হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দুনিয়াকে শান্তিময় করার সকল কাজই দীনের কাজ

রাকীব আল হাসান:
রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘ইসলামে বৈরাগ্য নেই’, ইসলামের বৈরাগ্য-সন্ন্যাস হচ্ছে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও হজ্ব। মুসলিম যখন সংগ্রামে যায় তখন অবশ্যই তার ঘর-বাড়ি, সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র, পরিজন, সংসার ছেড়ে যায় অর্থাৎ সন্ন্যাস গ্রহণ করে। শুধু এই একমাত্র সন্ন্যাসই ইসলাম অনুমতি দেয়, শুধু অনুমতি নয় উৎসাহিত করে। অন্য যে সন্ন্যাসটি হাদিসে পাচ্ছি অর্থাৎ হজ্ব, ওটা এক সময়ে সন্ন্যাসই ছিল, কারণ তখনকার দিনে দূরদেশ থেকে হজ্বে গেলে বাড়ি ফিরে আসার নিশ্চয়তা ছিল না। বর্তমানে হজ্ব আর সে রকম পূর্ণভাবে সন্ন্যাসের পর্যায়ে পড়ে না। মুসলিম যখন সংগ্রামে যায় তখন সে আর ফিরে আসার আশা করে না, কারণ তার সামনে তখন লক্ষ্য হয় এই জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার, সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান শাহাদাত। বিশ্বনবী (সা.) নিজ হাতে যে জাতি সৃষ্টি করেছিলেন, নিজে যাদের শিক্ষা-ট্রেনিং দিয়েছিলেন সেই সম্পূর্ণ জাতিটিই ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সন্ন্যাসীর জাতি হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য ধর্মের ও বর্তমানের বিকৃত সুফিদের সন্ন্যাসের সঙ্গে ঐ উম্মাহর সন্ন্যাসের তফাৎ হলো এই যে- এরা নিজেদের ব্যক্তিগত আত্মার উন্নতির জন্য বৈরাগ্য-সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, আর এই উম্মাহর সন্ন্যাসীরা সমস্ত মানব জাতির কল্যাণ ও শান্তির জন্য সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরা সন্ন্যাস গ্রহণ করে তসবিহ, বদনা, জপমালা, কমণ্ডলু হাতে সংসার ত্যাগ করেন বা হুজরায় ঢুকেন আর উম্মতে মোহাম্মদী সংসার ত্যাগ করেন সমাজে শন্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করার জন্য। আজ ‘মুসলিম’ জাতির কাছে ‘দুনিয়া’ শব্দের অর্থ আর অন্যান্য বিকৃত ধর্মগুলির সংসার শব্দের অর্থ একই অর্থ। প্রকৃত মুসলিমের আকিদায় দুনিয়া হলো- যা তাকে সমস্ত পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে- সেটা যাই হোক, সম্পদই হোক, স্ত্রী-পুত্র-পরিজনই হোক, এমন কি নিজের প্রাণের মায়াই হোক সেটা। ঐ বাধা না হলে পৃথিবীর সব কিছু সে ভোগ করবে। আরও একভাবে প্রচলিত সন্ন্যাস ও ইসলামের সন্ন্যাসে প্রকট তফাৎ রয়েছে। প্রচলিত বৈরাগ্য স্বার্থপর; নিজের আত্মার উন্নতির জন্য। কাজেই সংসারের ঝামেলা ত্যাগ করলেও নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে রাজি নয়, কারণ প্রাণ গেলে তো আর উন্নতির প্রশ্ন থাকে না। আর ইসলামের বৈরাগ্য-সন্ন্যাস অন্যের জন্য, সমস্ত মানব জাতির জন্য, আল্লাহর জন্য এবং শুধু সংসার নয় নিজের প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করে। কাজেই ঐ দুনিয়া ত্যাগ নিষিদ্ধ, পরকালে এর কোনো পুরস্কার নেই, আর ইসলামের বৈরাগ্য ফরদ এবং পরকালে এমন পুরস্কার ও সম্মান রয়েছে যে তার কাছাকাছিও অন্য পুরস্কার নেই, অন্য সম্মান নেই।
কোর’আনে দুনিয়া শব্দের অর্থ বিকৃত অর্থে নেওয়ার ফল হয়েছে এই যে, বর্তমানের ‘মুসলিম’ নামক এই জাতির একটা অংশ অত্যন্ত ‘পরহেযগার’ হয়ে গেছেন। কাজে-কর্মে ‘ইবাদতে’ তারা সংসার বিমুখ, শিক্ষিত ও ধনী হওয়া সত্তে¡ও তারা প্যান্ট না পরে টাখনুর উপর পাজামা পরেন, লম্বা দাড়ী রাখেন, গোঁফ নেই, হাতে তসবিহ নিয়ে জিকিরে মশগুল থাকেন। এদের মধ্যে অনেক লাখপতি, কোটিপতি আছেন। এই দুনিয়া বিমুখ অতি মুসলিমদের কাছে যেয়ে যদি বলেন যে সমস্ত পৃথিবীতে আজ আল্লাহর হুকুম চলছে না, আল্লাহর বিধান চলছে না ফলে সমগ্র পৃথিবী অন্যায়, অবিচার আর অশান্তিতে নিমজ্জিত। এখন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার দূর করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এই সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপনাকেউ নামতে হবে। আল্লাহ বলছেন তিনি মুমিনদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন (কোর’আন- সুরা আত-তওবা-১১১, সুরা আন-নিসা-৭৪)। “আমরা আপনার জান চাচ্ছি না, আপনার লাখ লাখ টাকা আছে, তা থেকে আমাদের মাত্র এক লাখ টাকা দান করুন, আমরা আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করব”। বলে দেখেন ঐ দুনিয়া বিমুখ পরহেযগার অতি মুসলিম আপনাদের কত টাকা দান করেন। খুব সম্ভব তিনি আপনাদের দশ/বিশ টাকা দিয়ে রেহাই পেতে চেষ্টা করবেন। তার ঐ দুনিয়া বিমুখতার কোন দাম আল্লাহর কাছে নেই কারণ আল্লাহ এ দুনিয়া বিমুখতার অনুমতি দেন নি। আল্লাহ যে দুনিয়াকে ত্যাগ করতে বলেছেন- অর্থাৎ এই দীনের প্রয়োজনে নিজের প্রাণসহ সব কিছু কোরবান করা- সেইখানেই তিনি ব্যর্থ। তিনি আসলে পরিপূর্ণভাবে দুনিয়াতে ডুবে আছেন। কোর’আনে আল্লাহ ‘দুনিয়া’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন সেটা রসুলাল্লাহ (সা.) তার সাহাবাদের যা বুঝিয়েছিলেন সেইটা ঠিক, নাকি চৌদ্দশ’ বছর পর এখন আমাদের ‘ধর্মীয়’ নেতারা যেটা বোঝাচ্ছেন সেইটা ঠিক? যারা সরাসরি মহানবীর (সা.) সম্মুখে থেকে ইসলাম শিক্ষা করেছিলেন তাদের একজনের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ওবায়দা (রা.) মিশরের খ্রিস্টান শাসক আর্চ বিশপকে বলেছিলেন-“আমরা বেঁচেই আছি শুধু আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করার জন্য (অর্থাৎ পৃথিবীতে এই জীবন-ব্যবস্থা-দীন মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য)। আমাদের শুধু পেটের ক্ষুধা নিবারণ আর পরার কাপড়ের চেয়ে বেশি কিছু চাই না। এই দুনিয়ার জীবনের কোন দাম আমাদের কাছে নেই- এর পরের জীবনই (আখেরাত) আমাদের কাছে সব।” দুনিয়া ও আখেরাত সম্বন্ধে এই ধারণা (আকিদা) শুধু ওবায়দারই (রা.) ছিল না, প্রত্যেকটি সাহাবারই ছিল, কারণ তারা সবাই ঐ আকিদা শিক্ষা করেছিলেন স্বয়ং বিশ্ব নবীর (সা.) কাছ থেকে। তাদের একজনও তাসবিহ হাতে নিয়ে খানকায়, হুজরায় পলায়ন করেন নি। তাদের শিক্ষক (সা.) তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন- “ইসলামে দুনিয়া ত্যাগ নেই, ইসলামের দুনিয়া ত্যাগ হচ্ছে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আর হজ্ব”। সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমস্ত জাতি ইসলামের সন্ন্যাস গ্রহণ করল, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বেরিয়ে পড়ল, চললো খানকার পানে নয় বিরাট পৃথিবীর পানে, আজকের ঠিক বিপরীত।
মানুষের কাজকে আজ প্রধানত: দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একটি দুনিয়ার কাজ অর্থাৎ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন যেমন- চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ইত্যাদি এগুলোর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক রাখা হচ্ছে না। অন্যটি ধর্মীয় কাজ, পরকালের জন্য কাজ, যেমন- নামায, রোযা, হজ্ব, জিকির-আসকার ইত্যাদি এবং অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন উপাসনা। এগুলোর সাথে আবার দুনিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। যারা পরকালকে বিশ্বাস করে না তারা এই ধর্মের বিষয়টি তাদের জীবন থেকে একেবারে বিদায় করে দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে দীন ও দুনিয়া এইভাবে মানুষের জীবনকে, কাজকে দুই ভাগে করার কোন সুযোগ নেই। কারণ ইসলাম নামক এই জীবন-ব্যবস্থাটাই আল্লাহ দিয়েছেন এই দুনিয়ার জন্য, এই দুনিয়ার শান্তির জন্য। মানুষ যেন ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ সমস্ত রকম অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, রক্তপাত ইত্যাদি থেকে বেঁচে শান্তিতে থাকতে পারে এজন্য আল্লাহ মানুষকে ইসলাম নামক এই দীন দিয়েছেন। এই দীন, জীবন-ব্যবস্থা মানুষ যদি তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচার ব্যবস্থায়, পারিবারিক অর্থাৎ সর্বাঙ্গীন জীবনে মেনে নেয় তাহলে এই দুনিয়ার জীবনে শান্তিতে থাকবে, ইসলামে থাকবে। দুনিয়ার জীবনে সে যদি শান্তিতে অর্থাৎ ইসলামে থাকে তাহলেই আল্লাহ পরকালীন জীবনে তাকে জান্নাত দিবেন। সুতরাং একজন মুমিনের নিকট দীন ও দুনিয়া একই অর্থাৎ দুনিয়াই তার দীন।
বর্তমানে অধিকাংশ ধার্মিকেরা পৃথিবীর রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, দণ্ডবিধি, শিক্ষা, সংস্কৃতি এক কথায় জীবনের সমস্তকিছু দাজ্জালের উপরে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা তাদের ভাষায় দুনিয়া ত্যাগ করে পরকালের অন্বেষণ করছেন। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল, কারণ ওগুলি বাদ দিয়ে পরকালের সফলতা পাওয়া যাবে না, কেননা আল্লাহর শেষ জীবনব্যবস্থা ঐ ব্যবস্থাগুলি দিয়ে পূর্ণ। অপরদিকে মানবজাতির প্রায় সম্পূর্ণ অংশই আখেরাত, পরকাল, আধ্যাত্মিকতা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পার্থিব ভোগ বিলাস ও প্রতিষ্ঠার পেছনে একমুখী হয়ে ছুটছে। এটাই হচ্ছে সেই দুনিয়া যা মানুষকে জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...