হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জান্নাতের পূর্বশর্ত তওহীদ, সালাহ নয়

মোহাম্মদ জাকারিয়া হাবিব

সালাহ্ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে ৮০ বারেরও বেশি সালাহ্’র কথা উল্লেখ করেছেন। ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে আকিদা অর্থাৎ ধারণা আজ বিকৃত হয়ে গেছে। কেউ একে মনে করছে ধ্যান, কেউ মনে করছে শারীরিক ব্যায়াম, কেউ মনে করছে আল্লাহর সামনে প্রণতি স্বীকারের পন্থাবিশেষ, কেউ কিছুই মনে করছে না, ভাবছেন আল্লাহ করতে বলেছেন তাই করতে হবে। অথচ একটি জিনিস সম্পর্কে যদি সঠিক ধারণাই না থাকে তাহলে সেটা থেকে কারও কোনো উপকার হাসিল করা সম্ভব নয়। যেমন আপনাকে একটি মোবাইল ফোন দেওয়া হলো যেটার মধ্যে আধুনিক সকল সুবিধা আছে কিন্তু সেগুলি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় আপনি জানেন না, তাহলে কি সেই মোবাইলটি দিয়ে আপনি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন? তেমনি নামাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এ থেকে কেউ কোনো উপকার লাভ করছে না, তবু আল্লাহ বলেছেন বিধায় পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে। সঠিক ধারণা না থাকার কারণে অনেক মিথ্যা কথা নামাজের পক্ষে চালু হয়ে আছে যা কোর’আনেও নেই হাদিসেও নেই। যেমন- বিভিন্ন জায়গায় লেখা দেখা যায়- ‘নামাজ জান্নাতের চাবি।’ অথচ এই কথাটি সঠিক নয়, জান্নাতের চাবি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া জীবনের কোনো অঙ্গনে আর কারও বিধান মানি না এই সাক্ষ্য দেওয়া।
আরেকটি কথা ছোট কাল থেকে শুনে আসছি, বিশেষতঃ সমাজে একটি দল আছে যারা মানুষকে নামাজের দাওয়াত দেয়, তারা বলে, “এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ বিনা কারণে কাযা করলে এক হোব্বা বা ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর জাহান্নামের দাউ দাউ করা আগুনে জ্বলতে হবে”। এই কথাটিও না আছে কোর’আনে, না আছে হাদিসে। ফাজায়েলে নামাজ নামক একটি গ্রন্থে এই কথাটি উল্লেখ আছে, সেখানে লেখক বলেছেন, ‘হাদিসে আছে’। কিন্তু তিনি বলেন নি যে, কোন হাদিসে আছে। কোন এবারত, সনদ কিছু ছাড়াই একটি কথাকে হাদিস বলে চালিয়ে দেওয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো হাদিস নয়, এটি তাদের মনগড়া কথা। এই মনগড়া কথাটি উপর্যুপরি প্রচারের ফলে মানুষের মনে গেঁথে গেছে যে, নামাজ পড়লেই জান্নাতে যাওয়া যাবে এবং না পড়লে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। এই জন্য অনেকেই অন্য কিছুর চিন্তা না করে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েই নিজেদেরকে পাক্বা মুমিন ও জান্নাতি মনে করেন।
সালাহ্ ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরদ অর্থাৎ অবশ্যকরণীয়। কিন্তু সালাহ্, যাকাহ্, হজ্ব, সওম এমনকি জিহাদ পর্যন্ত ইসলামের সকল কাজের পূর্ব শর্ত হচ্ছে আল্লাহকে একমাত্র এলাহ্ (হুকুমদাতা) হিসাবে গ্রহণ করে নেওয়া। এই লা-এলাহা এল্লা আল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নাই অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা তওহীদের ঘোষণা ছাড়া কেউ মুমিন হতে পারে না। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই তওহীদ বর্তমানের ব্যক্তি জীবনের আংশিক তওহীদ নয়, এ তওহীদ সার্বিক জীবনের তওহীদ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, শিক্ষা ইত্যাদি মানব জীবনের সর্ব অঙ্গনের তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ জীবনের সর্ব অঙ্গনে যেখানে আল্লাহ ও তার রসুলের কোনো বক্তব্য আছে সেখানে আর কারও কোনো হুকুম না মানা। যে বা যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিয়ে নবী রসুলদের মাধ্যমে পাঠানো আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধকে তাদের সমষ্টিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করবে তাদের আমল তিনি গ্রহণ করবেন, ব্যক্তিগত সমস্ত অপরাধ, গোনাহ মাফ করে তাদের জান্নাতে স্থান দেবেন। এই প্রতিশ্র“তি সমগ্র কোর’আনে ও সহীহ হাদিসে ছড়িয়ে আছে। এটাকে আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবার জন্য আল্লাহর রসুল তাঁর বিশিষ্ট সাহাবা আবু যরকে (রা.) বললেন-যে লোক মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর তওহীদের ওপর অটল থাকবে সে ব্যভিচারী ও চোর হলেও জান্নাতে প্রবেশ করবে (হাদিস-আবু যর গিফারী (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম)।
অতএব জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ভর করছে তওহীদের উপরে; সালাহ্ করা আর না করার উপরে নয়। সালাহ্ কাদের জন্য তা আল্লাহ কোর’আনে ঘোষণা করেছেন, হে রসুল আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুমিন তাদেরকে তুমি বল সালাহ্ কায়েম করতে (সুরা-এব্রাহিম,আয়াত-৩১)। আর এই সালাহ্ হচ্ছে ঐ তওহীদ ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থাটি সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য যে চরিত্র দরকার সেই চরিত্র তৈরির প্রশিক্ষণ। এটা ইতিহাস যে, আল্লাহর রসুলের অনেক সাহাবী জীবনে এক ওয়াক্ত সালাহ্ কায়েম করার সুযোগ পাননি, রসুলের হাতে তওহীদের বায়াত গ্রহণ করেই জিহাদে, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং শাহাদাত বরণ করে জান্নাতে চলে গেছেন। নামাজ বা সালাহ্ যদি জান্নাতের চাবি হতো তাহলে আল্লাহর রসুল নবুয়ত পেয়েই মানুষকে বলতেন, ‘তোমরা নামাজ পড়’; তাহলেই তোমরা জান্নাতি হবে আর নামাজ যদি না পড় তাহলে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।’ কিন্তু তিনি কি তাঁর জীবনে একবার ও এমন কথা বলেছেন? বলেন নি। এমন কি পবিত্র কোর’আনে এমন একটি আয়াত ও নেই যেখানে বলা হয়েছে, ‘সালাহ্ কায়েম করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, আর না করলে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।’ বরং জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ভর করে তওহীদের উপরে।
উম্মতে মোহাম্মদী সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য- জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা। রসুলাল্লাহর ৬০/৭০ বছর পরে যখন জাতি সেই সংগ্রাম ত্যাগ করল, তখন আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে বহু জাল হাদিস উদ্ভাবন করা হয়। “নামাজ বেহেস্তের চাবি”, “এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করলে এক হোব্বা বা ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে”- তেমনই দুইটি বানোয়াট হাদিস। যে অসৎ উদ্দেশ্যে এই হাদিস উদ্ভাবন করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছে। যার প্রমাণ এই জনসংখ্যা এখন সম্পূর্ণ সংগ্রামবিমুখ এবং তাদের কাছে ইসলাম মানেই নামাজ। তাদের আকিদায় এখন জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুমের কোনো অস্তিত্ব নেই, প্রয়োজনও নেই। আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করারও কোনো দরকার নেই। তাদের দরকার শুধু নামাজ আর নামাজ। কুফর ও শিরক’র সাগরে নিমজ্জিত থেকেও তারা মনে করে যে শুধু নামাজ পড়েই তারা জান্নাতে চলে যাবেন।
সাবধান আমার কথা থেকে কেউ যেন এটা মনে না করে যে, আমি সালাহ্কে খাটো করছি। পূর্বেই বলেছি যে, মহান আল্লাহ তাঁর কোর’আনে ৮০ বারের ও অধিক সালাহ্র কথা বলেছেন। যে সালাহ্ পবিত্র মেরাজে নিয়ে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে শিক্ষা দিলেন, যে সালাহ্ দৈনিক ৫ বার ফরদ সে সালাহ্কে মুমিন খাটো করে দেখতে পারে না। আমি বলতে চেয়েছি, যেটা যে স্থানে থাকা দরকার সেটাকে সে স্থানে রাখাই ন্যায়সঙ্গত, অতিরঞ্জিত করা অন্যায়। তওহীদ ছাড়া সালাহ্র কোনো দামই নেই। নবী করিম (স:) মক্কার ১৩ বছর জীবনে শুধু তওহীদের বালাগ দিয়েছেন। নবুয়ত প্রাপ্তির ১১ তম বৎসরে পবিত্র মেরাজে গিয়ে রসুল (দ:) সালাহ্ আনলেন, এর মধ্যে যারা শহীদ হয়েছিলেন অথবা মৃত্যু বরণ করেছিলেন তাঁরা তো শুধু তওহীদ নিয়েই জান্নাতে গেলেন। তাঁর নিকট প্রথমে কেউ আসলে তাকে শুধু তওহীদের দিকেই আহবান করতেন। যে তওহীদে আসবে তার জন্যেই সালাহ্। সালাহ্র কথা ৮০ বার কিন্তু তওহীদের কথা সহস্রবার বলা হয়েছে। পবিত্র কোর’আনে সবচাইতে আলোচিত বিষয় তওহীদ, সকল নবীর আনীত দীনের ভিত্তি এই তওহীদ। অথচ আজ সেই তওহীদ পৃথিবীর কোথাও নেই, মানবজাতি কার্যত কাফের ও মোশরেক হয়ে আছে, কিন্তু তা নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। তারা ভুলেই গেছে ইসলামের শুরু তওহীদ দিয়ে নামাজ দিয়ে নয়।

[বি:দ্র: এই নিবন্ধে ফার্সি শব্দ নামাজ এর পরিবর্তে আরবি শব্দ সালাহ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ ‘নামাজ’ শব্দটি দিয়ে সালাহ এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে না।]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...