হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জাতি ধ্বংসের দায় আলেম সমাজ এড়াতে পারেন না

^F419B9C58484EC2193C0FC9B99690354020746778D96E6030C^pimgpsh_fullsize_distrমাহবুব আলী:

রসুলাল্লাহ (দ:) আখেরী যামানা সম্পর্কে বোলেছেন, এমন সময় আসবে যখন- (১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, (২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, (৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, (৪) আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, (৫) তাদের তৈরি ফেত্না তাদের ওপর পতিত হবে। [হযরত আলী (রা:) থেকে বায়হাকী, মেশকাত] উক্ত হাদীসের প্রথম ৩টি বিষয় তো আর ব্যাখ্যার দাবি রাখে না। বর্তমানে তওহীদহীন, বিকৃত মরা এই জাতির দিকে তাকালে পরিষ্কার দেখা যায় কিভাবে মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হোয়েছে। এই ব্যাপারে অনত্র্য আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি। এখানে ৪র্থ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কোরব।
আল্লাহর রসুল চতুর্থ যে বিষয়টি বোললেন তা ভালো কোরে বুঝে নেওয়া খুব জরুরি। তিনি বোললেন, আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হবে আমার উম্মাহর আলেম শ্রেণি। অতি ভয়ঙ্কর কথা সন্দেহ নেই, কারণ যারা দীনের ধারক-বাহক আলেম শ্রেণি, যাদেরকে আল্লাহর রসুল ‘নবীদের উত্তরাধিকারী’ বোলে সম্মানিত কোরেছেন, তারাই যদি আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়, তাহোলে ঐ সমাজে ইসলামের অবস্থা কি দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই আমাদের জানতে হবে আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রকৃত আলেম বা জ্ঞানী কারা?
আলেম কথাটি এসেছে এলেম অর্থাৎ জ্ঞান থেকে, যিনি জ্ঞানের অধিকারী তিনিই আলেম। এলেম বোলতে বর্তমানের বিকৃত আকিদায় কেবলমাত্র ধর্মীয় জ্ঞানকে বোঝানো হয় এবং আলেম বোলতে ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারীদেরকে বোঝানো হয়। কিন্তু এ ধারণাটি সঠিক নয়। প্রকৃত আলেমদের এলেম (জ্ঞান) থেকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা গোষ্ঠীর মানুষ নয়, সমগ্র মানবজাতি উপকৃত হবে। এখানে আল্লাহর রসুলের একটি হাদিসের উল্লেখ প্রয়োজন। তিনি বোলেছেন- জ্ঞান আহরণের জন্য প্রয়োজন হোলে চীনেও যাও (আনাস (রা:) থেকে বায়হাকী, মেশকাত)। বিশ্বনবীর সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে চীনদেশ ছিলো পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত, তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের (উম্মাহ) তদানীন্তন পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র চীনে যেয়ে ঐ জ্ঞান আহরণের আদেশ দিয়েছেন। এ কথা আহাম্মকেও বুঝবে যে এই হাদিসে ‘এলেম’ শব্দ দিয়ে তিনি দীনের জ্ঞান বোঝান নি, কারণ আল্লাহর রসুলকে মদীনায় রেখে দীনের জ্ঞান শেখার জন্য চীনে যাওয়ার (যে চীন তখনও ইসলামের নামই শোনে নি) কোনো অর্থই হয় না। বিশ্বনবী এখানে ‘জ্ঞান’ বোলতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বুঝিয়েছেন।
জাতির নেতৃত্ব যখন ধীরে ধীরে রসুলাল্লাহ ও খোলাফায়ে রাশেদুনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হোতে শুরু কোরল, তারা আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ পরিত্যাগ কোরল তখন জেহাদ সংক্রান্ত বিপুল কর্মব্যস্ততা হারিয়ে ফেলে সময় অতিবাহিত করার জন্য জাতির মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ বা আলেমগণ নতুন একটি কাজ খুঁজে নিল। সেটা হোল দীনের বিধি বিধানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। দীনের প্রতিটি বিষয় নিয়ে মাসলা মাসায়েল বের করা আরম্ভ হোল। সেই মাসলার বিপক্ষেও আরেকদল অন্য মাসলা হাজির কোরতে আরম্ভ কোরল। এভাবে শুরু হোল দীন নিয়ে মতভেদ। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেল যে, দীনের একটি বিষয়ও রোইল না, যেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা দ্বিমত নেই। এভাবে সহজ সরল দীনটি পণ্ডিতদের কাজের ফলে হোয়ে গেল জটিল ও দুর্বোধ্য। জাতির শাসকগণ যখন অন্যায় কোরতে আরম্ভ কোরল তখন এই জ্ঞানীদের নতুন কাজ হোল শাসকের সকল অন্যায় কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং সেগুলির একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় কোরিয়ে তাকে জায়েজ করা এবং প্রয়োজনে রসুলাল্লাহর নামে হাদিস তৈরি করা। বিনিময়ে শাসকদের পক্ষ থেকে তারা লাভ কোরতে লাগল মদদ, উপঢৌকন, ভোগবিলাসের যাবতীয় উপকরণ সর্বোপরি একটি নিরাপদ নিশ্চিত জীবন। শাসকের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে এভাবে হাজার হাজার জাল হাদিস সৃষ্টি হোতে লাগল। সেই জাল হাদিসগুলির উপর এজমা, কেয়াস কোরে তৈরি হোল হাজার হাজার মত, পথ, দল। দলের মধ্যে বিভক্তি কোরে সৃষ্টি হোল উপদল ইত্যাদি। এই জ্ঞানীরাই হোল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ধর্মজীবী আলেম। সেই থেকে আজ অবধি ইসলামের ধর্মজীবী আলেম শ্রেণিটি প্রধানত দু’টি কাজ নিয়ে মহা ব্যস্ত যথা-
১) দীনের অতি বিশ্লেষণ: দীনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নানা মত, পথ, ফতোয়া নিয়েই তারা ব্যস্ত, তাদের এই নানাবিধ মত, পথ আর ফতোয়ার জের ধরেই জন্ম নিয়েছে নানা ফেরকা, মজহাব, দল, উপদল এবং এরা প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি, বাহাস এমনকি রক্তারক্তিতে ব্যস্ত।
২) ধর্মব্যবসা: বর্তমান আলেম শ্রেণিটির কাজই হোল অর্থের বিনিময়ে আমাদের মসজিদগুলিতে নামাজ পড়াবেন, মিলাদ পড়াবেন, আমাদের মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবেন, আমাদের পূর্বপুরুষদের কবর জেয়ারত কোরবেন, গরু কোরবানি কোরে দিবেন, ওয়াজ কোরে বেড়াবেন, ফতোয়া দিবেন, বিয়ে পড়িয়ে দিবেন ইত্যাদি ধর্মীয় কাজগুলি কোরে দিবেন আর অপরপক্ষে বৃহত্তর জনসাধারণকে ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে দেবে না, ফলে তারা এই শ্রেণিটির মুখাপেক্ষী হোয়ে থাকবে। একদিকে ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তথা বৃহত্তর জনসাধারণ, অন্যদিকে অর্থের বিনিময়ে তাদের ধর্মীয় কাজগুলি কোরে দেওয়ার জন্য পৃথক একটি শ্রেণি অর্থাৎ পুরোহিত শ্রেণি- মোসলেম সমাজে এই রকম শ্রেণি বিভাজন আল্লাহর রসুল যে জাতিটি রেখে গিয়েছিলেন সেই জাতির মধ্যে ছিল? প্রকৃত ইসলামের যুগে এ জাতির মধ্যে কোনো পুরোহিত শ্রেণি ছিল না, সবাই ছিলেন যোদ্ধা। যিনি ছিলেন যত বড় মো’মেন তিনি ছিলেন তত বড় যোদ্ধা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার সৈনিক। দীনের ছোটখাট বিষয়গুলি নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী, আল্লামা, মাওলানা, মুফতি, মোফাসসের টাইটেলধারী, মসজিদে, খানকায়, হুজরায় নিরাপদে বসে জনগণের মধ্যে ফতোয়া প্রদান কোরে, ওয়াজ-নসীহত কোরে জীবিকা নির্বাহকারী একটি আলাদা পুরোহিত শ্রেণি কল্পনাও করা যেত না।
তাদের এই যে কাজ অর্থাৎ দীনের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং ধর্মব্যবসা- এই কাজের পরিণাম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এই খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ফলে সহজ সরল দীনটি হোয়ে গেল জটিল ও দুর্বোধ্য, গুরুত্বের ওলটপালট হোয়ে দীন বিকৃত হতে লাগল ফলে সাধারণ মানুষ এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে লাগল। অপরদিকে ধর্মব্যবসার সুবিধার জন্য এই আলেমগণ দীনের মধ্যে নানাবিধ বিকৃতি ঢুকাতে লাগল যা আগেও বলে আসলাম। এই আলেমরাই নিজেদের স্বার্থে দীনকে বিকৃত কোরতে কোরতে একেবারে বিপরীতমুখী কোরে ফেলেছে। এখন এই দীনের নাম ইসলাম (শান্তি) হোলেও এটি আর শান্তি দিতে সক্ষম নয়। এই দীনবিকৃতির জঘন্যতম কাজের জন্যই এদেরকে রসুলাল্লাহ আসমানের নিচে নিকৃষ্ট জীব বলে আখ্যায়িত কোরেছেন।
এ ছাড়াও সুরা বাকারার ১৭৪-১৭৬ নং পর্যন্ত আয়াতগুলিতে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বোলেছেন, “আল্লাহ যে কেতাব অবতীর্ণ কোরেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা (১) নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না, (২) কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বোলবেন না, (৩) আল্লাহ তাদের পবিত্রও কোরবেন না, (৪) তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় কোরেছে, (৫) তারা হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা, গোমরাহী ক্রয় কোরেছে, (৬) তারা দীন সম্পর্কে ঘোরতর মতভেদে লিপ্ত আছে (৭) আগুন সহ্য কোরতে তারা কতই না ধৈর্যশীল” অর্থাৎ মোটকথা তারা নিকৃষ্টতম জাহান্নামী। এখন আপনারাই বোলুন, যারা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে, বিভিন্ন উপায়ে দীনের বিনিময় নিচ্ছেন তারা কি প্রকৃত আলেম হোতে পারেন? অসম্ভব। এজন্যই মহান আল্লাহ সুরা ইয়াসীনের ২১ নং আয়াতে বোলেছেন, “তোমরা তাদের এত্তেবা (আনুগত্য, পেছনে দাঁড়ানো, অনুসরণ) কোরো, যারা তোমাদের কাছে বিনিময় চায় না এবং যারা হেদায়াতে আছে।”
রসুল (দ:) ও তাঁর সাহাবাগণ আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রামে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু ব্যয় কোরে নিঃশেষ হোয়েছেন, এমন কি নিজেদের জীবনও উৎসর্গ কোরে গেছেন। পক্ষান্তরে আজকের আলেম নামধারীগণ ও বিকৃত সুফীরা সেই ইসলাম বিক্রি কোরে অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন, এমনকি অনেকের শান-শওকত, রাজকীয় হালচাল রাজা-বাদশাহদেরও হার মানায়।
কোন সত্যনিষ্ঠ লোক যদি আজ আল্লাহর দয়ায় এই দীনের মর্মবাণী কী, আত্মা কী তা বুঝতে পারেন এবং তিনি যদি সেটা মানুষের মধ্যে প্রচার করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন তবে এই মানুষটিকে প্রথমে বাধা দিবে এই আলেম হিসাবে পরিচিত শ্রেণীটি। তারা প্রথমে বলবে এই লোক ইসলামের কী বুঝে? সে কি মাদ্রাসায় পড়েছে? সে কি আরবি জানে? আরবি ব্যাকরণ জানে? তার কি লম্বা দাড়ি আছে, পাগড়ী আছে, আলখেল্লা আছে? সুতরাং এর ইসলামের কথা বলার কোনো অধিকার নেই, দীন বোঝা কি এতই সোজা? কোর’আন বোঝা অত্যন্ত কঠিন, এটা জানতে মাদ্রাসায় ডিগ্রী নিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আল্লাহ এই দীনের নাম দিয়েছেন সেরাতুল মোস্তাকীম যার অর্থ সহজ সরল পথ (সুরা ফাতেহা)। নবী করীম (দ:) বলেছেন দীন অত্যন্ত সহজ, তোমরা একে জটিল কোর না (আবু হোরায়রা (রা:) থেকে মোসলেম)। আল্লাহ রসুল বলেন দীন সহজ সরল আর আমাদের আলেমরা বলেন কঠিন ও জটিল, একেবারে বিপরীত কথা।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...