হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সনাতন ধর্ম ও ইসলাম

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
এ কথা সকল তথ্যাভিজ্ঞ মানুষই স্বীকার করবেন যে, বিশ্ব রাজনীতি অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন ধর্ম এক নম্বর ইস্যু। পাঁচ শতাব্দী আগে ইউরোপে বস্তুবাদী ধর্মহীন একটি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তারা যখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থাগুলোকে দুনিয়াজুড়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চিত বস্তুবাদী ধর্মহীন পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র প্রভাবে পৃথিবীর মানুষ এখন এতটাই মানবতাবোধহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক পরিণত হয়েছে যে সকল চিন্তাশীল, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এখন একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, যদিও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও পৈশাচিকতা রুখতে ধর্মকে বাদ দিয়েই জাতীয় জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু সেটার ফল আশানুরূপ হয় নি, মানুষ শান্তি পায় নি। যেটা পেয়েছে সেটা হলো যান্ত্রিক প্রগতি (Technological advancement)। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, বাস্তবে কোথাও ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় নি। শত সহস্র বছর থেকে মানুষের মনে লালিত ধর্মবিশ্বাস দূর করা যায় নি। এ কারণে তারা নীতি পাল্টিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে যখন রাষ্ট্র যখন কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) উপাধি ধারণ করে ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ত হওয়া শুরু করল, মানুষও রাষ্ট্রের নানা কাজে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেল, তখন সেই ধর্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে গণ্ডিবদ্ধ থাকে নি। নানা ইস্যুতে, নানা প্রেক্ষাপটে, ঘটনাপ্রবাহের নানা বাঁকে সেই ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। তখন রাষ্ট্রকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ধর্ম দিনশেষে ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে নি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারিত্ব নিয়ে এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি। এ পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ধর্ম এখন বিশ্বরাজনীতির এক নম্বর ইস্যু। ইউরোপে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার সেক্যুলার দলগুলো রাজনীতির মাঠ দখল করেছিল সেই মাঠ এখন ডানপন্থী খ্রিষ্টান প্রভাবাধীন দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে এবং জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। সেখানে বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো জড়িত হয়ে গেছে। আর এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ক্রমশ উত্থান কীভাবে রাজনীতির অঙ্গনে কলকাঠি নাড়ছে সেটা সবাই জানেন।
ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতবর্ষেও চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো ধর্মের অনুসারীই ছিল সংখ্যাগুরু। তার আগে বৌদ্ধরা ছিল বড় জনগোষ্ঠী। মুসলমানদের আগমনের পর কোটি কোটি ভারতবাসী ইসলামের শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য ও উন্নত আদর্শের পরিচয় পেয়ে মুসলিম হয়। এখনও হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই পাক-ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমান বাস্তবতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যগঠন করা, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত তাদের পারস্পরিক মনোমালিন্য ও মানসিক দূরত্ব দূর করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতন চালিয়ে প্রায়ই নির্মমভাবে ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এখানে করা হচ্ছে হিন্দুদের উপর আর ভারতে করা হচ্ছে মুসলমানদের উপর।
এই দাঙ্গা, হামলার প্রেক্ষিতে উভয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আরো সন্দেহ, আরো দূরত্ব, আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শত্রুতামূলক মনোবৃত্তি যতদিন তাদের মধ্যে বজায় রাখা যায় ততই সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুবিধা; তারা এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিয়া সুন্নীর দ্ব›দ্বকে কাজে লাগিয়ে তেলসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটিকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যদি আমরা সত্যিই আমাদের দেশটিকে ভালোবাসি, আমরা উপলব্ধি করি যে এ দেশের মাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, এই মাটি দিয়ে হিন্দুরা মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আর মুসলমানেরা এই মাটি দিয়েই ইটের মসজিদ গড়ে নামাজ পড়ে। এই মাটির ফল-ফসল খেয়েই হিন্দু – মুসলমান উভয় জাতির মানুষ পুষ্ট হয়। আমাদের এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভিতরে বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব এখন প্রবল যা অবিলম্বে দূর করা জরুরি। যখন কোনো লোকালয়ে অগ্নিকাণ্ড হয় তখন কারো ভবনই রক্ষা পায় না, দেবালয় মসজিদ কিছুই এড়ায় না। যখন ইরাক আক্রান্ত হলো তখন সিরিয়ার লোকজন বারে গিয়ে ফুর্তি করেছে। কিন্তু কয়দিন পরে দেখা গেল সেই আগুন সিরিয়াকেও ছাড়ল না, এখন সিরিয়ার মানুষ ইউরোপে ভিক্ষা করে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা সহজ কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা অত সহজ নয়। ওটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সরকারগুলো চেষ্টা করে আইন দিয়ে, শক্তি দিয়ে, অর্থ দিয়ে কারণ সরকারের কাছে ওগুলোই আছে। সরকারের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান, ক্রন্দনরত মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত¦না দেন, ভাঙা উপাসনালয় সংস্কার করে দেন, ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগিয়ে দেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষের মন যখন ভেঙে যায় তখন সেটা জোড়া লাগানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেজন্য এখন দুই সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ম এক নম্বর ইস্যু, ধর্মকে ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই বিদ্বেষ বিভক্তি দূর করতে হলে উভয় সম্প্রদায়কে মুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করার জন্য তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে তাদের গোড়া কোথায়, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি কিনা, তারা আদৌ ঐক্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। ঐক্যবদ্ধ হতে হলে উভয়পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। তারা তাদের উভয়ের লালিত ধ্যানধারণা, সংস্কার থেকে কতটুকু ছাড় দিতে রাজি হবে। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় তাই ধর্মবিশ্বাসের মধ্য থেকে কতটুকু তারা বিসর্জন দিতে পারবে, কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, ঐক্যের স্বার্থে তারা কতটুকু উদারতা নিজেদের মধ্যে আনয়ন করতে পারবে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
আমরা দেখব হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হাজার হাজার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুটো ধর্মদর্শনের মৌলিক বহু বিষয়ের গোড়া এক জায়গায়, দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেবল ডালপালা নিয়ে। এখন এই দুটো ধর্মের মধ্যে কী কী বিষয় সামঞ্জস্যপূর্ণ সেদিকে আলোকপাত করব।
১. একেশ্বরবাদ: ওয়াহদানিয়াত বা একত্ববাদ। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসাবে মানা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। সনাতন ধর্মেরও মর্মবাণী একমেবাদ্বীতিয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১), একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে প্রভু ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো শরিক নাই।
২. এক বাবা-মা: এক পিতামাতা থেকে সমগ্র মানবজাতির উদ্ভব হয়েছে। এই বিশ্বাস সনাতন ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরাই লালন করেন। ইসলামে বলা হচ্ছে তাঁরা হচ্ছেন বাবা আদম ও মা হাওয়া। সনাতন ধর্মে তাঁদেরকে বলা হচ্ছে আদম ও হব্যবতী (ভবিষ্যপুরাণ)।
৩. নূহ (আ.) ও রাজা মনুহ্: মহর্ষী মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক। তিনিই হচ্ছেন কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ.)। পুরাণে মহাভারতে তাকে বৈবস্বত্ব মনু, রাজা ন্যূহ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর উপরই নাযেল হয় বেদের মূল অংশ। তাঁর সময়ে এক মহাপ্লাবন হয় যাতে কেবল তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি বড় নৌকায় আরোহণ করে জীবনরক্ষা করেন। তাদের সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে রক্ষা পায়। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে আবার মানবজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্যই হাদিসে নূহ (আ.) কে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। হিন্দু ধর্মের মৎস্যপুরাণ গ্রন্থে এবং মহাভারতেও একই ঘটনার বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বৈবস্বত মনুর জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। সেই মহাপ্লাবনের পর এই মনু থেকেই মনুষ্যপ্রজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্য সনাতন ধর্মে কেউ কেউ মনুকেও মানবজাতির আদিপিতা বলে থাকেন।
৪. সনাতন ধর্ম ও দীনুল কাইয়্যেমাহ: ইসলামের এক নাম দীনুল কাইয়্যেমা। শব্দটি এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ শ্বাশ্বত, সুপ্রতিষ্ঠিত, চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। সনাতন অর্থও তাই। যে নীতি বা ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে সেটাই হচ্ছে সনাতন বা কাইয়্যেমাহ।
৫. দুই জীবন: উভয় ধর্মেই ইহকাল ও পরকালের ধারণা রয়েছে। মো’মেনদের জন্য জান্নাত আর কাফেরদের জন্য জাহান্নাম। সনাতন ধর্মেও রয়েছে ধার্মিকদের জন্য স্বর্গ ও অধার্মিকদের জন্য নরক। ইসলাম বলছে জান্নাতে যাওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুলসিরাত পার হতে হবে, আর সনাতন ধর্ম বলছে বৈতরণী নদী পার হয়ে বৈকুণ্ঠে যেতে হবে।
৬. উপাসনা পদ্ধতি: উভয় ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেও অনেক মিল। কোরবানি ও বলিদান, সিয়াম পালন ও উপবাস, সুরা ও মন্ত্রপাঠ, যিকির ও যপতপ, হজ্ব ও তীর্থযাত্রা, সেজদা ও প্রণিপাত, তসবিহ ও যপমালা, উপাসনার ওয়াক্ত ও তিথি বা ত্রিসন্ধা ইত্যাদি বহুকিছু একই রকম।
৭. মালায়েক ও দেবদেবী: ইসলামে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার জন্য অসংখ্য ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে তেমনি হিন্দু ধর্মে আছে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। এই ফেরেশতা ও দেবদেবী এক বিষয় কিনা এ নিয়ে ইসলামের আলেমদের মধ্যে অবশ্য মতভেদ রয়েছে, যেমনটা অধিকাংশ বিষয়েই তারা করে থাকেন।
এরকম উদাহরণ দিতে থাকলে হাজার হাজার দেওয়া যাবে। বেদ ও কোর’আনের যে আয়াত ও শ্লোকগুলো হুবহু একার্থবোধক তার তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। এত মিল থাকা সত্ত্বেও এই দুটো সম্প্রদায় একত্রে থাকতে পারছে না যে বিষয়গুলো নিয়ে সেগুলো হচ্ছে নিতান্তই ধর্মের গৌণ বিষয় যেমন খাদ্যাভ্যাস, উপাসনাপদ্ধতি, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে। এক সময় এদেশের মুসলমানেরাও ধুতি পরত, কিন্তু ধুতিকে হিন্দুর পোশাক বলা হচ্ছে। এসব অতি তুচ্ছ বিষয়। অমিলের বিষয়গুলো খুবই দুর্বল, কিন্তু মিলের বিষয়গুলো খুবই মৌলিক। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত মুসলমানদেরকেই। কেন সেটা বলছি।
আমরা জানি, আমাদের নবী কেবল আরবের নবী নন, তিনি বিশ্বনবী। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে। আল্লাহ নিজেও পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদের সকলের জন্য (জামিয়া) আল্লাহর রসুল (সুরা আরাফ ১৫৮)। তাঁর টাইটেল হচ্ছে রহমাতাল্লিল আলামীন, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কোনো ভেদাভেদ রাখা হয় নি। এক সাহাবির উপর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তুমি দেখবে অচিরেই এমন সময় আসবে যখন একা একটা সুন্দরী মেয়ে সর্বাঙ্গে অলঙ্কারপরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে সা’না থেকে হাদরামাউত চলে যাবে, তার মনে আল্লাহ ও বন্য পশুর ভয় ছাড়া কোনো ভয় থাকবে না। এখানে বলা হয় নি যে সেই নারী হিন্দু, নাকি মুসলমান, নাকি খ্রিষ্টান বা ইহুদি। কাজেই এটি পরিষ্কার যে, নবী এসেছেন সমগ্র মানবজাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ দায়িত্ব আল্লাহই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরাই সেরা জাতি। তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানবজাতিকে (নাস) ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (সুরা ইমরান ১১০)। আল্লাহ ও তাঁর রসুল কর্তৃক উম্মাহর উপর অর্পিত সুস্পষ্ট দায়িত্ব এটি, এ থেকে পলায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সকল জাতি, ধর্মের মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বনী আদমকে এক কাতারে নিয়ে আসা উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব। এজন্যই এ দীনের অন্যতম একটি নীতি আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন যে, লা ইকরাহা ফিদ্দীন অর্থাৎ দীন নিয়ে জবরদস্তি চলবে না। দীন নিয়ে বাড়াবাড়িও চলবে না।
তাছাড়া মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত সকল নবী-রসুলদের প্রতি এবং আল্লাহর নাজেল করা সকল ধর্মগ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা। পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রত্যেকটি জনপদে, প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের জন্য নবী পাঠিয়েছেন। তাহলে এত বিরাট ও প্রাচীন জনপদ ভারতবর্ষে কি কোনো নবী আসেন নি, কোনো কেতাব আসে নি? অবশ্যই এসেছেন, তবে কালের আঘাতে তাদের শিক্ষাও বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের প্রতিও মুসলমানদের বিশ্বাস রাখা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ নবী-রসুল পাঠিয়েছেন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার অথবা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। তার মধ্যে কোর’আনে এসেছে মাত্র সাতাশ/আটাশ জনের নাম। বাকিদের অনুসারীরাও তো পৃথিবীতে আছেন, তাদেরকেও হেদায়াতের পথে আনার দায়িত্ব মুসলমানদের উপরই আল্লাহ অর্পণ করেছেন। কারণ তাদের কাছেই আছে শেষ কেতাব যেটা কেউ বিকৃত করতে পারে নি এবং শেষ নবীর আদর্শ। সেই আদর্শ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আজও মানবজাতির আকাশে জাজ্বল্যমান। শেষনবী বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে অন্যসব জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়।
কাজেই আমাদেরকে ছাড় দিতে হবে বেশি, আমাদেরকে উদার ও সহনশীল হতে হবে বেশি। আল্লাহর এই দীনের ঘরের দরজা অনেক বড়। এখানে গোটা মানবজাতি প্রবেশ করবে। ঐ দরজায় খিল লাগিয়ে তা সংকীর্ণ করা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক শতাব্দী থেকে তা-ই করা হয়েছে। আজকের মুসলিম জাতির এই হীনতার কারণ ঐ দায়িত্ব থেকে পলায়ন করে শরিয়ার টুকিটাকি বিষয় নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি আর জবরদস্তি।
হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির ভ‚মিকা অগ্রণী হলেও হিন্দু সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব কম নয়। এটা চরম মূর্খতার পরিচয় যে আমরা এক স্রষ্টা থেকে আগত, এক জাতি, এক বাবা মায়ের সন্তান হয়েও এভাবে একে অপরকে বিধর্মী মনে করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে চলেছি। আমরা এক ভাই আরেক ভাইকে অশুচি অপবিত্র মনে করি। আচারের নামে এইসব অনাচার ধর্মের সৃষ্টি নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্টি। আমাদেরকে বুঝতে হবে, স্রষ্টা শুধু মসজিদে মন্দিরে চার্চে প্যাগোডায় থাকেন না। স্রষ্টা আর্ত-পীড়িত, নির্যাতিত মানুষের আর্তচিৎকারে ব্যথিত হন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা এই নির্যাতিত মানুষের দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী, ডেভিল, দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায়, প্যগোডায় ঢুকেছেন। তারা ধর্মকে বাস্তবজীবনের সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে না দেখে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, উপাসনা, পূজা-প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত করেছেন। তারা নবী-রসুল ও অবতারদের প্রাণান্তকর সংগ্রামকে অবজ্ঞা করে চলেছেন। তারা ধর্ম ত্যাগ করে লেবাস ধরেছেন। তারা মানুষকে জানতে দিচ্ছেন না যে, সকল ধর্মেই ধর্মব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমরা যারা প্রকৃতপক্ষেই স্রষ্টার সান্নিধ্য চাই, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোযা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানুষের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের লক্ষ্য, সকল ধর্মের আত্মা। তাইতো ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, ইসলাম শব্দের অর্থও শান্তি। এজন্য মানুষের কল্যাণসাধনই প্রকৃত এবাদত। যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন।
আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোন মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোন ব্যক্তির অধিক নামায ও অধিক রোযা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না, তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা।’ (সিরাত বিশ্বকোষ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।
একই শিক্ষার প্রতিধ্বনী করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে অধিক ধার্মিক। সে পদ্ধতিই হউক, মূর্খই হউক, সে শিবের বিষয় জানুক বা না জানুক সে অপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিবের অধিকতর নিকটবর্তী। আর যদি কেহ স্বার্থপর হয়, সে যদি পৃথিবীতে যত দেবমন্দির আছে, সব দেখিয়া থাকে, সব তীর্থ দর্শন করিয়া থকে, সে যদি চিতা বাঘের মতো সাজিয়া বসিয়া থাকে, তাহা হইলেও সে শিব হইতে অনেক দূরে অবস্থিত (রামেশ্বর-মন্দিরে প্রদত্ত বক্তৃতা)।
আমাদের এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বলতে কিছু ছিল না। ব্রিটিশদের শাসনযুগের আগে এখানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা একটিও হয় নি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক সংঘাত অনেক হয়েছে, তবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত একটাও নয়। ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারত দখল করার পরই চালিয়ে দিল উরারফব ধহফ ৎঁষব নীতি। তারা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য আলাদা স্কুল-কলেজ বানালো, আলাদা রাজনৈতিক দল বানালো, আলাদা হোটেল বানালো, কলেজে আলাদা হোস্টেল বানালো। তারা হিন্দুদেরকে শেখালো মুসলিমরা বিদেশী আগ্রাসনকারী জাতি, তারা এ মাটির সন্তান নয়। এতদিন যে দেশে হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে, একই বাজারে সদাই করেছে, একই পুকুরের পানি খেয়েছে, হিন্দু ডাক্তার মুসলমান রোগীর চিকিৎসা করেছে, মুসলমানদের চাষ করা ফসল হিন্দুরা খেয়েছে সেই দেশেই সৃষ্টি হলো জাতিগত দাঙ্গার। রায়টে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের লাশ পড়ল, বাড়ি পুড়ল, উদ্বাস্তু হলো। শেষতক এক দেশে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না, তারা দুই জাতির জন্য দেশ ভাগ করে ফেলল। এ সবই হলো ব্রিটিশদের ক‚টবুদ্ধির ফল। আজ হিন্দুদের উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের মহামানবদেরকে, কেতাবকে গালি দেয়, মুসলমানদের উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিন্দুদের উপাস্যদেরকে, অবতারগণকে গালি দেয়। তাদের এই পারস্পরিক বিদ্বেষ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তখন সৃষ্টি হয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গার পরিণতি কী তা ভারতবাসী গত দেড়শ বছরে প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশরা এভাবে দুই ভাইকে শত্রুতে পরিণত করে দিয়ে গেছে। এইসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী কীভাবে কাজে লাগায় সে তথ্যও সকলের জানা।
কিন্তু এই শত্রুতা আর কতদিন? এখনও কি সময় হয় নি শত্রুতা ভুলে নিজেদের সত্যিকার পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে আবার ভাই ভাই হয়ে যাওয়ার? এটা করার জন্য প্রয়োজন কেবল মানসিকতার পরিবর্তনের, প্রয়োজন সত্য সম্পর্কে জানার। আমরা এই দুটো জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি, তাদের উভয়ের ধর্মের মূল সত্য যে এক সেটাকে উভয়ের ধর্মগ্রন্থ থেকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমরা বলছি, ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়, ধর্ম হচ্ছে একটি বৈশিষ্ট যা কোনো বস্তু ধারণ করে। আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো, চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা। আগুন যদি না পোড়ায়, পানি যদি না ভেজায়, চুম্বক যদি না টানে তাহলে সে তার ধর্ম হারালো। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা। এই মানবতাবোধে মানুষকে জাগ্রত করার জন্যই নবী-রসুল-অবতারগণ যুগে যুগে আবির্ভুত হয়েছেন। তারা সত্য নিয়ে এসেছেন, যারা সেই সত্যকে ধারণ করেছেন তারাই হয়েছে ধার্মিক। যদি মানুষ সত্যকেই ধারণ না করে, মানবতাবোধে পূর্ণ না হয়, সে যতই উপাসনা করুক সে ধর্মহীন। ইসলামের একটি নাম হচ্ছে দীনুল হক যার অর্থ সত্য জীবনব্যবস্থা। যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে সত্যে পূর্ণ করবে সেটাই তো প্রকৃত ধর্ম। শেষ নবী আরবে এসেছেন, তাই কোর’আনও এসেছে আরবিতে। কিন্তু ভারতবর্ষের অবতারগণ কথা বলেছেন সংস্কৃতিতে বা এ অঞ্চলের কোনো ভাষায়। তাঁদের উপর যে শাস্ত্রবাণী এসেছে সেগুলো এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষাতেই এসেছে। ভাষার পার্থক্য থাকলেও সত্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খালের পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বৃষ্টির পানি সব পানিরই আণবিক গঠন অভিন্ন।
মুসলমানেরা যদি মনে করে আরবভ‚মি তাদের, হিন্দুরা যদি মনে করে ভারত কেবল তাদের, খ্রিষ্টানরা যদি মনে করে ইউরোপ শুধু তাদের, ইহুদিরা যদি মনে করে ফিলিস্তিন কেবল তাদের, বৌদ্ধরা যদি মনে করে মিয়ানমার কেবল তাদের তাহলে সেটা হবে চরম মূর্খতা। কারণ পৃথিবী আল্লাহর, সমস্ত ভূমি আল্লাহর। মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, মাটিতেই আবার তাকে ফিরে যেতে হবে। তাই এই মাটির উপর অধিকার রয়েছে প্রত্যেক বনি আদমের। কোর’আন মোতাবেক মাটির মানুষের ভিতরে আল্লাহর রূহ রয়েছে (সুরা হিজর -৯)। সনাতন ধর্মমতে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই পরমাত্মার অংশ রয়েছে। প্রতিটি মানুষ স্রষ্টার প্রতিভ‚। সেই মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করে কেউ আল্লাহর, পরমাত্মার, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না।
একই ভাবে খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম, জরোথুস্ত্রীয় ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মও একই স্রষ্টা থেকে আগত, যদিও তাদের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। এদের সকলকেই তাদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে এক মহাজাতিতে পরিণত করা সম্ভব। সেটা কীভাবে তা পরবর্তী কোনো এক সময় আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। তবে সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে একটা কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, এলি, ভগবান, পরমব্রহ্ম চান মানবজাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব। আর ইবলিস, শয়তান, এভিল স্পিরিট, ডেভিল, লুসিফার, আসুরিক শক্তি চায় মানুষে মানুষে অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ। প্রকৃত যারা ধার্মিক তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর এই চাওয়াকে পূরণ করাই হলো ধর্ম।
এত কথা, এত লেখার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য পরিষ্কার, তা হলো এই- এ অঞ্চলে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের মতো জঙ্গিবাদী তাণ্ডব সেভাবে এখনও বিস্তার লাভ করে নি, তবে সেই ষড়যন্ত্র চলছে। আর এই তাণ্ডবকে রুখে দিতে হলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের দিকে ঐক্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। কেবল ঈদের দিনে মুসলমানে মুসলমানে কোলাকুলি আর পূজার দিনে হিন্দুতে হিন্দুতে আলিঙ্গন করলে হবে না। তাদের উভয়ের সঙ্গে উভয়েরই কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করতে হবে। এতে কারো জাত যাবে না। এজন্যই নজরুল লিখেছিলেন,
ছুঁলেই তোর জাত যাবে?
জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
সমস্ত বনি আদমকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রাণের তাগিদে, সেই তীব্র আকুতি নিয়ে দেশজুড়ে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে আমরা হাজার হাজার সভা-সমাবেশ, সেমিনার, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, সর্বধর্মীয় সম্মেলন করেছি। ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি, নিন্দাবাদ, অপপ্রচার আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, শত নির্যাতন সহ্য করে, নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে আমরা এই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে এজন্য ভয়াবহ মাশুল দিয়ে হয়েছে। আমার নিজ বাড়িতে বহুবার হামলা চালানো হয়েছে, বাড়ি ঘর আগুনে ভস্মীভূত করে ফেলা হয়েছে, সবকিছু লুটপাট করা হয়েছে, আমাদের দুই ভাইকে গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে জবাই করেছে ধর্মব্যবসায়ীদের অনুসারীরা। হামলা হয়েছে হেযবুত তওহীদের আরো বহু সদস্য-সদস্যার উপরও। জানি না কবে আমরা ধর্মের নামে দাঁড়িয়ে থাকা অধর্মের এই প্রাচীরকে ভাঙতে পারবো, তবে এটা জানি সত্যের মোহনায় একদিন সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ এসে মিলিত হবেই হবে ইনশাল্লাহ। সেদিন পরাজিত হবে ইবলিস শয়তান, সেদিন আল্লাহর বিজয় হবে। আল্লাহর বিজয় মানেই মানবতার বিজয়।
[লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ, ফেসবুক পেইজ:
facebook.com/emamht, ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...