত সন্ত্রাস নির্মূলে পাল্টা একটি আদর্শ লাগবে যা দিয়ে ঐ মতবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে হবে। ইসলামের অপব্যাখ্যার বিপরীতে সঠিক ব্যাখ্যাটি জনগণকে বুঝাতে হবে, তাদের সামনে প্রমাণ দিতে হবে যে, এই পথ ভুল, এই পথে কেউ আল্লাহকেও পাবে না রসুলকেও পাবে না। যে পথে মানবতা বিধ্বংস হয়, মানুষের ক্ষতি হয় সেই পথ কখনও ধর্মের পথ নয়। সেই সঠিক ব্যাখ্যা, সঠিক আদর্শ আমাদের কাছে আছে যা দিয়ে আমরা জাতির এই সংকট দূরীকরণে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। আমরা সভা করে সেমিনার করে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পর্যন্ত সর্বত্র আমরা প্রস্তাবনা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করি জনগণ একদিন এটা বুঝে সোচ্চার হবে।
আমরা ভীষণভাবে চাই আজকের এই জনগণকে নিয়ে একটা জাগরণের সৃষ্টি করতে হবে। যেটার নাম হচ্ছে রেনেসাঁ। কখন একটি জাতির মধ্যে রেনেসাঁর প্রয়োজন হয়, নবজাগরণের কখন দরকার হয়? একটা সমাজ যখন স্থবির হয়ে যায়, মানুষ যখন শক্তিমানের অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তারা মুক্তভাবে কথা বলতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না, পদে পদে তাদেরকে ফতোয়াবাজিসহ নানাবিধ ভয়ভীতির দ্বারা বাধাগ্রস্ত করা হয়, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, পছন্দনীয় সংস্কৃতি লালনের সুযোগ থাকে না, কোনো বিশ্বাসকে ধারণ করার অধিকার থাকে না, তখন সমাজ মাকড়শার জালে আটক পতঙ্গের মত ধর্মান্ধতার অচলায়তনের মধ্যে পড়ে মুক্তির জন্য ত্রাহী স্বরে কাঁদতে থাকে। তখন একদল চিন্তাশীল আলোকপ্রাপ্ত মানুষকে এগিয়ে আসতে হয় ঐ দেওয়ালকে ভেঙে মানুষের জন্য সমস্ত দুনিয়াকে উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য।
আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে ইউরোপে যখন এক দিকে সামন্ত প্রভুরা অর্থনীতিকে কুক্ষিগত করেছে, অপরদিকে চলছে ধর্মযাজকদের ফতোয়াবাজির অত্যাচার, তখন মানবতা ডুকরে কাঁদছিল। বিজ্ঞান স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন এ অবস্থা থেকে মানবজাতিকে মুক্তির জন্য নাট্যকাররা নাটক লিখলেন, কবিরা কবিতা লিখলেন, অভিনেতারা অভিনয় করলেন, বক্তারা বক্তব্য দিতে লাগলেন, তখন শুরু হলো এক রেনেসাঁ। সেই রেনেসার ফল আজকের এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, প্রগতি ও প্রযুক্তি। কিন্তু সেই ভারসাম্যহীন রেনেসাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তের কোটি বনি আদম নিহত হওয়ার মাধ্যমে, প্রযুক্তিকে মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মাধ্যমে।
এখন প্রয়োজন আরেকটি রেনেসাঁর। কারণ এখন দুনিয়ার মানুষ আবার এটম বোমার কাছে পরাজয় স্বীকার করেছে, আবারও এসেছে মাইট ইজ রাইটের যুগ। এখানে ন্যায় অন্যায়ের কোনো বিবেচনা করা হয় না, এখানে চলছে ন্যায়ের উপর অন্যায়ের বিজয়, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, শাসিতের উপর শাসকের জুলুম। সমগ্র দুনিয়া আজ যেন নরককূণ্ড। এই নরককূণ্ড থেকে বাঁচার জন্য একদল আলোকময় মানুষকে আজ এগিয়ে আসতে হবে। এটার নাম হলো বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম আমরা শুরু করেছি, রেনেসাঁও শুরু হয়ে গিয়েছে।
আজকে যারা ধর্মের নামে মুক্তচিন্তার বিরোধিতা করেন, বিজ্ঞানচর্চার বিরোধিতা করেন তারা কোন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান আমি জানি না। আমি তো জানি পবিত্র কোর’আনের প্রথম আয়াতটিই হচ্ছে “ইক্বরা বিসমি রাব্বি কাল্লাজি খালাক্ব”- পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। রসুলাল্লাহ বললেন, “আমি তো পড়তে জানি না।” আবার বলা হলো, “পড়ো”। তিনি বলেছিলেন, “আমি তো পড়তে জানি না।” আবার বলা হয়েছিল, “পড়ো”। তিনি আবারো বলেছিলেন, “আমি তো পড়তে জানি না।”
আমার প্রশ্ন, আল্লাহ কি জানতেন না যে তিনি পড়তে পারেন না? তাহলে কেন তাকে পড়তে বলা হলো? এর কারণ আমি বলছি। আরব সমাজের নাম ছিল আইয়্যামে জাহেলিয়াত, গোটা সমাজ অন্যায় অবিচার জুলুম রক্তপাত ইত্যাদিতে নিমজ্জিত ছিল, মেয়ে মানুষের কোনো মর্যাদা বা অধিকার ছিল না, পেটে খাবার ছিল না, পরনে পোশাক ছিল না। শুধু ছিল দাসত্ব আর দাসত্ব। এই জাহেলিয়াতকে ভাঙার জন্য আল্লাহর রসুলকে দিয়ে আল্লাহ বলালেন, “পড়ো।” পড়ো মানে জানো। শুরু হলো আরব জাতি জানতে, বুঝতে ও দেখতে শুরু করল। কয়েক বছরের মধ্যে গোটা জাতির রূপ পাল্টে গেল, শুরু হলো রেনেসাঁ। যারা কাঠ পাথরের মূর্তির সামনে মাথা নত করে থাকতো তারা মহাকাশ গবেষণায় বুৎপত্তি লাভ করল। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে তখন তারা সকল জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন হলো।
সেই ধর্মের অনুসারীরা কী করে এত কূপমণ্ডূক, এত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রবণ, এত যুক্তিবোধহীন, এত কথিত পুরুষতান্ত্রিক হলো? কী করে তারা আবার নারীদেরকে বাক্সবন্দী করল, তাদের অধিকার কেড়ে ভুলুন্ঠিত করল? কোন কোর’আনে তারা পেল যে গান শুনবে না, ফটো তুলবে না, অভিনয় করবে না, ছবি আঁকবে না? এই ইসলাম তারা কোথায় পেল? এগুলো কে হারাম করল? আল্লাহ তো হারাম করেছেন শুধু অশ্লীলতা আর শেরক (সুরা আরাফ ৩৩)। এসব জায়েজ নাজায়েজের হাজারো ফাতোয় আবিষ্কার করে সেগুলো তারা মুসলিম জাতির উপরে চাপিয়ে দিল। আর এসব মাসলা মাসায়েল নিয়ে গোটা জাতি শিয়া সুন্নী, হানাফি-হাম্বলী ইত্যাদি হাজারো মাজহাব ফেরকা তরিকায় বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি করে আজকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আজ ধর্মের নামে প্রচলিত এই সকল ক‚পমЂকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আমাদের এই সংগ্রাম। এ কাজে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই, কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই, অন্য কোনো অভিপ্রায় নেই। আমরা হাজারবার আক্রান্ত হয়েও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করি নি। আমরা সত্য প্রকাশ করছি বলে আমারা নিরাপদ নেই, এর নামই স্থবিরতা, এর নামই অন্ধত্ব। মানবজাতি যখন এই স্থবিরতার মধ্যে এসে দাঁড়ায় তখন মানুষের মৃত্যু হয়। মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। মানুষ যখন চিন্তা করতে পারে না, ভাবতে পারে না, তার সুকুমার বৃত্তির চর্চা সে করতে পারে না, সৌন্দর্যচর্চা করতে পারে না তখন সে স্থবির হয়ে যায়। এ স্থবিরতা এখন ভাঙতে হবে। সেটার জন্য সকল বিবেকবান, উদারনৈতিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা প্রমাণ দিতে চাই ধর্ম লেবাসে নয়। ধর্ম শাস্ত্রে নয়, ধর্ম তোমার আচরণে, তোমার হৃদয়ে। ঐ ধর্মকে যিনি ধারণ করবেন তিনি হচ্ছেন ধার্মিক। আগুনের ধর্ম পোড়ানো, চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা, মানুষের ধর্ম মানবতা। ওহে বৌদ্ধরা! ওহে খ্রিস্টানরা! ওহে হিন্দুরা! ওহে মুসলমানরা! তোমরা সিনাগগ, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ভর্তি করছ আল্লাহকে ভগবান ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য? কস্মিনকালেও পাবে না। মানবতাকে বিপন্ন করে, মানুষকে ধ্বংস করে দিয়ে তোমরা স্রষ্টার সান্নিধ্য পাবে না।
আজকে আমরা একটা সংকাকালীণ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। প্রতিনিয়ত একটা ষড়যন্ত্র চলছে আমার জন্মভূমি মাটিকে নিয়ে। এখানে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, একটি জঙ্গিবাদি ইস্যু সৃষ্টি করে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলি তাণ্ডব সৃষ্টি করার জন্য তৎপর। আমরা তা হতে দিতে পারি না। আমি হাজারবার বলেছি, আবারও বলছি, “প্রয়োজনে আমি আমার বাংলার মাটিতে জীবন দিব তবুও আমি উদ্বাস্তু শিবিরে যাব না।” ধর্মের নামে যে আগুন প্রজ্জ্বালিত হয়েছে, এ আগুন ভয়ঙ্কর আগুন। এর লক্ষণ ভালো নয়। আমরা হেযবুত তওহীদ চেষ্টা করছি এ আগুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, সবাইকে সচেতন করতে।
লেখক: মাননীয় এমাম, হেযবুত তওহীদ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...