হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দানই সর্বোৎকৃষ্ট দান

রাকীব আল হাসান:
ইসলাম হলো মানুষের সামগ্রিক জীবন পরিচালনার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ, ত্রুটিহীন, সহজ-সরল একটি আদর্শ, জীবন চলার পথ বা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার অনিবার্য ফল হলো শান্তি ও নিরাপত্তা আর এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না থাকার অনিবার্য পরিণতি হলো অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, দুর্নীতি, ধর্ষণ, নিরাপত্তাহীনতা, যুদ্ধ, রক্তপাত, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এক কথায় সমাজে সর্ব রকম অন্যায় বেড়ে যাওয়া। এজন্য এই দীনের নাম হলো- দীনুল ইসলাম অর্থাৎ শান্তির জীবনব্যবস্থা। কোনো আদর্শ যত ত্রুটিহীন, যত নিখুঁতই হোক না কেন তার কোনো মূল্যই থাকে না যদি সেটা প্রতিষ্ঠা করা না হয়। এজন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, “তিনি (আল্লাহ) তাঁর রসুললকে হেদায়াহ ও সত্যদীনসহ প্রেরণ করেছেন এই জন্য যে, তিনি (রসুল) যেন এটাকে (হেদায়াহ ও সত্যদীনকে) অন্যান্য সমস্ত দীনের উপরে প্রতিষ্ঠা করে, বিজয়ী করে।” (তওবা-৩৩, সফ-২৮, ফাতাহ-৯)। তাহলে বোঝা গেল ইসলাম নামক এই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার দুটি অংশ। একটি হলো হেদায়াহ ও সত্যদীন এবং অপরটি হলো এটি প্রতিষ্ঠা করা। প্রথমটি আল্লাহ দান করেছেন, মানুষ শুধু সেটা গ্রহণ করবে, পালন করবে, মেনে নেবে কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টি হলো সংগ্রামের মাধ্যমে, জীবন-সম্পদের কোরবানির মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে এটি প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিষ্ঠা করা না হলে মানুষ এটা পালনও করতে পারবে না, ফলে কাক্সিক্ষত ফল অর্থাৎ শান্তিও আসবে না। এজন্য দীন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অধিক এবং যারা প্রতিষ্ঠা করবে তাদের পুরস্কারও বিরাট। এই প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব প্রথমত আল্লাহ দিলেন রসুলাল্লাহ (সা.) এর উপর। কিন্তু এটা তো কোনো ব্যক্তির কাজ নয়, এই কাজ হলো জাতির কাজ। এজন্য রসুলাল্লাহ একটি জাতি গঠন করলেন যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী। যারা এই জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে, যারা নিজেদেরকে মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারী হিসাবে বিশ্বাস করবে তাদের প্রত্যেকের উপরেই এই দায়িত্ব অর্পিত হবে। এজন্য আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.) এই আদর্শটি, এই দীনটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে, অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে, জান-মালের কোরবানি ও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সমগ্র আরব উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠা করে রেখে গেলেন এবং তাঁর হাতে গড়া উম্মাহ তথা উম্মতে মোহাম্মদীর উপরে দায়িত্ব অর্পণ করে গেলেন এই দীনটি সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, যে কোনো আদর্শ মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংগ্রাম লাগবে আর সংগ্রামের মূল জ্বালানী হলো- জীবন এবং সম্পদ। এজন্য এই জাতির প্রাথমিক সদস্য তথা মো’মেন হবার জন্য মহান আল্লাহ দু’টি শর্ত বেঁধে দিয়েছেন। প্রথমটি হলো- কলেমার উপর (আল্লাহকে ইলাহ হিসাবে এবং মোহাম্মদকে (সা.) রসুল হিসাবে) সন্দেহাতীত ঈমান আনয়ন করা এবং দ্বিতীয়টি হলো- জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় (এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য) সংগ্রাম করা (সুরা হুজরাত- ১৫)। আবার আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ মো’মেনদের থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।” (সুরা তওবা- ১১১)। জীবন এবং সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করাকেই আল্লাহ বলেছেন আমলে সালেহ। কোর’আনে বহু আয়াতে তিনি ঈমান আনয়নের পরেই আমলে সালেহ করতে বলেছেন। মহান আল্লাহ সুরা আসরের মধ্যে সময়ের শপথ করে বলেছেন- “মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত শুধু তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে ও আমলে সালেহ করেছে এবং তারা পরস্পরকে সত্য ও সবরের উপদেশ দেয়।” (সুরা আসর ২-৩)।
তাহলে বোঝা গেল জান্নাতে যাবার শর্ত প্রধানত দু’টো, মো’মেন হবার শর্ত প্রধানত দু’টো, উম্মতে মোহাম্মদী হবার শর্ত প্রধানত দু’টো। প্রথমটি হলো কলেমাতে সন্দেহাতীত বিশ্বাস ও স্বীকৃতি এবং দ্বিতীয়টি হলো আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করা। আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন জান্নাত আর আমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করব জীবন ও সম্পদ। এখানে আমরা দান নিয়ে আলোচনা করব।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম তথা মানুষকে সৃষ্টি করে তার দেহের মধ্যে নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে দিলেন (সুরা হিজর-২৯)। অর্থাৎ আল্লাহর যত রকম গুণাবলী, সিফত আছে সব মানুষের মধ্যে চলে এলো যদিও খুবই সামান্য পরিমাণে। আল্লাহর একটি সিফতি নাম ওয়াহ্হাব অর্থাৎ মহাদাতা। এ বিশ্বজগতে আমরা যা কিছু দেখতে পাই তা সব তাঁরই দান। যে কারণে স্বভাবগতভাবে মানুষ দানশীল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাছাড়াও দানের উদ্দেশ্য, আকিদা ও গুরুত্বের বর্ণনার পাশাপাশি দান করার জন্য আল্লাহ সরাসরি হুকুম দিয়েছেন (সুরা নাহল- ৯০), যার মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় তথা মানবকল্যাণে দান করা মো’মেনের জন্য ফরদ হয়ে যায়। রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান কর, আমি তোমাকে দান করব [আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বোখারি ও মুসলিম]।” হাদিসে আরও উল্লেখিত আছে যে, হাশরের মাঠে দান মো’মেনের জন্য ছায়াস্বরূপ হবে। এ ছাড়া দান আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আল্লাহর রাস্তা হলো মানুষের কল্যাণের রাস্তা। আল্লাহর যাবতীয় হুকুম মানুষের কল্যাণের জন্য। আল্লাহর রাস্তায় দান মানেই মানুষের কল্যাণার্থে কোনো কিছু নিঃস্বার্থভাবে প্রদান করা। এক্ষেত্রে দাতা তার দানের বিনিময় কেবল আল্লাহর নিকট আশা করবে। আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে বান্দার এই দানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। প্রথমত হেদায়াহ ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সম্পদ ব্যয় করাই হলো সর্বোৎকৃষ্ট দান। এই দানের ফলেই সমাজে আল্লাহর হুকুম তথা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি বিদূরিত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই সত্যদীন প্রতিষ্ঠার চেয়ে বড় মানবতার কল্যাণ আর কিছু হতে পারে না। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হলো যাকাত তথা সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্রদের জন্য দান করা। সার্বিক জীবনব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো অর্থনীতি। কোনো জাতি অর্থনীতিকভাবে সমৃদ্ধ হলে অন্য সমস্ত দিক দিয়েও উন্নত হতে থাকে কিন্তু অর্থনীতি দুর্বল হলে ঐ জাতির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আর একটা জাতির অর্থনীতিক সমৃদ্ধির অন্যতম শর্ত হলো- অধিকাংশ জনগণকে শ্রমের আওতায় আনা এবং সম্পদকে যথাসম্ভব সঞ্চালিত করা। অর্থ-সম্পদ অলস পড়ে না থেকে সেটা যদি বেশি বেশি সঞ্চালিত হয় তাহলে তার দ্বারা বেশি মানুষ লাভবান হয়, ফলে সার্বিক অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। মানুষ যেন তার উপার্জিত সম্পদ পুঞ্জীভূত করে না রেখে বিভিন্নভাবে সঞ্চালন করে বা হস্তান্তর করে এজন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুল বিভিন্নভাবে দান করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং উদ্বুদ্ধ করেছেন। উঁচু-নিচু ভূমিতে যদি পানি ঢালা যায় তাহলে ঐ পানি গড়িয়ে নিচু জায়গাগুলো ভরাট করবে, আপনাআপনিই পানির উপরিতল সমান হয়ে যাবে। দান হলো ঠিক তেমনই একটা ব্যবস্থা যা ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে আনে, সমাজের মানুষগুলোর মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে, জাতিকে সমৃদ্ধ করে, দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি করে, অর্থনীতিক অবিচার বন্ধ করে, সর্বদিক দিয়ে সমাজকে সমৃদ্ধ করে। দানের বহু পর্যায় রয়েছে। শুধু নগদ অর্থ নয়, নিজের অধিকারভুক্ত যেকোনো কিছুই দানের বিষয়বস্তু হতে পারে। রসুলাল্লাহর হাদিস মোতাবেক নিজের পোষ্যদের জন্য ব্যয় করা, আত্মীয়তা রক্ষার জন্য ব্যয় করা, মানুষকে বিপদে আশ্রয় দেওয়া, কারো জন্য দোয়া করা, কোনো ক্ষুধার্ত প্রাণীকে খাদ্য দেওয়া, পথ-সন্ধানীকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, পতিত জমিতে আবাদ করা, কোনো মো’মেন ভাইয়ের প্রতি হাস্যমুখ করা, কাউকে সৎ কাজের উপদেশ দেওয়া, অসৎ কাজ হতে নিষেধ করাও দান, পথের থেকে কাঁটা সরিয়ে দেওয়াও একটি দান। এক কথায় বলতে গেলে, প্রত্যেক পুণ্য কাজই মো’মেনের জন্য এক একটি দান যদি সেই কাজে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি উপকৃত হয়।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...