হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে …

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
কাজী নজরুল ইসলামকে যারা কাফের ফতোয়া দিয়েছিলেন তাদের বংশধররা এখন কাজী নজরুলকে নিয়ে গর্ব করেন। কাজী নজরুলের গান ছাড়া তাদের ঈদ উৎসব পালন হয় না। বিশেষ করে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটা শোনেননি এবং পছন্দ করেন না এমন মুসলমান নেই বললেই চলে। ঈদুল ফিতর উদযাপন হচ্ছে অথচ এই গানটি কোথাও শোনা যাচ্ছে না এমনটা আর যাই হোক আমাদের দেশে কল্পনা করা যায় না। এখানে ঈদুল ফিতর মানেই ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। ঈদের চাঁদ দেখা যাবার সাথে সাথে দেশের প্রায় সকল টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও, বিপণী-বিতান ইত্যাদিতে একসাথে বেজে ওঠে গানটি।
আচ্ছা, এই গানে কী বার্তা প্রদান করা হয়েছে? প্রকৃতপক্ষেই কি গানটি মুসলিমদের আনন্দের বার্তা বহন করে নাকি ভিন্ন কিছু? আর যদি আনন্দেরও হয় তাহলে কিসের আনন্দ? ত্যাগের আনন্দ নাকি ভোগের আনন্দ? আমরা গানের কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি কিনা? সম্ভবত ভাবিনি। কারণ এই গানটি উপলব্ধি করতে পারলে আমাদের আনন্দ করার কথা নয়, লজ্জায়-অনুতাপে মরে যাবার কথা। অথচ লজ্জার বালাই তো নেই-ই, বাস্তবতা হলো- এই গান না হলে যেন আমাদের আনন্দই জমে না! চলুন দেখে নেয়া যাক কী লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম-
‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’’
আমরা আসমানী তাগিদ পালন করতে গিয়ে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা রাখি তো? রাখলে ভালো, না রাখলে কিন্তু গোড়ায় গলদ। যাই হোক, পরেরটুকু দেখুন-
‘‘তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।’’
তার মানে এই জাতি মুর্দা? এ জাতির দেহে প্রাণ নেই? তাহলে মুর্দা মুসলিমের আবার ঈদ কীসের? আর কীসের অভাবেই বা জাতি প্রাণ হারাল? যাক সে কথা, পরেরটুকু দেখি।
‘‘আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে/যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ/ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’’
এ যেন রীতিমত ভর্ৎসনা! অর্ধপৃথিবীতে ইসলামের বিজয়কেতন উড়ানো সম্ভব হয়েছিল ইসলামের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী লাখ লাখ মুজাহিদের রক্তের বিনিময়ে, তারা জীবন দিয়েছেন কিন্তু রণাঙ্গন ত্যাগ করেননি, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে পিছপা হননি। কিন্তু আজ এই জাতির অবস্থান কোথায় তা নতুন করে বলার দরকার নেই। এরা হাজার বছর পূর্বেই যে রণাঙ্গন (ঈদগাহ) ছেড়ে দিয়েছে এবং তার পরিণতিতে কয়েকশ বছর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর দাসত্ব করেছে, আজ কপালে সেই দাসত্বের কলঙ্ক বয়ে নিয়ে ও নির্লজ্জ্ব হাস্যমুখে তারা নামাজ পড়তে চলেছে সেই রণাঙ্গনেই, সেই ঈদগাহেই যেখানে ‘সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ’। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে? কাজী নজরুলের এই ভর্ৎসনা বোঝার ক্ষমতাও কি আমাদের নেই?
‘‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে/তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।’’
প্রেম দিয়ে বিশ্ব-নিখিলকে জয় করবে? এই জাতি? কেউ সেই আশা করেন নাকি? এই জাতির নিজেদের রক্তে আজ নিজেদেরই হাত রঞ্জিত। এই আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষগুলো, যারা বছরে একদিন ঈদের নামাজ পড়ে আর রমজান মাসে রোজা রেখেই নিজেদেরকে খাঁটি উম্মতে মোহাম্মদী মনে করেন, তাদের প্রকৃত অবস্থা এই যে, পাশের দেশ নয়, পাশের জেলা নয়, পাশের গ্রাম নয়, এমনকি পাশের মহল্লাও নয়, পাশের বাড়িতে কেউ খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করেন না। প্রেম দিয়ে বিশ্বকে মুরিদ করার আশা কে করে? অন্তত যদি তারা নিজেরা নিজেদের সমাজটাকে দয়া-মায়া, করুণা, ভালোবাসা দিয়ে ভরে রাখতে পারত!
‘‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ’’
একমাসের রোজা শেষে যারা হাফ ছেড়ে বাঁচল তাদের বোঝা উচিত যে, তাদেরই মতো অসংখ্য আদম সন্তান এই পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে যাদের পেটে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। তাদের জীবন ইয়াতীম ও মিসকিনদের মত। তুমি এক মাসের এক বেলা খাবারের অভাবে এত কষ্ট পেয়েছো তাহলে এদের কথা ভাবো। এদের কষ্টও উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। এই কাজ তোমার ঈমানী দায়িত্ব থেকে করতে হবে। যে সমাজে দরিদ্রতার কষাঘাতে মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়, যে সমাজে যাকাতের ভাগ নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মানুষ মারা যায়, তিন মাসের শিশু ধর্ষিতা হয়, যে সমাজে বাবার কাছে মেয়ে নিরাপদ নয়, মেয়ের কাছে বাবা নিরাপদ নয়, যে সমাজে বিনা অপরাধে নিরীহ নারী-শিশুকে যানবাহনের মধ্যে জীবন্ত দগ্ধ হতে হয়, সেই সমাজে নির্লজ্জের মতন ঈদের উৎসব নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রয়োজন। মানুষের জন্য মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
[মোহাম্মদ আসাদ আলী: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ফেসবুক: facebook/asadali.ht
ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...