হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আত্মসমালোচনা: অতীত ব্যর্থতার দায় বহন করছে মুসলমান

রিয়াদুল হাসান:
যে ইসলাম আজ নানা প্রকার রূপ নিয়ে আমাদের ১৬০ কোটি মুসলমানের দ্বারা চর্চিত হচ্ছে তাকে আমরা বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা চেতনার যুগের উপযোগী করে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। এ ব্যর্থতার কারণে ইসলাম এ যুগের চাহিদা ও যাবতীয় সমস্যার সমাধানরূপে মানবজাতির দ্বারা বিবেচিত হতে পারছে না। ইসলামের যারা ধারক বাহক তারাও যুক্তির যুগে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন।
মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষ, উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল (সা.) অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর অধ্যবসায়, ত্যাগ, কোরবানী, তুলনাহীন প্রেরণা দিয়ে এই উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটিকে কেন গঠন করেছিলেন তা এখন এ জাতির অজানা। তাদের স্মৃতি ও অবদান ম্লান হতে হতে জাতির চোখের সামনে থেকে অদৃশ্যই হয়ে গেছে। প্রখর রৌদ্রে জ্বলেপুড়ে টকটকে লাল পোশাক যেমন ফিকে হয়ে যায় তেমনিভাবে ইসলামের ঔজ্জ্বল্য ¤øান হয়ে গেছে, তার গৌরবগাঁথার ইতিহাস সকলেই বিস্মৃত হয়ে গেছে। শত শত বছর থেকে জাতি মার খেতে খেতে হীনম্মন্যতায় আপ্লুত, তাদের দৃষ্টি ও শির অবনত। আমি কোর’আনের একটি আয়াত উল্লেখ করে জাতি সৃষ্টির কারণটি তুলে ধরছি। আল্লাহ সুরা ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে বলছেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে এ জন্য যে তোমরা মানুষকে ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে ফেরাবে।” সুতরাং যতদিন পৃথিবীতে অন্যায় অবিচার থাকবে ততদিন মুসলিম জাতির দায়িত্ব থাকবে সেই অন্যায়কে নিবারণ করা এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। অতীতে যত নবী রসুল অবতার এসেছেন তাদের সবারই জাতি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল এটিই, দুষ্টের দমন-শিষ্ঠের লালন (আমরু বিল মা’রুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার)। আল্লাহর রসুলের তিরোধানের ৬০/৭০ বছর পর মুসলিম জাতি উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়ার দরুন এ দায়িত্বটি ত্যাগ করে। তাদের সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম রূপ নেয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে। মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর জিম্মাদার খলিফা হয়ে যান ভোগবিলাসে, সুরা নারীতে মত্ত সম্রাট, সুলতান, কেসরা, কায়সার। জাতির আলেমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোর’আন হাদীসের উপর ইজতেহাদ করে ইজমা, কিয়াস করে হাজার হাজার মাসলা মাসায়েল উদ্ভাবন করতে লাগলেন। এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের তারতম্যের দরুন উম্মাহ বিভিন্ন পদ্ধতি ও বুজুর্গ ব্যক্তির মতাদর্শকে অনুসরণ করে শত শত ফেরকা মাজহাবে ভাগ হয়ে গেল।
অন্যদিকে পারস্য থেকে প্রবেশ করা ও পূর্বতন ধর্মের বিকৃত সুফিবাদের প্রভাবে মানবজাতির জীবন থেকে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার মানসিকতা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে সংগ্রামবিমুখ, অন্তর্মুখী, ঘরমুখী পরহেজগার, সুফিসাধক, দরবেশ ও বুজুর্গে পরিণত হলো। তাদের উদ্ভাবিত তরিকার অনুসরণ করতে গিয়ে জাতি আরো শত শত তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে একদেহ একপ্রাণ হয়ে এক নেতার নেতৃত্বে এই জাতি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে সেখানকার অসহায় মানুষকে রক্ষা করার প্রেরণা, লক্ষ্য (আকিদা) ও সামর্থ্য সবাই হারিয়ে ফেলল।
মধ্যযুগের বর্বর ইউরোপে মানুষ যখন যাজকতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের যাঁতাকলে পড়ে মুক্তির জন্য ত্রাহিসুরে চিৎকার করেছে, তখন সময়ের দাবি পূরণ করতে জন্ম নিয়েছে ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (প্রকৃতপক্ষে ধর্মহীনতাবাদ) যা বিবর্তনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল মানুষের তৈরি করে নেওয়া পুঁজিবাদী গণতন্ত্র মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। কয়েকশ বছর যেতেই আবারো মানুষ পাগল হয়ে উঠল উপনিবেশবাদ ও পুঁজিবাদের শোষণ বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
সময়ের দাবিতে জন্ম নিল সাম্যবাদ। লক্ষ কোটি মানুষ পাগলপারা হয়ে, হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল। কিন্তু তারাও মুক্তি পায় নি। সমাজতন্ত্র এক শতাব্দীও টিকল না, চরম ফ্যাসিস্ট রূপ নিয়ে আবারও মানুষকে অশান্তির দাবানলে নিক্ষেপ করল। মানুষ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল এবং আবার পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের দিকেই ফিরে গেল। যেসব দেশে এখনও নামেমাত্র সমাজতন্ত্র আছে তারা বাস্তবে ঘোর পুঁজিবাদী।
ইসলামেরই অঙ্গীকার ছিল তা মানবজাতির জীবন থেকে সকল অন্যায় অশান্তি দূর করবে। তখন যদি মুসলিমরা আল্লাহর রসুলের (সা.) রেখে যাওয়া সেই সাম্য, মৈত্র ও ভ্রাতৃত্বের বাণী নিয়ে যেখানে মানবতা ভ‚লুণ্ঠিত সেখানে যেত তবে ঐ নিপীড়িত মানুষগুলে হয়তো আর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ করে অশান্তির আগুনে জ্বলত না, তারা প্রকৃতই মুক্তির পথটি পেয়ে যেত। সেই ইসলাম এখন কেবলই আখেরাতে জাহান্নামের মুক্তির পথ দেখাতে উদগ্রীব। কোন আমলে কত সওয়াব এর গবেষণাতেই ধার্মিকেরা ব্যস্ত। যে ইসলাম খোদ মুসলমানকেই দুনিয়াতে শান্তি দিতে পারল না, সেটা আখেরাতে কী করে জান্নাত দেবে – এ প্রশ্ন করা হলে প্রশ্নকারীর কপালে জুটবে কাফের, মুরতাদ, খ্রিষ্টান ফতোয়া। আদর্শিক সংকটের সময়গুলোতে ইসলামকে মানবজাতির মুক্তির জন্য উপযোগী আদর্শ হিসাবে প্রাণময়, গ্রহণযোগ্য ও আধুনিক রূপে উপস্থাপন করার দায়িত্ব ছিল উম্মাহর আলেম সমাজের। সেটা করতে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই মানুষকে নতুন নতুন জীবনব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হয়েছে। তারা ইসলামটাকে শুধু ব্যক্তিগত সওয়াবের ধর্মে পরিণত করে গিয়ে মসজিদে খানকায় ঢুকেছেন এবং সেখানে বসে ধর্ম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছেন, মানুষকেও মসজিদ-মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বানিয়ে রেখেছেন।
দিন পাল্টাচ্ছে। চিন্তা চেতনার অগ্রগতি ও প্রগতির যুগে মানুষ আর সওয়াবের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না। কারণ সওয়াব তাদেরকে বাস্তব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারছে না। আমরা ইতিহাসে দেখি ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ রসুল যে দীন নিয়ে আসেন তখন কিন্তু মক্কার অর্থাৎ আরবেরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত, লাঞ্ছিত, পশ্চাৎপদ, দরিদ্র জাতি ছিল। আল্লাহর রসুল তাদের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করেছিলেন। তাদের ঘরে খাবার ছিল না। তিনি তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করলেন। তাদের সমাজে নিরাপত্তা ছিল না, তিনি অকল্পনীয় নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশ্বের দরবারে তাদের কোনও সম্মান ছিল  না, তাদেরকে সম্মানিত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল না, তিনি তাদেরকে ভাই বানিয়ে দিয়েছেন। দাসব্যবসার যুগে তিনি বেলালকে (রা.) ক্বাবার ঊর্ধ্বে উঠিয়েছিলেন, মুক্তদাস যায়েদকে (রা.) পুত্র বানিয়েছিলেন এবং বহু সামরিক অভিযানের সেনাপতি করেছিলেন। ইসলামপূর্ব যুগে নারীদের কোনো মর্যাদা ছিল না, মেয়ে সন্তানকে জীবিত কবর দিত অনেকেই, সেই নারীদেরকে ইসলাম সামষ্টিক জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে সম্মানজনক অবস্থান ও ন্যায়সঙ্গত মর্যাদার আসন দান করেছে।
অর্থাৎ ইসলাম ঐ সমাজের বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান দিয়েছিল বলেই তা ঐ সময়ের মানুষের জীবনে ও মননে গৃহীত হয়েছিল। যেখানেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানেই মানুষ শান্তি, নিরাপত্তা, স্বচ্ছলতা, প্রগতি ও ন্যায়বিচার লাভ করেছিল। জাতি যেন আধ্যাত্মিক দিক থেকেও বলিষ্ঠ থাকে সে জন্য প্রতিটি ব্যক্তিগত কল্যাণময় কাজের বিপরীতে সওয়াবের ধারণাও প্রত্যেকের মনে বিরাজ করত। পেটে যখন খাবার না থাকে তখন পূর্ণিমার চাঁদকেও রুটি বলে ভ্রম হয়। সমাজে যখন নিরাপত্তা থাকে না তখন ধর্মকে মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, তখন নিজেকে রক্ষা, নিজের সম্পদ রক্ষা, দেশ রক্ষাই প্রধান ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখ, দুর্দশায় হতাশাগ্রস্ত মানুষকে সওয়াবের ওয়াজ আকৃষ্ট করে না। দোয়া-দরুদ, যিকির-আসকারের ওয়াজ তাদের হৃদয়ে কোনো আবেদন সৃষ্টি করে না। তথাপি সমাজের মধ্যে বিরাজকারী বিরাট একটি শ্রেণি যারা ধর্মকে জীবিকার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করছেন তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে জিইয়ে রাখতে মরিয়া। এটা করার জন্য তারা সওয়াব ছাড়া অন্য কিছুর ভরসা, বিশেষ করে পার্থিব শান্তির ভরসা তারা মানুষকে দিতে পারছেন না। এটাই হলো আলেমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
মহাসত্য হচ্ছে, শেষ দীন ইসলাম, যা বিশ্বের সমস্ত মানবজাতির মধ্যে একটা বিপ্লব সৃষ্টি করে দেয়ার মতো আদর্শ, মানুষকে মুক্তি দেওয়ার মতো একমাত্র দর্শন তা কস্মিনকালেও বসে বসে সওয়াব কামাইয়ের জন্য আসে নি। আলেমদের ব্যর্থতার দরুণ পকেটে হীরার খণ্ড থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে মুসলিমরা। আর আমাদের মতো সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের বড় ব্যর্থতা হলো আমরা সমাজের যাবতীয় অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে, মুখ বুজে সহ্য করে কোনোমতে নিজে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাকেই যথেষ্ট মনে করছি। এদিকে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে যাক ওটা রক্ষা করবে সরকার, আমাদের ধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে যাক – ওটা রক্ষা করবে আলেমরা, এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে আছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা ধর্ম সম্পর্কে জানবো না, জান্নাতে যাওয়ার পথ আমাদেরকে আলেমরাই দেখাবেন। আমাদের এই স্থবিরতা, চিন্তার জড়ত্ব, আত্মকেন্দ্রিকতাই আমাদের সব সর্বনাশের কারণ। এখন অন্যের সমালোচনা বাদ দিয়ে আত্মসমালোচনা করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কোথায় আমরা পথ হারিয়েছি। তা না হলে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র ও জঙ্গিবাদীদের কাজের ফলে যে ভয়াবহ তাণ্ডব ধেয়ে আসছে তাতে করে আমাদের ধর্মও ধ্বংস হবে, দেশও ধ্বংস হবে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...